বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


স্বর্ণকুমারী দেবী।

সরস্বতীর লীলাকমল যে সে মানুষের হাতে অদৃশ্যভাবে থাকে না। ঈশ্বরদত্ত এই প্রতিভা ঠাকুরবাড়ির একটি মেয়ের ছিল। তিনি স্বর্ণকুমারী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদরের মেয়ে! এমন এক সময়ের কথা বলব, যখন মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গে এক পুরুষ কবি কলম শানিয়ে দিব্যি লিখেছিলেন —
যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। /তখন এবি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে।’

বেথুনে পড়তে যাওয়া মেয়েরা যে সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে বিপথগামিনী, ঠিক সেই সময় কলম ধরেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাদেবীর চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারীর পরিচয় শুধু ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, ব্যারিস্টার জানকীনাথ ঘোষালের স্ত্রী অথবা রবীন্দ্রনাথের দিদি— এই গণ্ডিতে আবদ্ধ রইল না। তিনি নিজের প্রতিভার আলোয় নিজেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন উনিশ শতকের সদ্য জাগ্রত বাংলার শিল্প ও সাহিত্যের আকাশে। তাঁর কৃশ দেহ, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, আয়ত ঘনকৃষ্ণ চোখ, দীর্ঘ কেশ, প্রশস্ত সাদা পাড়ের কালো শাড়ি পরা সুন্দর মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কামিনী রায়। স্বর্ণকুমারী দেবীর মৃত্যুর পর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শোকসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘…কণ্ঠে মুক্তামালা, কর্ণে মুক্তাগ্রথিত বড় বড় মাকড়ি— এ সমস্ত এখনও স্মৃতিতে স্পষ্ট দেখতে পাই। তখন সরস্বতী নহে, লক্ষ্মীর প্রতিমা রূপে তাঁকে দেখেছিলাম।’ আজকের আমাদের কথকতা রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী ঠাকুরবাড়ির মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হোক।

লিখতে এতই ভালোবাসতেন স্বর্ণকুমারী যে সারাদিন লেখাতেই মগ্ন হয়ে থাকতেন। সন্তানদের প্রতি প্রবল আসক্তি কোনওদিনই দেখান নি তিনি। লেখার পাশাপাশি নানা সংগঠন ও সম্মিলনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁর মেয়ে সরলাদেবী পরে অভিমান করে লিখেছেন, ‘…এই পালঙ্ক সম্মিলনী দেখে আমার মনে মনে একটা ধারণা বসে গিয়েছিল পালঙ্কই হল প্রত্যেক মায়ের স্বাভাবিক বসার জায়গা, মায়েরা কখনো মাটিতে বসে না।’ স্বর্ণকুমারী স্নেহ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো ছিল না। রাতের জ্যোৎস্নার মতো ছিল। তার উপর একটি সন্তান হারানো মা তিনি। অনেকটা তপস্বীর মতোই জীবন ছিল তাঁর।
উনিশ শতক রেনেসাঁর সময়। অথচ তখনো স্ত্রী শিক্ষার অনিবার্য পরিণতি বৈধব্য মনে করা হত, স্বর্ণকুমারী তখন একাগ্র ভঙ্গিতে শুধুই বিদ্যাচর্চা করছেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জন্য অবশ্য সমাজের প্রথার উল্টো স্রোত ছিলই। প্রথম দিকে বৈষ্ণবীরা এসে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাত। ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের পড়ার অভ্যাস অত্যন্ত সহজভাবেই গড়ে উঠত। এরপর বৈষ্ণবীদের পরিবর্তে ইংরেজ গৃহশিক্ষিকা আসতেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রয়োজনে। সেই শিক্ষার আলোয় ১৮৫৬ সালে জন্ম নেওয়া মেয়েটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠবেন কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজসেবিকা। ১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পিরালি ঘরে সম্পর্ক তৈরির জন্য জানকীনাথকে ত্যাজ্যপুত্র হতে হয়। জানকীনাথের প্রেরণা স্বর্ণকুমারীর জীবনে আলো হয়ে পথ দেখিয়েছে।

সাহিত্যরচনা করা ছাড়াও অনেক বছর ধরে ‘ভারতী’ মাসিকপত্রের সম্পাদনা করেছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁর প্রেরণায় অনেক লেখিকার লেখা এই মাসিকপত্রে জায়গা করে নিয়েছিল। ব্যক্তিগত ভাবে লেখক হিসেবে স্বর্ণকুমারীর নিজের কৃতিত্ব কিছু কম নয়। গল্প, উপন্যাস , গাথা, বিজ্ঞান—প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, গীতি নাটক,কৌতুক নাট্য, কাব্য নাট্য, প্রহসন, নাটক, পাঠ্যপুস্তক, স্বরলিপি-গ্রন্থ ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি সংরূপেই তিনি রেখেছিলেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর কিছু গল্প ও উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ‘দিব্যকমল’ নাটক। বাংলা সাহিত্যে প্রথম ট্রিলজি লিখেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

১৯২৭ সালে স্বর্ণকুমারী ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ পেয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়িতেও তিনি ছিলেন অমূল্য রত্ন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব গভীরভাবে ছিল স্বর্ণকুমারীর জীবনে। বাবা ও মেয়ের মধুর সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়ে যায় স্বর্ণকুমারীর নিজেরই স্মৃতিচারণায়। মা সারদা দেবীর কথাও আছে তাঁর লেখায়। বালিকা স্বর্ণকুমারী ভোর না হতেই বাগানে ফুল তুলতে যেতেন, ঘরে এসে আঁচলের ফুল থালায় সাজিয়ে, ফুল ভরা থালাটি নিয়ে এসে দাঁড়াতেন প্রথমে মায়ের সামনে, তারপর উপাসনার পর বাবার সামনে। মহর্ষি সেই ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে স্বর্ণকুমারীর মন খুশিতে ভরিয়ে দিতেন। তাঁর নিজের কথায় —‘জানি না, দেবতাকে অর্ঘ্য দান করিয়া কোনো সাধকের মনে এইরূপ আনন্দ হয় কিনা।’ এই সেই সময় যখন থেকে স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর বাবার কাছে ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে পাঠাভ্যাস করেন, সংস্কৃত কবিতা শেখেন। মহর্ষির কাছ থেকে শেখা অনেক উপমা পরে তিনি নিজের লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ আর সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যোগে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে স্ত্রীশিক্ষার শুভ সূচনা হয়েছিল। ইন্দিরা দেবী ‘রবীন্দ্র স্মৃতি’তে লিখেছিলেন, ‘বাবা চিরদিনই স্ত্রী শিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন। সেইজন্যই বোধহয় বোনেদের মধ্যে স্বর্ণপিসিমাকে বেশি ভালোবাসিতেন।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা

স্বর্ণকুমারী তাঁর প্রথম উপন্যাস উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণাতেও স্বর্ণকুমারীর সৃজনশীল সত্তা জায়গা করে নিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে স্বর্ণকুমারী ছিলেন ‘স্নেহের বোনটি’! অন্যদিকে আবার রবীন্দ্রনাথ আবার রবীন্দ্রনাথ অসীম স্নেহ পেয়েছেন স্বর্ণকুমারী দেবীর কাছ থেকে। স্বর্ণকুমারী তাঁর ‘গাথা’ কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে —
‘যতনের গাথা হায় কাহারে পরাবো আর?
স্নেহর রবিটি, তোরে আয় রে পরাই,
যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়া ফেলো না খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই — তাইতে ডরাই।’


স্বর্ণকুমারী লেখিকা না হয়ে যদি লেখক হতেন, তাহলে তাঁর প্রতিভা যথার্থ স্বীকৃতি পেতো— এমন কথা মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাণী চন্দকে তিনি বলেছিলেন, তিনি যদি পুণ্যবলে পুরুষ বা নারী হবার স্বেচ্ছাধিকার পান, তবে পুনরায় পুরুষ জন্মই গ্রহণ করবেন। কেন না, ‘আমি যদি আমি না হয়ে ন’দিদি হতুম তবে কি আমি এই আমি হয়ে উঠতে পারতুম? ন’ দিদি ও লিখতেন প্রতিভা ছিল তাঁর, তিনি থেমে গেলেন।’ আমরা রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটির প্রতিকূলে বক্তব্য রাখি? স্বর্ণকুমারী লেখিকা বলে তাঁর লেখার গুরুত্ব কোথাও কমেনি। তাঁর জ্ঞান, পাণ্ডিত্য পুরুষ লেখকদের সঙ্গে সমানভাবে তুলনীয়। সাহিত্য সৃজনের জন্য যতটা কঠোর অধ্যাবসায়, একাগ্রতা ও পরিশ্রম প্রয়োজন, স্বর্ণকুমারীর জীবনে তার কোনওটিরই অভাব ছিল না। বিচিত্র সব কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি সন্তানদের সঙ্গেও বেশি সময় কাটাতে পারতেন না। তাঁর বিদূষী কন্যা সরলা দেবী স্মৃতিচারণায় শোনা যায় অভিমানী স্বর।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

সাহিত্যের সমস্ত সংরূপেই সাবলীলতা থাকলেও স্বর্ণকুমারীর কলম সেরা হয়ে উঠেছিল উপন্যাসের ক্ষেত্রে। মোট এগারোটি উপন্যাস লিখেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বর্ণকুমারীকে বলেছিলেন, তাঁর লেখার উপর যেন পুষ্পবৃষ্টি হয় । সমালোচক মহলের একটি সাধারণ প্রবণতা হল স্বর্ণকুমারী দেবীকে ‘মহিলা সাহিত্যিক’ তকমা দেওয়ার। কিন্তু তিনি একজন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর সৃষ্টি এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। যে নারী এক অন্ধকার সময়ে নিজেকে খুঁজে বেরিয়েছেন নিজের সৃষ্টির অন্দরলোকে,তিনি পাঠকের কাছে এক উজ্জ্বল সৃজনশীল সত্তা। পাঠক তাঁর লেখনের আড়াল থেকে খুঁজে পেতে পারেন এক রোম্যান্টিক কিশোরী মন, যাকে ঘিরে আছে বিদ্রোহের উত্তাপ। ঠাকুরবাড়ির প্রবাদপ্রতিম পুরুষদের মতো তিনি প্রচারের প্রবল আলো পাননি। কিন্তু সময় তাঁকে মনে রেখেছে। তাই হয়তো চেয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী—
‘এ ফুলের মালাগাছি
বহুদিন ধরে—
লুকানো রয়েছে গাঁথা
হৃদয়ের পরে।
আজ ধরিতেছিখুলি
ছিন্ন ভিন্ন দলগুলি’
অনাদরে লবে তুলি—
অথবা আদরে?’


স্বর্ণকুমারীর লেখায় এক বিরহিনী মেয়ে কোথায় যেন থাকে। মনে হয় রোম্যান্টিক মেয়েটি কোথায় যেন একটু হারিয়ে গিয়েছে। চরিত্রদের মুখে কত সংলাপ, কান্না যেন স্বর্ণকুমারীর অন্তরের কথা! ‘ফুলের মালা’ উপন্যাসে লিখছেন, ‘ভগবান, পৃথিবীতে তুমি পুরুষ ও নারীকে এতই অসমান করিয়া জন্মষদিয়াছ? একজন কাঁদিয়া মরিবে আর সেই অশ্রুজলে অন্য জনের হাসি ফুটিবে? একজনকে শোণিত দিয়াছ কি অন্যের পিপাসা মিটাইবার জন্য?’স্বর্ণকুমারীর লেখায় বায়রণের সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি যেন রেকারেন্ট মোটিফের মতো ফিরে ফিরে আসে। Man’s love is man’s life a thing apart/it’s woman’s whole existence. ‘বাবা ও স্বামীর প্রবল ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত ভাইদের র্ চারের তীব্র আলোর মধ্যেও স্বর্ণকুমারী নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করেছিলেন। কোমল অথচ ঋজু। স্বর্ণকুমারীকে নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।

গ্রন্থঋণ:
স্বর্ণকুমারী উপন্যাস সমগ্র, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content