বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত।

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির উদ্ভব হয়েছে ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ ‘Universitas Magistrorum et Scholarium’ থেকে। যার অর্থ শিক্ষক ও পণ্ডিতদের সম্প্রদায়। বিদ্যালয় শব্দটির সঙ্গে বিশ্ব শব্দটি যোগ করার অর্থ হল—এই বিদ্যাপীঠ কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির জন্য নয়। এটি সারা বিশ্বের জন্য। বর্তমানে পৃথিবীতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কিন্তু কোনটি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়ে কয়েকটি অভিমত পাওয়া যায়। চিনাদের দাবি, পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় চিনের ‘সাংহাই হায়ার স্কুল’। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২২৫৭ খ্রিস্টপূর্ব। পাকিস্তানের দাবি, পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের ‘তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়’। আবার ভারতীয়দের দাবি, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের বিহারের ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’।

তবে ইউনেস্কো এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুসারে মরক্কোর ফেজে অবস্থিত ‘আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়’ বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা আল ফিহারি নামে এক ধনী মহীয়সী নারী ফেজ নগরীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে এটি ছিল মসজিদ, পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এটি নির্মাণ করতে সময় লাগে ২৭৮ বছর। ইতালির বোলোনায় (Bologna) যখন প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও আগে কারাওইন হয়ে ওঠে এক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়।
আল কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে রয়েছেন ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৩৯৫), ইবনে আল খাতিব, ইবনে হারাজিম, মুহাম্মদ আল ইদ্রিস (মৃত্যু ১১৬৬) প্রমুখ জগৎখ্যাত পণ্ডিত। গণিত ও মহাকাশবিদ্যা পড়াশোনার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে ফাতিমার বিশ্ববিদ্যালয় সমাদৃত হয়। এমনকি, পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টারও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এখনও পৃথিবীর বহু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার ও আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।

একজন নারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় কালক্রমে ২২ হাজার ছাত্রছাত্রীর পঠন-পাঠনের উপযোগী হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আবাসিক ছিল না। তবুও পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি তথা তৎকালীন সময়ের শিক্ষার প্রসারের এই উল্লেখযোগ্য নিদর্শনটির কর্ণধার একজন নারী এই ঘটনা সর্বযুগে সর্বকালে এক নজির।

আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা। ‘নালন্দা’ একটি সংস্কৃত শব্দ। ‘নালাম’ শব্দের অর্থ পদ্ম। পদ্ম জ্ঞানের প্রতীক। ‘দাঁ’ শব্দের অর্থ ‘দেওয়া’। এই হিসেবে নালন্দা শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ ‘জ্ঞান দেওয়া’। কারও কারও মতে ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রাপ্ত সাপ ‘নাগা’ থেকে নালন্দা শব্দের আবির্ভাব।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: চুপি চুপি ঘুরে আসি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

ভারতের বুকে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১০,০০০ শিক্ষার্থী ও ২,০০০ শিক্ষকের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল এখানে। সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে নালন্দায় প্রথম বৌদ্ধ উপাসনালয় গড়ে তোলেন, যা পরে বৌদ্ধ গবেষণাগার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এত জনপ্রিয় ছিল যে, চিন, তিব্বত, গ্রিস, কোরিয়া, তুরস্ক ও পার্সিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসতো।

সম্রাট হর্ষবর্ধনের শাসনকালে পার্শ্ববর্তী গ্রামসহ মোট ২০০টি গ্রাম নিয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছিল। ১৪ হেক্টর জমিতে লাল ইটের ভবনের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও সে সময়ের উচ্চতর সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদাহরণ। মূল ভবনে রয়েছে আলাদাভাবে ৮টি কম্পাউন্ড। এছাড়াও ১০টি মন্দির, ধ্যানকক্ষ, পাঠদান কক্ষ। স্থাপত্যকে আরও সুন্দর করতে প্রতিটি ভবনের সামনেই ছিল জলাধার আর চিত্তাকর্ষক উদ্যান।

নালন্দার বিখ্যাত শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে জীবক, পাণিনি, কুটিলা, বিষ্ণু শর্মার মতো জনপ্রিয় শিক্ষকের নাম। এই প্রতিষ্ঠানটি বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা ও গবেষণার জন্য তৈরি হলেও সেখানে ধনুর্বিদ্যা, রাজ্য শাসনবিদ্যা, সমরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, হিন্দুদর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ ৬৮টি বিষয় পড়ানো হতো।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১১: দাদা অঙ্ক কী কঠিন!

কিন্তু এই জ্ঞানপীঠকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল—একবার নয়, তিনবার। বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পড়ে নালন্দা। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিঃ)। মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানরা নালন্দা আক্রমণ করে। তারা বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরের বংশধররা নালন্দাকে পুণর্গঠন করেছিলেন।

প্রায় দেড় শতাব্দী পর আবার নালন্দা ধ্বংসের মুখে পড়ে। এ বার আক্রমণ করেন বাংলার শাসক শশাঙ্ক। মুর্শিদাবাদের শাসক শশাঙ্ক রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন। ফলে রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে ঢুকেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করেন। বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে খণ্ডবিখণ্ড করেন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বর্ণনায় শশাঙ্কের আক্রমণ ও নালন্দা ধ্বংসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয়বারের মতো ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনও দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নালন্দাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি, বড় একটি অংশকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মূলত পনেরশো শতকের দিকে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে—নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকোষাধার। শেষবার যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তখন এখানকারর গ্রন্থাগারে যত বই সংরক্ষিত ছিল তা প্রায় তিন মাস ধরে পুড়েছিল।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

চিন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সহায়তায় মাটিতে চাপা পড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্ধারের কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। নালন্দাকে উদ্ধারের পর এর ব্যাপ্তি, ভবনগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প দেখে সমগ্র বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এটি অনবদ্য নিদর্শন। উঁচু ও পুরু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল নালন্দা—যা তার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার বিষয়টি গর্ব করে জানান দেয়। মূল ভবনে মোট আলাদাভাবে ৮টি কম্পাউন্ড ও ১০টি মন্দির ছিল। সঙ্গে ছিল ধ্যানকক্ষ ও অনেক পাঠদান কক্ষ। প্রতিটি ভবনের সামনে ছিল জলাধার ও চিত্তাকর্ষক উদ্যান।

৮০০ বছর পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও চালু করা হয়েছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পুনরায় এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
* প্রথম আলো: সোমা চক্রবর্তী (Soma Chakrabarti), শিক্ষিকা, নিমতা জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content