অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ড. নন্দিনী ভৌমিক
‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি
গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি
এখন সময় হয়েছে কি? সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন’
বিশ্বব্যাপী এ কর্মযজ্ঞে, জীবনের আনন্দযজ্ঞে তিনি মানবধর্মের বাণী সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন বলেই শুরু করেছিলেন তার পথচলা। এ যাত্রা যেন কোনও মরমিয়া সাধিকার অনন্তের পথে আবহমান এক চলার গল্প, সাম্যের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে জনসমুদ্রে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই সাধিকা। কিন্তু নারীর কণ্ঠে যখন প্রথাগত নিয়মতান্ত্রিকতার বিরোধিতা শোনা যায় তখন সেই মুক্তকণ্ঠকে রুদ্ধ করার কোনও প্রয়াসই ক্ষমতাতন্ত্র হাতছাড়া করে না। আধিপত্যকামী পুরুষতন্ত্র যখন নারীকে ‘সেকেন্ড জেন্ডার’ নামক নির্ধারণবাদী এক রাজনৈতিক প্রস্থানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে রাখতে তাদের ব্যক্তিজীবনকে প্রায় নৈর্ব্যক্তিক এক নিয়মযানে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে শক্ত হাতে হাল ধরলেন তিনি, আরম্ভ করলেন গোড়া থেকে।
যাত্রা শুরুর গান—তিনি ভারতবর্ষের এমন এক নারী যিনি একজন মহিলা পুরোহিত হিসেবে হিন্দু বিবাহ পদ্ধতিকে পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে এক অনন্য রূপদান করেছেন। সমগ্র বিবাহ প্রক্রিয়াটিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীটিরও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার যথাযথ ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি তিনি। কথা বলছি হীরালাল মজুমদার স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ড. নন্দিনী ভৌমিককে নিয়ে। ড. নন্দিনী ভৌমিক তাঁর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রাক্তন, প্রয়াত অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালের ছত্রচ্ছায়াতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁর পৌরোহিত্যের যাত্রা। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু, সহপাঠিনী রুমা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের গেস্ট ফ্যাকাল্টিতেও বহুদিন ছিলেন নন্দিনী ভৌমিক। তার নিজস্ব বয়ান অনুযায়ী এই যাত্রার প্রাথমিক আরম্ভটা ছিল খানিকটা এরকম— ‘ব্রেবোর্ন থেকে পাশ করে বেরোনোর পরে বহুদিন দিদির সঙ্গে (অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপাল) আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। দিদি এর আগে ওঁর বৈদিক নিয়মাচার অনুসরণ করে তৈরি করা এই নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্টটিকে অবলম্বন করে বেশ কিছু বিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে ওঁর কিছু প্রাক্তন ছাত্রীও ওঁকে এই কাজে সহায়তা করতেন। এসব আমি কিছু জানতাম না। হঠাৎ করে ২০০৯ সাল নাগাদ আমার সঙ্গে দিদির আবার যোগাযোগ হয় এবং দিদি আমাকে এরকম একটা প্রস্তাব দেন যে কাজটা বহুদিন হল বন্ধ রয়েছে, আমি এবং আমার সহপাঠিনী রুমা, আমরা যদি মনে করি তবে দিদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আবার নতুন করে কাজটা আরম্ভ করতে পারেন। আমাদের আপত্তি করার কোনও জায়গাই ছিল না কারণ ব্রেবোর্নে আমরা এই ভাবধারা মেনেই পড়াশোনা করতাম যে ধর্মীয় যেকোনও আচারই যখন মানুষ পালন করছেন তখন তার যথার্থতা সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণাটুকু থাকাটা কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অতএব খুব শীঘ্রই আমরা দু’জনেই দিদির কাছে দীক্ষা নিই এবং কাজ আরম্ভ করে এভাবেই পথ চলা শুরু।’
অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালের এই স্ক্রিপ্টেই বিয়ে হয় নন্দিনী ভৌমিকের জ্যেষ্ঠা কন্যার। এই নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্টটি ‘পুরোনতুন বৈদিক বিবাহ’ নামে বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে ২০০৯ সালে হয়তো দু’ বছরে একবার ডাক আসত তাদের। অধ্যাপিকার বাবা ছিলেন গেরুয়া বসনধারী ক্রিয়াযোগী সন্ন্যাসী। নন্দিনী ভৌমিক জানালেন, ‘সেইসময়ে বাবা যজ্ঞ করতেন এবং আমি আর রুমা মন্ত্র পড়তাম।’ এর বেশ কয়েকবছর পর প্রয়াত হলেন গৌরী ধর্মপাল। শিক্ষিকার জীবৎকালেই তার অনুমতি নিয়েই স্ক্রিপ্টে কিছু কিছু পরিমার্জনা করেছিলেন অধ্যাপিকা। তার প্রয়াণের পরে দুই বন্ধু মিলে একেবারে নতুনভাবে আরম্ভ করেন এই যাত্রা। গৌরী ধর্মপাল মূলত বৈদিক স্কুলিং-এর অনুসরণেই এই স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিলেন। নন্দিনী ভৌমিক পরবর্তীকালে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যতটা সম্ভব সহজ সরল এবং সহজবোধ্য করে তোলা যায় এই স্ক্রিপ্টটিকে সেই প্রচেষ্টায় রত হলেন। সমস্ত মন্ত্রকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, যেখানে যেখানে মেয়েদের প্রতি অবমাননাজনক কোনও ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে সেই জায়গাগুলি অত্যন্ত সচেতনভাবে বর্জন করে এর পুনর্নির্মাণ করেন। আবেগপূর্ণ কণ্ঠে অধ্যাপিকা বললেন— ‘And it works like a magic আমরা গান ইন্ট্রোডিউস করলাম, সেমন্তীদি ও পৌলমীর মতো দু’জন সংগীতশিল্পীকে আমাদের সঙ্গে নিলাম এবং ‘শুভমস্তু’ নাম দিয়ে আমাদের জার্নি আবার নতুন করে আরম্ভ করলাম এবং নতুন জার্নিটা আমাদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিল। আগে যেখানে বছরে একবার হয়তো আমরা ডাক পেতাম সেখানে এখন সময় দিতে পারি না৷’ এই অভিনব বিবাহ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত মন্ত্রসমূহ ঋকবেদ থেকে গ্রহণ করলেও নন্দিনী ভৌমিক প্রাতিষ্ঠানিক পৌরাণিক স্কুলিং-এর ছত্রচ্ছায়া অত্যন্ত সচেতনভাবে পরিত্যাগ করে মূলত মানবতাবাদ ধারণা অবলম্বন করেই এক সাম্যবাদী ঘরানা হিসাবেই নির্মাণ করেছেন পদ্ধতিকে। তিনি বলছেন— ‘রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী এবং মন্ত্রের মর্মার্থ যদি পাত্রপাত্রী মন থেকে অনুভব করতে পারে তবে হৃদয়ের মিলন ঘটতে বাধ্য।’ যদিও তাঁরা ইদানীংকালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল ইসলামের গানও তাঁরা ব্যবহার করছেন, যেমন গত বছর ছেষট্টি পল্লিতে ‘শুভমস্তু’র প্রথম দুর্গাপুজোতে তাঁরা সন্ধিপুজো আরম্ভ করেছিলেন বিখ্যাত নজরুলগীতি— ‘এল এল এল ওই রণরঙ্গিণী’ দিয়ে। ভাবলেও শান্তি বোধ হয়, দেবী দুর্গার আরাধনায় কবি নজরুলের গানে সন্ধিপুজো আরম্ভ হচ্ছে, এই তো ভারতবর্ষের যথার্থ সংস্কার, এই সমন্বয়ই ভারতের ভিত্তিভূমি। নন্দিনী ভৌমিক এই সমন্বয় প্রসঙ্গেই ব্যক্ত করেছেন তার মনোভাব— ‘শুভমস্তু’ কেবল নারীরাই নয় সকল জাতিবৈষম্যের বিরোধিতা করে। আমাদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হোক, বা বিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানের রিচুয়ালসের সঙ্গে কেবল বাঙালিরা নন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একাত্মতা বোধ করতে পারেন, এই প্যান ইন্ডিয়ানিজম, সর্বজনবোধিতার জায়গায় শুভমস্তুকে নিয়ে যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। আজ সেই উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল।’
নিয়ম নিয়ম এবং নিয়ম ভাঙার গান—প্রথাগত পৌরাণিক ঘরানার পৌরোহিত্যের সঙ্গে ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতির পার্থক্য কতটা? অধ্যাপিকা আমাদের জানালেন যে প্রায় সবটাই অন্যরকম। প্রথমত—শুভমস্তু পদ্ধতিতে ঋকবেদ থেকে মন্ত্র গ্রহণ করেছে এবং বিবাহে অংশগ্রহণকারী পাত্রীটিও পাত্রের সঙ্গে অনবরত মন্ত্র পড়তে থাকে, শপথ গ্রহণ করে। পৌরাণিক নিয়মানুসারে বিবাহে পাত্রীটি কেবল অনুসরণ করে, তার স্বতন্ত্র কোনও ভূমিকা নেই, মন্ত্র উচ্চারণের ক্ষেত্রেও তার তেমন অংশগ্রহণকারিতা নেই। কিন্তু ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতিতে পাত্রীটি সম্পূর্ণরকমভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে, তারে পথ দেখানো হবে না, সে হাত ধরে একসঙ্গে পথ চলবে।’ এমনটাই ‘শুভমস্তু’র নিয়ম। পাশাপাশি বাদবাকি বৈশিষ্ট্যগুলি হল সময়সংক্ষেপ, মেয়ের বাড়ি এবং ছেলের বাড়ির আলাদা আলাদা পুরোহিত নয় একজন পুরোহিত থাকবেন, তিনি উভয়েরই কল্যাণ কামনা করবেন। এছাড়া ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি থেকে বাবা, মা দুজনকেই উপস্থিত থাকতে হবে, পরিবারে যদি কোনও বিধবা মহিলা থেকে থাকেন তবে তাকেও অবশ্যই আসতে হবে। সবাইকে বিবাহ অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বর-কনেকে আশীর্বাদ করতে হবে। এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যেখানে যেখানে মেয়েরা যথার্থ সম্মান পাচ্ছেন না সেই জায়গাগুলি সুন্দরভাবে বর্জন করা হয়েছে যেমন, কন্যাদান করার কোনও নিয়ম ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতিতে নেই।
আমি ভয় করব না, ভয় করব না—ভারতবর্ষ চিরকালই সামন্তবাদী পরিবারতন্ত্র দ্বারা লালিত পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমের অঙ্গুলিহেলনে চলতে অভ্যস্ত, সেখানে একজন মহিলা হিসেবে এই কাজ করাটা কতটা কঠিন ছিল? ‘প্রথম প্রথম তো কেউ মানতেই চাইত না। এমনও হয়েছে যে আমরা বিয়ে দেওয়ার পর আবার প্রথাগতভাব পুরুষ পুরোহিত নিয়ে এসে গোটা সিস্টেমটার পুনরাবৃত্ত ঘটানো হয়েছে। তবে এখন কিন্তু এই চিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এখন অনেক পুরুষ পুরোহিতরাও তাঁদের বাড়ির কাজে আমাদের ডাকেন, আমাদের পরামর্শ নেন, কেউ কেউ তো আমাদের শুভমস্তু পদ্ধতিও অনুসরণ করছেন ইদানীংকালে।’ আশ্বস্তের হাসি হেসে জানালেন নন্দিনী ভৌমিক।
ও মেয়ে তুই আছিস কেমন—একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে কেমন আছে আজকের ভারতীয় নারী? তাকে কি মার্কসবাদের সূত্র মেনে শোষিত জনগণের অংশ হিসাবেই বিচার করা হবে নাকি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে তৃতীয় বিশ্বের নারীর সমস্যাসমূহকে পর্যোলোচনা করতে হবে? উত্তরে স্পষ্টই জানালেন অধ্যাপিকা তার মতামত—’মেয়েরা এখন আরেকটু খারাপ আছে কারণ আগে তারা বাড়িতে থাকত, বাড়ির কাজকর্ম করত, ওইভাবেই তারা তাদের জীবনকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন তো তাকে বাইরে থেকে চাকরি করে ফিরে আবার সেই ঘরের কাজগুলোই করতে হয় এবং সমাজ তার এই পারঙ্গমাতাকে আরও খানিকটা অসহায়তা দান করেছে নারীকে ‘দশভুজা’ শিরোনামে ভূষিত করে। আমি দশভুজা নই। আমারও বিরক্ত লাগে, আমারও ক্লান্তি আসে। আমি আমার দুটো হাত দিয়ে যতটা পারব কাজ করব, বাকিটা আমার স্বামী করবেন।’ তিনি বললেন শোষণও নয় নারীর প্রতি অবমাননা একপ্রকার সামাজিক ব্যাধি, এই ব্যাধির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ‘…’নারী’ বলে পৃথক কোনও সামাজিক ধারণার অন্তর্ভুক্ত আমরা মহিলাদের করতেই চাই না, তারা এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে এমনটাই তো কাম্য।’
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও—যথার্থ কথা, এমনটাই তো কাম্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সেই কবেই তাঁর সৃষ্ট সর্বসেরা চরিত্র নন্দিনীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন— ‘তোমাদের ওই ধৃজদণ্ডের দেবতা, সে কোনওদিনই নরম হবে না। কিন্তু জালের আড়ালের মানুষ কি চিরদিনই জালে বাঁধা থাকবে? যাও যাও যাও। মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে নাম দিয়ে ভোলাবার ব্যবসা তোমার।’ এই ব্যবসাদারদের ফাঁদেই ঘোরতরভাবে আটকা পড়ে গিয়েছে যেন এ দেশ। আবদ্ধ মাতৃভূমি এমন কিছু অগ্রগামী, নারীদের উড়ানেই ফের মুক্ত বাতাস ভরে নেবে ধমনীতে, ঘুচে যাবে সকল ব্যবধান। এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যেদিন নারী, পুরুষ বা হিন্দু কিংবা মুসলমান নন, সমগ্র মানবজাতি একত্রে গাইবে সাম্যবাদের গান।
যাত্রা শুরুর গান—তিনি ভারতবর্ষের এমন এক নারী যিনি একজন মহিলা পুরোহিত হিসেবে হিন্দু বিবাহ পদ্ধতিকে পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে এক অনন্য রূপদান করেছেন। সমগ্র বিবাহ প্রক্রিয়াটিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীটিরও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার যথাযথ ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি তিনি। কথা বলছি হীরালাল মজুমদার স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ড. নন্দিনী ভৌমিককে নিয়ে। ড. নন্দিনী ভৌমিক তাঁর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রাক্তন, প্রয়াত অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালের ছত্রচ্ছায়াতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁর পৌরোহিত্যের যাত্রা। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু, সহপাঠিনী রুমা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের গেস্ট ফ্যাকাল্টিতেও বহুদিন ছিলেন নন্দিনী ভৌমিক। তার নিজস্ব বয়ান অনুযায়ী এই যাত্রার প্রাথমিক আরম্ভটা ছিল খানিকটা এরকম— ‘ব্রেবোর্ন থেকে পাশ করে বেরোনোর পরে বহুদিন দিদির সঙ্গে (অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপাল) আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। দিদি এর আগে ওঁর বৈদিক নিয়মাচার অনুসরণ করে তৈরি করা এই নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্টটিকে অবলম্বন করে বেশ কিছু বিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে ওঁর কিছু প্রাক্তন ছাত্রীও ওঁকে এই কাজে সহায়তা করতেন। এসব আমি কিছু জানতাম না। হঠাৎ করে ২০০৯ সাল নাগাদ আমার সঙ্গে দিদির আবার যোগাযোগ হয় এবং দিদি আমাকে এরকম একটা প্রস্তাব দেন যে কাজটা বহুদিন হল বন্ধ রয়েছে, আমি এবং আমার সহপাঠিনী রুমা, আমরা যদি মনে করি তবে দিদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আবার নতুন করে কাজটা আরম্ভ করতে পারেন। আমাদের আপত্তি করার কোনও জায়গাই ছিল না কারণ ব্রেবোর্নে আমরা এই ভাবধারা মেনেই পড়াশোনা করতাম যে ধর্মীয় যেকোনও আচারই যখন মানুষ পালন করছেন তখন তার যথার্থতা সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণাটুকু থাকাটা কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অতএব খুব শীঘ্রই আমরা দু’জনেই দিদির কাছে দীক্ষা নিই এবং কাজ আরম্ভ করে এভাবেই পথ চলা শুরু।’
অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপালের এই স্ক্রিপ্টেই বিয়ে হয় নন্দিনী ভৌমিকের জ্যেষ্ঠা কন্যার। এই নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্টটি ‘পুরোনতুন বৈদিক বিবাহ’ নামে বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে ২০০৯ সালে হয়তো দু’ বছরে একবার ডাক আসত তাদের। অধ্যাপিকার বাবা ছিলেন গেরুয়া বসনধারী ক্রিয়াযোগী সন্ন্যাসী। নন্দিনী ভৌমিক জানালেন, ‘সেইসময়ে বাবা যজ্ঞ করতেন এবং আমি আর রুমা মন্ত্র পড়তাম।’ এর বেশ কয়েকবছর পর প্রয়াত হলেন গৌরী ধর্মপাল। শিক্ষিকার জীবৎকালেই তার অনুমতি নিয়েই স্ক্রিপ্টে কিছু কিছু পরিমার্জনা করেছিলেন অধ্যাপিকা। তার প্রয়াণের পরে দুই বন্ধু মিলে একেবারে নতুনভাবে আরম্ভ করেন এই যাত্রা। গৌরী ধর্মপাল মূলত বৈদিক স্কুলিং-এর অনুসরণেই এই স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিলেন। নন্দিনী ভৌমিক পরবর্তীকালে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যতটা সম্ভব সহজ সরল এবং সহজবোধ্য করে তোলা যায় এই স্ক্রিপ্টটিকে সেই প্রচেষ্টায় রত হলেন। সমস্ত মন্ত্রকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, যেখানে যেখানে মেয়েদের প্রতি অবমাননাজনক কোনও ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে সেই জায়গাগুলি অত্যন্ত সচেতনভাবে বর্জন করে এর পুনর্নির্মাণ করেন। আবেগপূর্ণ কণ্ঠে অধ্যাপিকা বললেন— ‘And it works like a magic আমরা গান ইন্ট্রোডিউস করলাম, সেমন্তীদি ও পৌলমীর মতো দু’জন সংগীতশিল্পীকে আমাদের সঙ্গে নিলাম এবং ‘শুভমস্তু’ নাম দিয়ে আমাদের জার্নি আবার নতুন করে আরম্ভ করলাম এবং নতুন জার্নিটা আমাদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিল। আগে যেখানে বছরে একবার হয়তো আমরা ডাক পেতাম সেখানে এখন সময় দিতে পারি না৷’ এই অভিনব বিবাহ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত মন্ত্রসমূহ ঋকবেদ থেকে গ্রহণ করলেও নন্দিনী ভৌমিক প্রাতিষ্ঠানিক পৌরাণিক স্কুলিং-এর ছত্রচ্ছায়া অত্যন্ত সচেতনভাবে পরিত্যাগ করে মূলত মানবতাবাদ ধারণা অবলম্বন করেই এক সাম্যবাদী ঘরানা হিসাবেই নির্মাণ করেছেন পদ্ধতিকে। তিনি বলছেন— ‘রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী এবং মন্ত্রের মর্মার্থ যদি পাত্রপাত্রী মন থেকে অনুভব করতে পারে তবে হৃদয়ের মিলন ঘটতে বাধ্য।’ যদিও তাঁরা ইদানীংকালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল ইসলামের গানও তাঁরা ব্যবহার করছেন, যেমন গত বছর ছেষট্টি পল্লিতে ‘শুভমস্তু’র প্রথম দুর্গাপুজোতে তাঁরা সন্ধিপুজো আরম্ভ করেছিলেন বিখ্যাত নজরুলগীতি— ‘এল এল এল ওই রণরঙ্গিণী’ দিয়ে। ভাবলেও শান্তি বোধ হয়, দেবী দুর্গার আরাধনায় কবি নজরুলের গানে সন্ধিপুজো আরম্ভ হচ্ছে, এই তো ভারতবর্ষের যথার্থ সংস্কার, এই সমন্বয়ই ভারতের ভিত্তিভূমি। নন্দিনী ভৌমিক এই সমন্বয় প্রসঙ্গেই ব্যক্ত করেছেন তার মনোভাব— ‘শুভমস্তু’ কেবল নারীরাই নয় সকল জাতিবৈষম্যের বিরোধিতা করে। আমাদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হোক, বা বিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানের রিচুয়ালসের সঙ্গে কেবল বাঙালিরা নন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একাত্মতা বোধ করতে পারেন, এই প্যান ইন্ডিয়ানিজম, সর্বজনবোধিতার জায়গায় শুভমস্তুকে নিয়ে যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। আজ সেই উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল।’
নিয়ম নিয়ম এবং নিয়ম ভাঙার গান—প্রথাগত পৌরাণিক ঘরানার পৌরোহিত্যের সঙ্গে ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতির পার্থক্য কতটা? অধ্যাপিকা আমাদের জানালেন যে প্রায় সবটাই অন্যরকম। প্রথমত—শুভমস্তু পদ্ধতিতে ঋকবেদ থেকে মন্ত্র গ্রহণ করেছে এবং বিবাহে অংশগ্রহণকারী পাত্রীটিও পাত্রের সঙ্গে অনবরত মন্ত্র পড়তে থাকে, শপথ গ্রহণ করে। পৌরাণিক নিয়মানুসারে বিবাহে পাত্রীটি কেবল অনুসরণ করে, তার স্বতন্ত্র কোনও ভূমিকা নেই, মন্ত্র উচ্চারণের ক্ষেত্রেও তার তেমন অংশগ্রহণকারিতা নেই। কিন্তু ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতিতে পাত্রীটি সম্পূর্ণরকমভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে, তারে পথ দেখানো হবে না, সে হাত ধরে একসঙ্গে পথ চলবে।’ এমনটাই ‘শুভমস্তু’র নিয়ম। পাশাপাশি বাদবাকি বৈশিষ্ট্যগুলি হল সময়সংক্ষেপ, মেয়ের বাড়ি এবং ছেলের বাড়ির আলাদা আলাদা পুরোহিত নয় একজন পুরোহিত থাকবেন, তিনি উভয়েরই কল্যাণ কামনা করবেন। এছাড়া ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি থেকে বাবা, মা দুজনকেই উপস্থিত থাকতে হবে, পরিবারে যদি কোনও বিধবা মহিলা থেকে থাকেন তবে তাকেও অবশ্যই আসতে হবে। সবাইকে বিবাহ অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বর-কনেকে আশীর্বাদ করতে হবে। এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যেখানে যেখানে মেয়েরা যথার্থ সম্মান পাচ্ছেন না সেই জায়গাগুলি সুন্দরভাবে বর্জন করা হয়েছে যেমন, কন্যাদান করার কোনও নিয়ম ‘শুভমস্তু’ পদ্ধতিতে নেই।
আমি ভয় করব না, ভয় করব না—ভারতবর্ষ চিরকালই সামন্তবাদী পরিবারতন্ত্র দ্বারা লালিত পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমের অঙ্গুলিহেলনে চলতে অভ্যস্ত, সেখানে একজন মহিলা হিসেবে এই কাজ করাটা কতটা কঠিন ছিল? ‘প্রথম প্রথম তো কেউ মানতেই চাইত না। এমনও হয়েছে যে আমরা বিয়ে দেওয়ার পর আবার প্রথাগতভাব পুরুষ পুরোহিত নিয়ে এসে গোটা সিস্টেমটার পুনরাবৃত্ত ঘটানো হয়েছে। তবে এখন কিন্তু এই চিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এখন অনেক পুরুষ পুরোহিতরাও তাঁদের বাড়ির কাজে আমাদের ডাকেন, আমাদের পরামর্শ নেন, কেউ কেউ তো আমাদের শুভমস্তু পদ্ধতিও অনুসরণ করছেন ইদানীংকালে।’ আশ্বস্তের হাসি হেসে জানালেন নন্দিনী ভৌমিক।
ও মেয়ে তুই আছিস কেমন—একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে কেমন আছে আজকের ভারতীয় নারী? তাকে কি মার্কসবাদের সূত্র মেনে শোষিত জনগণের অংশ হিসাবেই বিচার করা হবে নাকি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে তৃতীয় বিশ্বের নারীর সমস্যাসমূহকে পর্যোলোচনা করতে হবে? উত্তরে স্পষ্টই জানালেন অধ্যাপিকা তার মতামত—’মেয়েরা এখন আরেকটু খারাপ আছে কারণ আগে তারা বাড়িতে থাকত, বাড়ির কাজকর্ম করত, ওইভাবেই তারা তাদের জীবনকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন তো তাকে বাইরে থেকে চাকরি করে ফিরে আবার সেই ঘরের কাজগুলোই করতে হয় এবং সমাজ তার এই পারঙ্গমাতাকে আরও খানিকটা অসহায়তা দান করেছে নারীকে ‘দশভুজা’ শিরোনামে ভূষিত করে। আমি দশভুজা নই। আমারও বিরক্ত লাগে, আমারও ক্লান্তি আসে। আমি আমার দুটো হাত দিয়ে যতটা পারব কাজ করব, বাকিটা আমার স্বামী করবেন।’ তিনি বললেন শোষণও নয় নারীর প্রতি অবমাননা একপ্রকার সামাজিক ব্যাধি, এই ব্যাধির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ‘…’নারী’ বলে পৃথক কোনও সামাজিক ধারণার অন্তর্ভুক্ত আমরা মহিলাদের করতেই চাই না, তারা এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে এমনটাই তো কাম্য।’
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও—যথার্থ কথা, এমনটাই তো কাম্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সেই কবেই তাঁর সৃষ্ট সর্বসেরা চরিত্র নন্দিনীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন— ‘তোমাদের ওই ধৃজদণ্ডের দেবতা, সে কোনওদিনই নরম হবে না। কিন্তু জালের আড়ালের মানুষ কি চিরদিনই জালে বাঁধা থাকবে? যাও যাও যাও। মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে নাম দিয়ে ভোলাবার ব্যবসা তোমার।’ এই ব্যবসাদারদের ফাঁদেই ঘোরতরভাবে আটকা পড়ে গিয়েছে যেন এ দেশ। আবদ্ধ মাতৃভূমি এমন কিছু অগ্রগামী, নারীদের উড়ানেই ফের মুক্ত বাতাস ভরে নেবে ধমনীতে, ঘুচে যাবে সকল ব্যবধান। এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যেদিন নারী, পুরুষ বা হিন্দু কিংবা মুসলমান নন, সমগ্র মানবজাতি একত্রে গাইবে সাম্যবাদের গান।