বিগত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই সমাজের প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিবিধ ও বিভিন্ন প্রকার সংকীর্ণতার দিকে তর্জনী ওঠাতে আরম্ভ করেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন কর্মজগৎ থেকে আসা মহিলারা, উঠছে প্রশ্ন, যুক্তি ও শিক্ষার প্রভাব ভাঙছে ক্ষমতায়নের অচলায়তন। এবার সেই অচলায়তনের ঠিক ভরকেন্দ্রটিতে যেন হানা হল আঘাত। হিন্দু ধর্মের পরিকাঠামোয় পৌরোহিত্যে অধিকার কেবল পুরুষের, নারীরা সেখান চিরকালই নিষ্ক্রিয় এক আজ্ঞাপালনকারী দর্শক মাত্র। যদিও কেবল হিন্দুধর্ম না যেকোনও ধর্মই যখন প্র্যাকটিস থেকে প্রতিষ্ঠানমুখী হতে আরম্ভ করে তখনই সে হয়ে ওঠে ক্ষমতায়নের পরিপোষক আর ভারতবর্ষে এই একবিংশ শতকেও যে ক্ষমতায়ন পুরুষতন্ত্রেরই এক অপর পিঠ সে কথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু শিক্ষা ও প্রগতির বিপ্লবে একদিন না একদিন মাথা নত করতে হয় ক্ষমতাকেও, যতই শক্ত তার থাকুক আলোর মাহাত্ম্যের সামনে রুদ্ধ শক্তি মাথানত করতে বাধ্য আর এক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটল। মহিলাদের পৌরোহিত্য করার যে যাত্রা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা স্বর্গীয়া গৌরী ধর্মপালের অভিভাবকত্বে আরম্ভ করেছিলেন হীরালাল কলেজের অধ্যাপিকা নন্দিনী ভৌমিক সেই যাত্রা আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। প্রাথমিকভাবে প্রভূত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হলেও বর্তমানে সেই সমস্ত প্রতিবন্ধকতার অনেকটাই তাঁরা প্রতিহত যে করেছেন কেবল তাই নয় উপরন্তু অর্জন করেছেন অপার শ্রদ্ধা এবং মানুষের ভালোবাসা। আর এবার সেই পথের শরিক হয়ে উঠলেন যোগমায়া দেবী কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপিকা পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়। দেবী সরস্বতীর চিন্ময়ী রূপের আরাধনা করলেন স্বয়ং বাগদেবীর আশীর্বাদধন্যা, যেন দেবীরই মৃন্ময়ী রূপের প্রতিভূ হয়ে।
হঠাৎ করেই কি এই পুজোর পরিকল্পনা তৈরি হল নাকি চিন্তাভাবনা চলছিল অনেকদিন ধরেই? অধ্যাপিকা আমাদের জানান, যেহেতু যোগমায়া দেবী মূলত গার্লস কলেজ, সেই জন্যে বহুদিন ধরেই এমন আলোচনা চলছিল যে যদি কলেজে সরস্বতী পুজো কোনও মহিলা অধ্যাপিকাকে দিয়ে করানো যায় তাহলে খুব ভালো হয়। যেহেতু আমি এই কলেজের সংস্কৃত বিভাগের একজন সিনিয়র অধ্যাপিকা তাই পূ্র্বে উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং আমার বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সহকর্মীরাও আমাকে অনুরোধ করেন সরস্বতী পুজো করার জন্য। আমার না বলার কোনও জায়গাই ছিল না কারণ বাগদেবী আমার সঙ্গে, আমার শিক্ষার চর্চার মধ্য দিয় সবসময়েই রয়েছেন, নিষ্ঠাভরে নিজ হাতে যদি তাঁর আরাধনা করতে পারি তাহলে তার থেকে ভালো আর কীই-বা হতে পারে? প্রস্তাব পাওয়ার পর তাই মনে কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব না রেখেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তবে হ্যাঁ, আগে থেকে বিশেষ পরিকল্পনা কখনওই তেমন ছিল না।
এতদিনকার প্রথাগত পৌরাণিক স্কুলিং অনুযায়ীই কি পুজো করলেন? স্কুলিং-এর ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেছে? উত্তরে পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় জানালেন যে, ‘না, এই পুজো আমি একেবারেই এতদিনকার প্রথাগত পৌরাণিক স্কুলিং মেনেই করেছি। দেবী সরস্বতীর আরাধনায় বেদের প্রচুর মন্ত্র ব্যবহার করা হয় অবশ্যই। কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে সামগ্রিকভাবে পৌরাণিক কাঠামোই অনুসৃত হয় এসেছে এতগুলো বছর ধরে। কারণ বেদে কখনওই মূর্তিপুজোর কোনও উল্লেখ ছিল না। বেদে প্রকৃতি পুজোর উদাহরণস্বরূপ সরস্বতী নদী কিংবা বাগদেবীর উল্লেখ থাকলেও মূর্তিপুজো সম্পূর্ণরূপেই । আমি এই কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ার আগে আমি অবশ্যই আমার শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকা অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালকে স্মরণ করেই এই কাজে হাত দিয়েছিলাম কিন্তু দিদি পুরোপুরিই বৈদিক স্কুলিং মেনেই পৌরোহিত্য করতেন। আমিও প্রথাগত পৌরাণিক প্রথা মেনেই আমার জীবনের প্রথম সরস্বতী পুজো করলাম।’
এতদিন ধরে সামাজিক ক্ষেত্রে মূলত পুরুষরাই পৌরোহিত্য করে এসেছেন সেক্ষেত্রে কি কোনও সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে? উত্তরে অধ্যাপিকা অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে বললেন যে, ‘একেবারেই নয়। বরং আমার সহকর্মী, কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং আমার ছাত্রীরা প্রত্যেকের কাছ থেকেই সর্বতোভাবে সমস্ত সহযোগিতা আমি পেয়েছি। কোনওরকম সমস্যাই হয়নি।
এতদিনকার প্রথাগত পৌরাণিক স্কুলিং অনুযায়ীই কি পুজো করলেন? স্কুলিং-এর ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেছে? উত্তরে পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় জানালেন যে, ‘না, এই পুজো আমি একেবারেই এতদিনকার প্রথাগত পৌরাণিক স্কুলিং মেনেই করেছি। দেবী সরস্বতীর আরাধনায় বেদের প্রচুর মন্ত্র ব্যবহার করা হয় অবশ্যই। কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে সামগ্রিকভাবে পৌরাণিক কাঠামোই অনুসৃত হয় এসেছে এতগুলো বছর ধরে। কারণ বেদে কখনওই মূর্তিপুজোর কোনও উল্লেখ ছিল না। বেদে প্রকৃতি পুজোর উদাহরণস্বরূপ সরস্বতী নদী কিংবা বাগদেবীর উল্লেখ থাকলেও মূর্তিপুজো সম্পূর্ণরূপেই । আমি এই কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ার আগে আমি অবশ্যই আমার শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকা অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালকে স্মরণ করেই এই কাজে হাত দিয়েছিলাম কিন্তু দিদি পুরোপুরিই বৈদিক স্কুলিং মেনেই পৌরোহিত্য করতেন। আমিও প্রথাগত পৌরাণিক প্রথা মেনেই আমার জীবনের প্রথম সরস্বতী পুজো করলাম।’
এতদিন ধরে সামাজিক ক্ষেত্রে মূলত পুরুষরাই পৌরোহিত্য করে এসেছেন সেক্ষেত্রে কি কোনও সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে? উত্তরে অধ্যাপিকা অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে বললেন যে, ‘একেবারেই নয়। বরং আমার সহকর্মী, কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং আমার ছাত্রীরা প্রত্যেকের কাছ থেকেই সর্বতোভাবে সমস্ত সহযোগিতা আমি পেয়েছি। কোনওরকম সমস্যাই হয়নি।
ভবিষ্যতে আর পৌরোহিত্য করার পরিকল্পনা রয়েছে কি? ‘বয়স তো বাড়ছে। খুব বড় কাজ হলে হয়তো করতে পারব না, একা হাতে কোনও সাহায্য ছাড়া, কিন্তু আমার পক্ষে শারীরিকভাবে করা সম্ভবপর হলে অবশ্যই করব। এমন এক অনুরোধ নিয়ে যদি কেউ কখনও আসেন তবে তা ফেলে দিতে কখনওই পারব না।’ বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন তিনি। দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদধন্যা পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় ‘সময় আপডেটসে’র সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সামিল হবার অনুভূতি, আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ‘দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী, প্রজ্ঞার দেবী, মেধার দেবী, তাঁকে স্মরণ করেই দৈনন্দিন কর্মজীবন আরম্ভ করে থাকি। বাড়িতে নিজে সরস্বতী পুজো করতাম বহু বছর ধরেই, তাই কলেজ যখন প্রস্তাব দিল তখন এক কথাতেই হ্যাঁ করে দিয়েছিলাম। রাতের পর রাত জেগে মন্ত্র নিয়ে পড়ে থেকেছি। আলাদা করে প্রতিটি মন্ত্রের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করেছি। পুজো করার সময় আমার সমস্ত সহকর্মী, ছাত্রীরা এবং পুজোয় উপস্থিত কলেজের অন্যান্য কর্তৃবৃন্দদের প্রতিটি মন্ত্রের মানে বুঝিয়ে দিয়েছি। সবাইকে বলে দিয়েছিলাম কেউ যেন কোনও দক্ষিণা না আনেন। এই পুজো পুরোপুরি দক্ষিণাহীন এক পুজো হবে। আমি কোনও পার্থিব প্রাপ্তির জন্য এই পুজো করছি না, নিষ্ঠাভরে দেবীর আরাধনা করতে পারার সুযোগই হবে আমার একমাত্র প্রাপ্তি। এ এক অন্যরকমের অনুভূতি। অন্যরকমের প্রাপ্তি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রাপ্তি অন্যতম এক প্রাপ্তি হয়ে থেকে যাবে।