সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ইন্দুবেন রাজপুত

‘আমি ভয় করব না ভয় করব না
দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’

রবিঠাকুরের এই পংক্তিগুলির মর্মার্থকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে দেখিয়েছেন গুজরাতের ইন্দুবেনে। কোনও প্রতিকূলতাই তাঁকে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো থেকে আটকে রাখতে পারেনি। তাই তো কেবল মনোবলই আজ তাঁকে করে তুলেছে সর্বজয়া। তিনি ইন্দুবেন রাজপুত। এই মুহূর্ত দাঁড়িয়ে গুজরাতের বিখ্যাত খাবার প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘চিলি অ্যান্ড চিজ’-এর মালকিন। স্বামী ও তিন কন্যার সহযোগিতায় পুরোদমে চলছে ইন্দুবেনে মেহসানার এই সংস্থা। কিন্তু এতটাই কি সহজ ছিল প্রথন আরম্ভটা? না, যাত্রাটা এতটা সহজ ছিল না। ভয়ানক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ইন্দুবেনের শিরদাঁড়ার একাধিক হাড়ে চিড় ধরেছিল, স্নায়ুতেও দেখা দিয়েছিল সমস্যা। শরীরের দুরবস্থার জন্য শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছে বহু বছর। চিকিৎসার ঢালাও খরচ, স্বামী সরকারি কেরানি, তিন কন্যার ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ার খরচা, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ইন্দুবেনের। ২০১৭-এর এই ঘটনার আগেই সামান্য সচ্ছলতার মুখ দেখার আশায় কদিন আগেই যাবতীয় সঞ্চয় দিয়ে টেলারিং-এর ব্যবসা আরম্ভ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক লহমায় সবকিছু শেষ! ৪৪ বছরের জীবনে এত অসহায় হয়তো আর কখনও লাগেনি ইন্দুবেনের। অস্ত্রোপচারের পরেও কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। সামান্য পথ হেঁটেই হাঁপিয়ে উঠতেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বামী ওভারটাইম করে বাড়ির পাঁচটা প্রাণীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন কোনওভাবে। এই অসহায়তা থেকেই জন্ম ‘চিলি অ্যান্ড চিজ’-এর। মেয়েদের বু্দ্ধিতেই শিকড় বিস্তার করে এই বড়া পাও ফুড সংস্থা। প্রাথমিকভাবে বড়া পাও দিয়ে আরম্ভ হলেও পরে ইন্দুবালা বার্গার, স্যান্ডউইচ-এও মনোনিবেশ করেন। অবাক লাগে না! কীভাবে গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ইন্দুবেনের হাত ধরে বেড়ে উঠল এই মহারাষ্ট্রিয়ান খাবারের দোকান! না, বর্তমানে গুজরাতের বাসিন্দা হলেও ইন্দুবেনের শৈশব কেটেছে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে। গুজরাতি পরিবারে জন্ম হলেও মায়ের হাতের বড়া পাওয়ের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে ইন্দুবেনের। তাই যখন এই ফুড জয়েন্টের পরিকল্পনা মাথায় এল তখন চলতি স্বাদের বড়া পাও ছেড়ে মায়ের হাতের বড়া পাওই বেছে নিয়েছিলেন ‘চিলি অ্যান্ড চিজ-এর জন্য। ২০১৯-এ ১৬০০০ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে উঠেছিল এই ফুড জয়েন্ট। আর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই অভূতপূর্ব ফলাফল মেলে! এক সপ্তাহে ৪০০০০ টাকা লাভ। অল্পবয়সিদের, মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই দোকানের তুমুল জনপ্রিয়তা, সব মিলিয়ে আলোর মুখ দেখছিলেন ইন্দুবেনে ও তাঁর পরিবার। ৩৯ টাকা থেকে ৭৯-এর মধ্যে ক্রেতারা এই দোকানে পেতেন তাঁদের মনপসন্দমতো বড়া পাও। কিন্তু করোনা আবহে হঠাৎই থমকে যায় সবকিছু। আবার সেই হতাশা! অপেক্ষা করে থাকা।
কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে ইন্দুবেনে ও তার পরিবারকে উদ্ধার করেন অভিনেতা রণবীর সিংহ। খবর পেয়ে আহ্বান জানান তাঁর জনপ্রিয় টিভি শো ‘দ্য বিগ পিকচার’-এ। ফেব্রুয়ারিতে এই শোয়ে আসার পরে গত মাসে অর্থাৎ মার্চ মাসে ইন্দুবেনের লাভ হয়েছে ১.২৫ লাখ টাকা। নেটমাধ্যমে ছেয়ে গিয়েছে ‘চিলি অ্যান্ড চিজ’-এর মাহাত্ম্যে। মাহাত্ম্য দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে ইন্দুবেনের স্পেশাল পুদিনা ও সেজওয়ান বড়া পাও। রণবীর সিং-এর নামকরণ করা ‘স্পেশাল সিম্বা বড়া পাও’ আজ পৌঁছে গিয়েছে ঘরে ঘরে। সকাল ১১টায় দোকান খুললেও যজ্ঞের আয়োজন আরম্ভ হয়ে যায় সকাল থেকেই। বাজার থেকে শাকসবজি নিয়ে এসে কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করা, পুর তৈরি করার জন্য আলু সেদ্ধ করা বা বিভিন্ন রকমের চাটনি তৈরি করার কাজ চলতে থাকে সকাল থেকেই। আপাতত স্বামী ও তিন কন্যাকে নিয়েই চলছে ইন্দুবেনের স্বপ্নের সংস্থা ‘চিলি অ্যান্ড চিজ’। আর এই ভাবেই আমাদের ‘সর্বজয়া’ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যায় এইটুকুই কেবল তাঁকে ঘিরে আমাদের প্রার্থনা।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content