মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


চিন্ময়ী রেখা সবসময় অনন্যা — সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে সসম্মানে উত্তীর্ণা তিনি। তিনি আর কেউ নন, তিনি মুম্বই রেল পুলিশের (সিআরপিএফ) সাব-ইন্সপেক্টর মধ্য তিরিশের রেখা মিশ্র। অভাব, অসন্তোষ, শারীরিক নিপীড়ন, অসুরক্ষা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির কারণে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা, নিখোঁজ, পাচার হয়ে যাওয়া হাজারেরও বেশি বাচ্চা, কিশোর, কিশোরীর উদ্ধারকর্ত্রী তিনি। ১৯৮৬ সালে প্রয়াগরাজ এলাহাবাদের কনজিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। খেলাধুলোয় উৎসাহী রেখা ছোট থেকেই জানতেন পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে তাঁকে যোগ দিতে হবে, কারণ তাঁর বাবা কাজ করতেন সেনাবাহিনীতে আর ঠাকুরদা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।
জনসেবা তাঁদের রক্তে। তাই ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করার পর স্কুল কলেজের চাকরিতে না গিয়ে পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় পাশ করার পর ২০১৪ সালে রেল পুলিশে যোগ দেন তিনি। জনসবাই বলা উচিত তাঁর কাজকে, কারণ ইচ্ছে করলেই তিনি মুম্বইয়ে তাঁর প্রথম পোস্টিংয়ের জায়গা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাসে শুধু টহল দিয়ে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি জানতেন উজ্জ্বল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মধ্যে এক অন্ধকার ভারতবর্ষ বাস করে, যেখানে রাঘববোয়াল থেকে সাধারণ দালালদের নজর থাকে অভিভাবকহীন অথবা অভিভাবক থেকেও অভিভাবকহীন বাচ্চাদের ওপর। তাই তীক্ষ্ণ প্রশিক্ষণ ও বিরল দক্ষতায় তিনি ও তার সহকর্মীরা মায়ানগরী মুম্বইয়ের অন্যতম (ভিটি) স্টেশনে হারিয়ে যাওয়া, আনমনা, উদ্দেশ্যহীন, ভীত বাচ্চাদের দেখে বুঝে যান কার কেমন সাহায্যের প্রয়োজন, কাকে কীভাবে উদ্ধার করতে হবে।
২০১৮ সালের মধ্যে বলিউড ও তারকাদের আকর্ষণে অথবা ফেসবুকের মাধ্যমে সদ্য পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে আসা ১০ থেকে ১৮ বছরের হাজারের কাছাকাছি বাচ্চা ও কিশোর কিশোরীদের পাচার হয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করে তাদের তিনি আবার বাড়িতে, অন্য পরিজনদের কাছে অথবা হোমে পাঠিয়েছেন। বার বার বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন। ষোলো বছরের এক আনমনা, স্টেশন চত্তরে একা ঘুরে বেড়ানো মেয়েকে তার বাড়ি পাঠানো হয়েছিল, পরে জানা যায় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
আরও পড়ুন:

ফের কলকাতা এবং দক্ষিণবঙ্গে শনি ও রবিবার বৃষ্টির পূর্বাভাস, পুজোর আগে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা

ত্বকের পরিচর্যায়: হঠাৎ শিশুর জ্বর আর মুখে-হাতে দানাদানা? কোন রোগের উপসর্গ? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার

ছোটদের যত্নে: শিশুর হাঁপানির সমস্যা? বাড়িতে কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করবেন জেনে নিন খুঁটিনাটি

একবার মুম্বই স্টেশনে পৌঁছনো গোয়ার এক পঁয়তাল্লিশ বছরের অপহরণকারীর কাছ থেকে বছর পনেরোর একটি মেয়েকে উদ্ধার করেন শুধু গোয়া পুলিশের পাঠানো দুটি ছবির ভিত্তিতে। মেয়েটির শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। রেখা মিশ্র ও তাঁর সুদক্ষ টিম মিলে মুম্বইয়ের ওই বিশেষ অঞ্চলের অপরাধ প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে এনেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি কিশোরীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, চাইলে নিজেদের জীবনের নায়িকা নিজেরাই হয়ে তারা তাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
এহেন দৃপ্ত, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, নিষ্ঠার প্রতীক রেখাকে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী শক্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছে ভারত সরকার। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এবং নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শ্রীমতী মানেকা গান্ধীর উপস্থিতিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ তাঁর হাতে সেই পুরস্কার তুলে দেন। নিজের পুরস্কারের সম্পূর্ণ অর্থ তিনি চাইল্ডলাইন নামে এক স্বেচ্ছসেবী সংস্থাকে দান করেছেন, যারা শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে।
রেখা মনে করেন তাঁর প্রাপ্ত অর্থ তাঁর থেকে বেশি ওই শিশুদের প্রয়োজন। নিজের বাবা মা, শ্বশুরবাড়ির প্রত্যক্ষ সাহায্যে এগিয়ে চলা এই মানুষটি দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে যান। কারণ, কাজটা তার ভালোবাসার। এক বছরে ৪৩৪টি বাচ্চাকে উদ্ধার করা রেখার ব্যক্তিগত জীবনে মা হয়ে ওঠা হয়নি। এতে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, সন্তানধারণ করাই নারীর একমাত্র কাজ নয়। অবিরত নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ও দেশের, দশের জন্য নিজের ভাবনাকে সফল করা, তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।

Skip to content