রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


আশাপূর্ণা দেবী।

উত্তর কলকাতার একটি সরু গলি আর মাঝারি পুরনো বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বেড়ে উঠছিল একটি মেয়ে। ঝাঁকড়া চুল, ঢলঢলে ইজের পরা সে মেয়ের অনেক কাজ। খালি দেশলাই বাক্স, সিগারেটের টিন, সাবানের বাক্স, টিনের পিচকিরির খালি চোঙ, টুকরো টাকরা কাঠ— আরও কত সামগ্রী একত্রিত করে ছাদে ব্যক্তিগত অবসরে চলেছে মেয়েটি! সকলে তাঁকে দস্যি বলে অথবা ‘পাহাড়ে ডাকাত’। পরে এই এলোপাথাড়ি ছেলেবেলার গল্পই শুনতে চাইবেন কত পাঠক। সে মেয়েটি আশাপূর্ণা দেবী, বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য লেখক।

দস্যি মেয়ের দুরন্তপনা সামলাতে মা তাকে বসিয়ে দিতেন বই হাতে, উঁচু জানালার চওড়া ধাপে। তাঁর ঠাকুমার সনাতন সংসারে মেয়েদের বর্ণপরিচয় পড়াও নিষিদ্ধ ছিল। ছেলেদের জন্য ছিল স্কুল, ছেলেদের জন্য মাস্টারমশাই আর মেয়েদের জন্য সমাজের লাল চোখ, সংসারের বোঝা! আশাপূর্ণা দেবীর স্মৃতিচারণে তাঁর বই পড়ার এক আশ্চর্য ভঙ্গির কথা জানা যায়। আশাপূর্ণা উল্টো করে বই পড়তে পারতেন। তারপর দেদার হাসি আর মস্করার মধ্যে উল্টো থেকে সোজা পড়ায় পৌঁছনো গেল।
আশাপূর্ণা দেবীর মা বই পড়তে ভালোবাসতেন, অনেকটা তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র সুবর্ণলতার মতো। বৌমানুষের বইপড়ার অপরাধে আশাপূর্ণাদের বাড়ি বদল হল। কোনও ঝগড়াবিবাদ ছাড়াই। এ যেন বইপোকাদের একত্রে নতুন ঠাঁই পাওয়া। আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে আশাপূর্ণার মনের গঠনপর্ব চলল। স্মৃতিচারণায় আশাপূর্ণা বলছেন, ‘আমরা তিন বোন ছিলাম যেন একটি ট্রিলজির অখণ্ড সংস্করণ এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।’ আশাপূর্ণা দেবী কিন্তু ছিলেন একেবারে ‘ছিষ্টিছাড়া’! পরস্পরবিরোধী দুটো হাওয়ার মধ্যে আশাপূর্ণার বড় হওয়া। তাঁর বাবা ছিলেন প্রবল ইংরেজভক্ত আর মা মনেপ্রাণে ‘স্বদেশী’।

আশাপূর্ণার বাবা গুণী মানুষ। অনেকরকম কাজ ও ব্যস্ততা! কিন্তু আশাপূর্ণার মায়ের জীবনের একটাই পরমার্থ ছিল— সাহিত্যপাঠ। বাড়িতে আসত হরেকরকম পত্রপত্রিকা। এছাড়াও জ্ঞানবিকাশ লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি আর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরি থেকে অসংখ্য বই আসত। বইটা তাঁদের বাড়িতে ছিল ভাতের মতোই অপরিহার্য ছিল। ছবি আঁকা, পদ্য পড়াও বেশ জরুরি ছিল। রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু হল একটা সময় পর। তারপর সাহস করে একদিন চিঠি লেখা হল রবীন্দ্রনাথকে। তারপর একদিন রাজার চিঠির মতো রবি ঠাকুরের চিঠিও এল। এইবার একদিন আশাপূর্ণা লিখে ফেললেন একটি কবিতা—‘বাইরের ডাক’! প্রকাশিত হল শিশুসাথী পত্রিকায়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৬: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন—মেয়েদের আলোর দিশারী

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-২২: মাউথ মেল্টো

লেখক হতেই হত আশাপূর্ণাকে। কারণ কবিতা প্রকাশের পরেই চিঠি এল পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ শ্রীসরোজকুমার চক্রবর্তীর। আশাপূর্ণার কাছে গল্প চেয়ে চিঠি লিখেছেন। আশাপূর্ণার বয়স তেরো। এই উৎসাহ পেয়ে লেখা চলল গড়গড়িয়ে। এরপর শুরু হল পুরস্কার প্রাপ্তি। লেখক আশাপূর্ণা এর মধ্যে পঞ্চদশী এবং বিবাহিতা। ১৩৩১ সালে এক গলা ঘোমটা টেনে, এক ট্রাঙ্ক ভর্তি বই নিয়ে আশাপূর্ণা চললেন শ্বশুরবাড়ি। জীবনের অন্য পর্ব শুরু হল।

আজব শহর কলকাতা আশাপূর্ণার লেখক জীবনকে সমৃদ্ধই করেছিল। সিনেমা হল না থাকলেও থিয়েটার ছিল। আশাপূর্ণা দিব্যি থিয়েটার দেখতে যেতেন। প্রথাগত শিক্ষা না হলেও বই পড়ে, থিয়েটার দেখে নিজের কল্পনাশক্তিকে ধারালো করে তুলেছিলেন বেশ! প্রথম জীবনে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর বর যেন স্টেনোগ্রাফার হয়। বই পড়তে পারবেন অনেক। আশাপূর্ণা স্বামীর সহায়তা পেয়েছিলেন লেখার ক্ষেত্রে। নিজেকে বলতেন, সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার। মনের মধ্যে যেসব নতুন কথার ঢেউ জমে ওঠে সেসব যেন অদৃশ্য কোনও শক্তি লিখিয়ে নেয়। লেখাপড়ার ধার দিয়ে না গেলেও এই যে হাজার হাজার পাতা লেখা! কে যে এইসব লেখা লিখিয়ে নেন, এই নিয়ে সংশয় ছিল আশাপূর্ণার মনে। আমরা সংশয় না বলে বিনয় বলতে পারি। তিনি চিরকাল চার দেওয়ালে বন্দি থেকেই লিখেছেন। তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত কেউ জানতেনই না, আশাপূর্ণা দেবী আসলে কে? প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত দাসের মতো লেখকরাও তাঁর নামটিকে কোনো পুরুষ লেখকের ছদ্মনাম ভাবতেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৮: ফ্রানজ বেকেনবাওয়ার: মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে

আশাপূর্ণা জীবনে যা অনুভব করেছেন তাই লিখেছেন। নারীকেন্দ্রিক লেখা হলেও ফেমিনিজমের ছায়া পড়েনি সেসব সব লেখায়। তাঁদের আমলে ‘নারীমুক্তি’ নয়, ‘বিদ্রোহিনী’ শব্দটি প্রচলিত ছিল। আশাপূর্ণার কলম অনেক বিদ্রোহিণীর জন্ম হয়েছিল। খুব সচেতনভাবে তিনি সাহিত্যে ‘বাস্তবতা’ ও ‘শালীনতা’ এই দুটির প্রয়োগ করেছিলেন। পাঠক সমাজ তা গ্রহণও করে চলেছেন। আজও! তিনি নিজের সাহিত্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সাহিত্যের ধর্ম সেই আশ্বাসের বাণী বহন করে আনা। সাহিত্যই বলবে— মানুষ কেবল রক্তমাংসের মানুষ নয়, তার মধ্যে অমৃতময় সত্তার উন্মোচন আর মানুষের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই সাহিত্যের কাজ।’

আশাপূর্ণার প্রথম বই—‘ছোট ঠাকুর্দার কাশীযাত্রা।’ এরপর বড়দের জন্য একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ‘জল ও আগুন’। তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম—‘প্রেম ও প্রয়োজন’! এরপ ম্যাজিক কলম ভানুমতির খেল দেখাতে শুরু করে। শতাধিক উপন্যাস, হাজার দুইয়েকের বেশি ছোটগল্প লিখে ফেলেছিলেন। বাল্য বয়স থেকে বার্ধক্য— লেখার সময় নেহাত কম ছিল না। জীবনের টানাপোড়েন, ঝড় ঝঞ্ঝা লেখায় ছায়া ফেললেও সবকিছু ছাপিয়ে উঠল জীবনের সদর্থক ভাবনা। তাঁর লেখা ট্রিলজি— প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা আর বকুলকথা যেন তিনটি ভিন্ন সময়ের দলিল। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসটি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল। এছাড়াও লীলা পুরস্কার, ভুবনমোহিনী দাসী পদক, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, হরনাথ ঘোষ পদক, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, পদ্মশ্রী, পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়

আশাপূর্ণা দেবী অন্দরমহলের গল্পই লিখেছেন বেশি। বাইরের পৃথিবী তাঁর লেখায় অল্পই এসেছে। তাঁর নিজের কথায়—‘বহির্বিশ্বের ভাঙাগড়ার কাহিনী নিয়ে রচিত হয় বিগত কালের ইতিহাস। আলো আর অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে উচ্চকিত সেই ধ্বনিমুখর ইতিহাস পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত রাখে প্রেরণা, উন্মাদনা রোমাঞ্চ। কিন্তু স্তিমিত অন্তঃপুরের অন্তরালে ও কি চলে নাভাঙাগড়ার কাজ?… যেখান থেকে রঙ বদল হয় সমাজের, যুগের সমাজমানুষের মানসিকতার।…তবু রচিত ইতিহাসগুলি এই নিভৃতলোকের প্রতি উদাসীন। অন্তঃপুর চিরদিনই অবহেলিত।’

আশাপূর্ণার লেখা সেই অবহেলিত অন্তঃপুরের স্নিগ্ধ আলোকবর্তিকা।

সহায়ক বই
আর এক আশাপূর্ণা, আশাপূর্ণা দেবী
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content