বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


যে সময়ের কথা বলছি, তখন প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়া অথবা নতুন গৃহকোণ নির্মান অতটা সহজ নয়। বিধবা বিবাহ আইনত সিদ্ধ হলেও মেয়েরা মনে মনে অতটাও স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই বৈধব্য তখনও মেয়েদের কাছে প্রতিবন্ধকতা। জীবন তো বহতা নদী। গড়িয়ে চলে নিজের মতো করে। উনিশ বিশ শতকেও মেয়েদের জীবনের গল্পটা গড়পরতা একই ছিল। তাঁদের মধ্যে যারা লিখতে পারতেন, তাঁদের কথা একটু আলাদা। আসলে শব্দের ক্যামোফ্লেজ তৈরির ক্ষমতা আছে। সেইসব ছদ্মবেশের আড়ালে যেন অনেক দুখিনী রাজকুমারী আশ্রয় পেয়েছিলেন। আজকের কথকতা এমনই এক লেখককে নিয়ে। নিরুপমা দেবী। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত চরিত্রের প্রেমিকা রাজলক্ষ্মীর অন্তরালে এই মেয়েটির প্রভাব রয়েছে।
আমরা আলোচনার শুরুতে শরৎচন্দ্রের একটি বক্তব্যের কথা বলি—‘সমাজ জিনিসটাকে মানি কিন্তু দেবতা বলে মানি নে। …পুরুষের তত মুশকিল নেই, তার ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা খোলা আছে, কিন্তু কোথাও কোনো সূত্রে যার নিষ্কৃতির পথ নেই সে শুধু নারী।’ আবার অনেক সময় মেয়েরাও নিজেদের সমাজের বেনিয়ম থেকে মুক্তি দিতে চাইত না। ফলে নতুনভাবে জীবন শুরু করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কোনও সাহসী পুরুষ জীবনে এলেও নয়। অথচ, প্রেম তো জীবনের বড় আকাঙ্ক্ষিত সম্পদ। তাকে হারানোর মতো বেদনাও গ্রহণ করতে পারছেন যে মেয়ে, তিনি জন্মান্তরে নিশ্চয়ই পেলব ভালোবাসার স্পর্শ পাবেন, লিখতে বসে কেন জানি না এমনটাই বলতে ইচ্ছে হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

নিরুরমা দেবী একজন লেখক ছিলেন। সংবেদনশীল মন, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা সবটাই ছিল। আর কী ছিল? আর ছিল ব্যথার পাহাড়। সেই পাহাড় ডিঙোনো সম্ভব না হলেও নিরুপমা লিখে গিয়েছেন। নিরুপমার স্বামীর নাম ছিল নবগোপাল ভট্ট। মাত্র কয়েকটি দিন তিনি কাটাতে পেরেছিলেন স্বামীর সঙ্গে। বিবাহিত জীবন তাঁর কেটেছে ভাগলপুরে। শরৎচন্দ্র ছিলেন নিরুপমার দাদা বিভূতিভূষণ ভট্টের বন্ধু। সেই সূত্রে নিরুপমার বাপের বাড়িতে তাঁর নিত্য আসা যাওয়া। সাহিত্যের আসর বসত বাড়িতে। নিরুপমাদেবীও নিজের লেখা নিয়ে বসতেন। নিরুপমা অন্তঃপুরচারিণী ছিলেন না। এইটাই রক্ষে। শরৎচন্দ্র ধীরে ধীরে তরুণী নিরুপমার প্রতি দুর্বল হলেন। পত্র দিলেন তাঁকে। কিন্তু চিঠিটি হয়তো হাতে পড়েনি নিরুপমার। হয়তো বাড়িতে হেনস্থাও হতে হয়েছিল নিরুপমাকে। ফলে তাঁর প্রতিক্রিয়া এমনই হয় শরৎচন্দ্র চলে যান বর্মা মুলুকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

বর্মায় শরৎচন্দ্রের জীবনে অন্য নারী আসে। আসলে পুরুষ তো কোনওদিনই প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য নয়। তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গের ইতিহাসও লেখা হয়নি কোথাও। বিরহের গল্পটা মেয়েদের নিজস্ব। ব্যক্তিগত। রূপকথার মতো। নিরুপমাদেবীও একলাই রইলেন। অপেক্ষা তো রয়েই যায় মনে। তারপর একদিন যখন মনের সব দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন শুকনো ফুলের মতো পড়ে থাকে আবেগ। নিরুপমাদেবীর জীবনে কতকটা তাই হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

১৯২৭ সালের মধ্যে যে লেখাগুলো নিরুপমা লিখেছিলেন সেগুলোই তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখা। তারপর? শরৎচন্দ্র দূরে গিয়েছেন, ভৌগোলিক ভাবে শুধু নয়। মন থেকেও দূরে। পুরুষের প্রেম আসলে নদী, বয়ে চলে নিত্যনতুন আধার খোঁজে। মেয়েদের প্রেম আয়না। স্থির! একবার ভেঙে গেলে জোড়া লাগে না। কাজেই নিরুপমা দেবী ব্যস্ত হয়ে গেলেন, ভারি ব্যস্ত। সমাজসেবা, রাজনীতি, নারীশিক্ষা সব কাজেই মগ্ন হলেন। লেখার মান নেমে গেল।

দূর থেকে শরৎচন্দ্র বললেন, নিরুপমা ধর্মেকর্মে বেশি মন দিয়েছেন বলেই তাঁর লেখার ক্ষমতা শুকিয়ে গিয়েছে। কত সহজে ধর্মের দোহাই দিতে পারেন পুরুষ। নিরুপমা মৌন হয়ে গিয়েছেন। দিনলিপির পাতায় কেবল বেজে উঠত বিরহের বাজনা। নিরুপমা শব্দের প্রাচীরের আড়ালে নিজের মনকে অনাবৃত করতেন। সারাজীবনের জপ তপ, কঠোর বৈধব্য কাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য পাল করতেন? নিরুপমার বেদনা অনুভবের জন্য আদৌ কি কেউ ছিলেন? না বোধহয়। তারপর বৃন্দাবনে শেষজীবন। প্রথমে মায়ের সেবা, তারপর সহায় সম্বলহীন দশায় তাঁর চলে যাওয়া।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার

জীবনের ঠিক উল্টো ছবি তিনি তৈরি করেছিলেন সাহিত্যে। সেখানে নির্দ্বিধায় ভালোবাসার কথা বলেছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র কাত্যায়নী প্রেমের জন্য নদীর গহনস্রোতে ঝাঁপ দিয়েছিল। প্রেমহীন দাম্পত্য না মৃত্যু? দুইয়ের মধ্যে মৃত্যুকেই শ্যামসমান বলে মেনে নিয়েছিল সে। সুরমা নামের এক চরিত্র দ্বিতীয়বার ফিরে যায় স্বামীর কাছে প্রেমের জন্যই। ‘বন্ধু’ নামের উপন্যাসের দুটি চরিত্র বিবাহ না করেই প্রেমের বন্ধনে যুক্ত রইল।

লেখকের মনস্তত্ত্ব তো সাহিত্যে প্রভাব ফেলবেই। সেই কারণেই হয়তো নিরুপমার সাহিত্যে একটি চরিত্রের পুনর্বিবাহ হয়, কিন্তু তা সুখের হয় না। দিদি, অন্নপূর্ণার মন্দির ইত্যাদি উপন্যাস কিন্তু সেই সময়ের নারীকথনকে ধরে রাখে। নিরুপমার সাহিত্যে এক ইচ্ছেপূরণের প্রয়াস আছে। কিন্তু আজকের পাঠক সহজেই বোঝেন নিরুপমা দেবী ইচ্ছে, আর উপায়ের মধ্যে বিস্তৃত অবয়ব নিয়ে রক্তচক্ষু সমাজ বসেছিল। নিরুপমাদের ক’জন মনে রেখেছেন?—চলবে।

সহায়ক বই
নারী ইতিহাস নারী প্রসঙ্গ, অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content