অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী।
‘দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত
কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে
চরের বালিতে তাকে চিকিচিকি মাছের মতন মনে হয়
মনে হয় হৃদয়ের আলো পেলে সে উজ্জ্বল হতো৷
সারারাত ধরে তার পাখাখসা শব্দ আসে কানে
মনে হয় দূর হতে নক্ষত্রের তামাম উইল
উলোট-পালোট হয়ে পড়ে আছে আমার বাগানে৷’
আত্মহনন চিরকাল নির্বাক এক বিমূর্ত অনুভূতির শিকার হিসাবে মনুষ্যহৃদয়কেই নিশানাবদ্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু তাও তো থাকে কিছু বেপরোয়া অভাগা যারা নক্ষত্রের যাবতীয় তামাম উইল ওলোটপালোট হয়ে গেলে অব্যক্ত বাতাসের সুরে আত্মহননের পদধ্বনি শুনে ঘুমোতে যাওয়ার সাহসটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারে। বুদ্ধিবাদ তাদের এক গালভরা নাম দিয়েছে—’এসকেপিস্ট’, কিন্তু এসকেপিস্ট শিরোনামে ঘুমের কিস্যু যায় আসে না, আমাদেরও আসে না। যে আত্মহননে শান্তি খুঁজে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফুসফুসে ভরে নিতে পারব, সেই আত্মহননের কাছে আমরা বারবার মাথানত করব।
এমন কিছু মৃত্যু থাকে যে মৃত্যুকে অপমৃত্যু নামক অপমানজনক শিরোনামের আওতায় ফেলার থেকে আত্মহননের তকমাভুক্ত করে যন্ত্রণামুক্ত না হওয়া গেলেও কিছুটা শান্তি যেন পাওয়া যায়। মানুষটি নিজেই নিজেকে ছুটি দিয়েছেন, তাঁর বিদায় গ্রহণের ক্ষণটি নিজহাতে নির্ধারিত করেছেন, তাঁকে বলপূর্বক কেউ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে যেত বাধ্য করেছে এহেন আপসমূলক সিদ্ধান্তের থেকে যেন পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তটিতেই মহিমা অনেক বেশি। সমালোচকরা যে যা-ই বলুন, যে মৃত্যুর কার্যকারণ জনহস্তে অর্পিত হয়ে যায় কোনও ঘোষণা ব্যতিরেকেই সেই মৃত্যুর এহেন সিদ্ধান্তই সম্মানসূচক বলে মনে হয়। এমনই এক বিদায়মুহূর্তের নাম নাট্যব্যক্তিত্ব, অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ, সাঁকরাইল থেকে পাঁচ মাইল দূরে হীরাপুরে ভেসে এসেছিল কাদামাখা, কচুরিপানা জড়ানো নিথর এক শরীর। ওই অবস্থায় পাওয়া শরীরকে কি আদৌ শরীর বলা যায়? শরীরের যে শাব্দিক ব্যঞ্জনা তার মধ্যে তো প্রাণের অফুরান অভিব্যক্তি সদা স্বতোৎসারিত, সেইজন্যই বোধহয় মৃত মানুষের শরীরকে দেহ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু কেয়া চক্রবর্তীকে দেহ নয় শরীর হিসাবে দেখতেই আমরা আজও অভ্যস্ত। মৃতা কেয়া চক্রবর্তীকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবিতা সিংহ বলেছিলেন—’কেয়ার দেহ পচতে আরম্ভ করেছে৷ অনেকক্ষণ জলে ছিল, এখন রোদে। আমি তার ঈষৎ নীলবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ মুখের বাঁ পাশ সুন্দর৷ ডান পাশ ফুলে ঝুলে পড়েছে৷ সেখানে একটি গভীর দাগ।’ এক গভীর ক্ষত আমাদের দান করে নীরবে চলে গিয়েছিলেন কেয়া চক্রবর্তী। ‘জীবন যে রকম’ ছবিতে এক অন্ধ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তলিয়ে যান গঙ্গার অতলে। দীর্ঘদিন ধরে চাপানউতোর চলেছে তার মৃত্যু নিয়ে। শ্যুটিং চলাকালীন এই দুর্ঘটনা ঘটল কীভাবে এত লোকের মধ্যে? বিন্দুমাত্র নিরাপত্তার ব্যবস্থাও কি ছিল না? লাইফ জ্যাকেট অথবা নিদেনপক্ষে একটা জাল তো ফেলে রাখাই যেত জলে? তবে কি কেউ পরিকল্পনাবশত এই ঘটনা ঘটাল নাকি আত্মহত্যা। নাট্যকার, অভিনেতা উৎপল দত্ত ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন এ ঘটনায়। তাঁর অভিযোগ ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কতিপয় ক্রিমিনালের জন্যই শেষ হয়ে যেতে হল কেয়াকে। এই ঘটনাকে সমগ্র শিল্পীজগতের প্রতীকী আত্মহননের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন উৎপল দত্ত। আজ পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও তাঁর মৃত্যুরহস্যের সমাধানসূত্র পাওয়া যায়নি কোনও, কিন্তু আমরা যারা তাঁর কাজেই তাঁকে পেয়েছি তারা এই কাল্পনিক বিশ্বাসেই যেন শান্তি পাই, তিনি সম্রাজ্ঞীর মতো নিজের সিদ্ধান্তেই ছুটি নিয়েছেন, তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বিশ্বাসে বাঁচা ভয়ানক এ যাপন অসম্ভব, এই মেনে নেওয়া জীবনের পরাজয় যেন।
ছোট থেকেই মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা কেয়া সংসারে দীর্ঘদিন বাবা মায়ের সম্পর্কের এক কালো দিক দেখেই বড় হয়েছেন, সেইজন্যেই বোধহয় শাঁখা-সিঁদুরের মতো পিতৃতান্ত্রিক ব্যঞ্জনাবাহী বৈবাহিক চিহ্নগুলিকে ভরসা করতে পারেননি কখনও। মৃত্যুর সময়ে সিঁদুর পরানো হলে মা বলেছিলেন, ‘এসব তো পছন্দ করে না ও’, বলেছিলেন, ‘এত ফুলের ভারে কষ্ট হবে ওর।’ স্কটিশে ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্রী ছিলেন, পরবর্তীকালে স্কটিশেই অধ্যাপনার চাকরি নেন। কলেজজীবন থেকেই ‘নান্দীকার’-এর হাত ধরে নাট্যজীবন আরম্ভ করেন। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, ‘শের আফগান’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘ভালোমানুষ’ একের পর এক হিট প্রোডাকশন। নিজের দলের ছেলেমেয়েদের বলতেন ‘ভালো মানুষ না হলে নাটক করা যায় না।’ বিশ্বাস করতেন নাটক করতে হবে মতাদর্শের জন্য, মতাদর্শই হবে নাটকের এক এবং একমাত্র হাতিয়ার। পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্মিত কেয়া চক্রবর্তীর বায়োপিক ‘নাটকের মতো’ ছবিতে কেয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা পাওলি দামকে বারবার দেখা গেছে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করতে। বাস্তবজীবনেও কেয়া বারবার বলতে চেয়েছেন প্রলেতারিয়েত-এর কথা। মেকাপ আর মঞ্চ নয় কেবল, একেবারে নিম্নবর্গের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে না পারলে প্রকৃত নাট্যকার হওয়া যায় না, এই বিশ্বাস তাঁর যাপনে বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শঙ্খ ঘোষ স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ‘কেয়ার মৃত্যুর পরদিন সকালে কোনও এক বাড়ির পরিচারিকা তার কর্ত্রী গৃহিণীকে এসে বলেছিল, শুনেছেন, কেয়া চক্রবর্তী মারা গেছেন? একটু অবাক হয়ে গৃহিণী তাকে জিজ্ঞেস করেন: শুনেছি, কিন্তু তোমরা জানলে কী করে? বাঃ আমরা শুনব না? খবর পেয়ে আমাদের বস্তিসুদ্ধ লোক কেঁদে সারা। আমরা যে সব দল বেঁধে ওর ‘ভালোমানুষ’ দেখতে গিয়েছিলাম। উনি তো আমাদের কথা বলতেন। উনি তো আমাদেরই লোক ছিলেন। আমরা জানব না?’
রুদ্রপ্রসাদ-অজিতেশের নান্দীকারকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য দিনের পর দিন জুতোর কোম্পানির বিজ্ঞাপন লিখেছেন। মায়ের গয়না ও নিজের গয়না বিক্রি করে নান্দীকারকে চালিয়েছেন। আবার এইভাবে সংগ্রাম করেই মাকে ঘুরতে নিয়ে গেছেন, মায়ের পেসমেকারের খরচা বহন করেছেন। সংসার ও নাট্যদল চালানোর জন্য জীবনের শেষের দিকে বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেও আরম্ভ করেছিলেন।
এমনই ছিলেন শিল্পী কেয়া চক্রবর্তী। ‘তিন পয়সার পালা’ দেখে মুগ্ধ হয়ে সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ বলেন, ‘সবরকম চরিত্রে আমি কিন্তু তৃপ্তিকে এমন সাবলীল অভিনয় করতে দেখিনি। …কেয়াকে আমি দুই ক্ষেত্রেই দেখেছি, বিশেষ করে বলব, ‘তিন পয়সার পালা’র কথা।’
কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, ‘শরীর, যৌনতা, সতীত্ব এ সব ব্যাপারে তার বোধ অভ্যস্ত সংজ্ঞার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। খুব সহজেই—সাবলীলতার সঙ্গে—পুরুষের সামনে, এমনকী নিজের ছাত্রদের উপস্থিতিতেও, সে শরীর বা ঋতু সংক্রান্ত এমন কথা বলতে পারত, যা কোনও বাঙালি মেয়েই উচ্চারণ করতে পারে না।’
এহেন এক ব্যক্তিত্বের মাত্র ৩৪ বছর বয়সে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভিত নড়ে গিয়েছিল শিল্পীমহলের। অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধা জানাতে সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস মেরিটাইম অ্যাকাডেমির অধ্যাপিকা মধুবণী ঘোষ (Madhubani Ghosh) ফেসবুকে একটি প্রোফাইল শুরু করেছেন অভিনেত্রীর নামে। পাশাপাশি মধুবণী ঘোষ কেয়া চক্রবর্তীকে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামেই চালু করেছেন একটি পুরস্কারের। তৈরি হয়েছে কেয়া চক্রবর্তীর নামে ওয়েবসাইট, যেখানে পাওয়া যাবে তাঁকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন কবি ও লেখকদের কবিতা, বিবিধ প্রকারের রচনা। বাংলা থিয়েটারের জগৎ বিভিন্ন ও বিবিধ রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে বারবার, কিন্তু নাটকের ইতিহাসে কেয়া চক্রবর্তীর অবদান চিরকালীন। গতকাল অর্থাৎ ২৭ মার্চ ছিল ‘বিশ্বনাট্যদিবস’। বিশ্বনাট্যদিবসে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য রাখা রইল নাট্যব্যক্তিত্ব কেয়া চক্রবর্তীর জন্য। তাঁর অবদান নাট্যজগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে
চরের বালিতে তাকে চিকিচিকি মাছের মতন মনে হয়
মনে হয় হৃদয়ের আলো পেলে সে উজ্জ্বল হতো৷
সারারাত ধরে তার পাখাখসা শব্দ আসে কানে
মনে হয় দূর হতে নক্ষত্রের তামাম উইল
উলোট-পালোট হয়ে পড়ে আছে আমার বাগানে৷’
আত্মহনন চিরকাল নির্বাক এক বিমূর্ত অনুভূতির শিকার হিসাবে মনুষ্যহৃদয়কেই নিশানাবদ্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু তাও তো থাকে কিছু বেপরোয়া অভাগা যারা নক্ষত্রের যাবতীয় তামাম উইল ওলোটপালোট হয়ে গেলে অব্যক্ত বাতাসের সুরে আত্মহননের পদধ্বনি শুনে ঘুমোতে যাওয়ার সাহসটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারে। বুদ্ধিবাদ তাদের এক গালভরা নাম দিয়েছে—’এসকেপিস্ট’, কিন্তু এসকেপিস্ট শিরোনামে ঘুমের কিস্যু যায় আসে না, আমাদেরও আসে না। যে আত্মহননে শান্তি খুঁজে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফুসফুসে ভরে নিতে পারব, সেই আত্মহননের কাছে আমরা বারবার মাথানত করব।
এমন কিছু মৃত্যু থাকে যে মৃত্যুকে অপমৃত্যু নামক অপমানজনক শিরোনামের আওতায় ফেলার থেকে আত্মহননের তকমাভুক্ত করে যন্ত্রণামুক্ত না হওয়া গেলেও কিছুটা শান্তি যেন পাওয়া যায়। মানুষটি নিজেই নিজেকে ছুটি দিয়েছেন, তাঁর বিদায় গ্রহণের ক্ষণটি নিজহাতে নির্ধারিত করেছেন, তাঁকে বলপূর্বক কেউ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে যেত বাধ্য করেছে এহেন আপসমূলক সিদ্ধান্তের থেকে যেন পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তটিতেই মহিমা অনেক বেশি। সমালোচকরা যে যা-ই বলুন, যে মৃত্যুর কার্যকারণ জনহস্তে অর্পিত হয়ে যায় কোনও ঘোষণা ব্যতিরেকেই সেই মৃত্যুর এহেন সিদ্ধান্তই সম্মানসূচক বলে মনে হয়। এমনই এক বিদায়মুহূর্তের নাম নাট্যব্যক্তিত্ব, অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ, সাঁকরাইল থেকে পাঁচ মাইল দূরে হীরাপুরে ভেসে এসেছিল কাদামাখা, কচুরিপানা জড়ানো নিথর এক শরীর। ওই অবস্থায় পাওয়া শরীরকে কি আদৌ শরীর বলা যায়? শরীরের যে শাব্দিক ব্যঞ্জনা তার মধ্যে তো প্রাণের অফুরান অভিব্যক্তি সদা স্বতোৎসারিত, সেইজন্যই বোধহয় মৃত মানুষের শরীরকে দেহ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু কেয়া চক্রবর্তীকে দেহ নয় শরীর হিসাবে দেখতেই আমরা আজও অভ্যস্ত। মৃতা কেয়া চক্রবর্তীকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবিতা সিংহ বলেছিলেন—’কেয়ার দেহ পচতে আরম্ভ করেছে৷ অনেকক্ষণ জলে ছিল, এখন রোদে। আমি তার ঈষৎ নীলবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ মুখের বাঁ পাশ সুন্দর৷ ডান পাশ ফুলে ঝুলে পড়েছে৷ সেখানে একটি গভীর দাগ।’ এক গভীর ক্ষত আমাদের দান করে নীরবে চলে গিয়েছিলেন কেয়া চক্রবর্তী। ‘জীবন যে রকম’ ছবিতে এক অন্ধ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তলিয়ে যান গঙ্গার অতলে। দীর্ঘদিন ধরে চাপানউতোর চলেছে তার মৃত্যু নিয়ে। শ্যুটিং চলাকালীন এই দুর্ঘটনা ঘটল কীভাবে এত লোকের মধ্যে? বিন্দুমাত্র নিরাপত্তার ব্যবস্থাও কি ছিল না? লাইফ জ্যাকেট অথবা নিদেনপক্ষে একটা জাল তো ফেলে রাখাই যেত জলে? তবে কি কেউ পরিকল্পনাবশত এই ঘটনা ঘটাল নাকি আত্মহত্যা। নাট্যকার, অভিনেতা উৎপল দত্ত ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন এ ঘটনায়। তাঁর অভিযোগ ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কতিপয় ক্রিমিনালের জন্যই শেষ হয়ে যেতে হল কেয়াকে। এই ঘটনাকে সমগ্র শিল্পীজগতের প্রতীকী আত্মহননের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন উৎপল দত্ত। আজ পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও তাঁর মৃত্যুরহস্যের সমাধানসূত্র পাওয়া যায়নি কোনও, কিন্তু আমরা যারা তাঁর কাজেই তাঁকে পেয়েছি তারা এই কাল্পনিক বিশ্বাসেই যেন শান্তি পাই, তিনি সম্রাজ্ঞীর মতো নিজের সিদ্ধান্তেই ছুটি নিয়েছেন, তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বিশ্বাসে বাঁচা ভয়ানক এ যাপন অসম্ভব, এই মেনে নেওয়া জীবনের পরাজয় যেন।
ছোট থেকেই মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা কেয়া সংসারে দীর্ঘদিন বাবা মায়ের সম্পর্কের এক কালো দিক দেখেই বড় হয়েছেন, সেইজন্যেই বোধহয় শাঁখা-সিঁদুরের মতো পিতৃতান্ত্রিক ব্যঞ্জনাবাহী বৈবাহিক চিহ্নগুলিকে ভরসা করতে পারেননি কখনও। মৃত্যুর সময়ে সিঁদুর পরানো হলে মা বলেছিলেন, ‘এসব তো পছন্দ করে না ও’, বলেছিলেন, ‘এত ফুলের ভারে কষ্ট হবে ওর।’ স্কটিশে ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্রী ছিলেন, পরবর্তীকালে স্কটিশেই অধ্যাপনার চাকরি নেন। কলেজজীবন থেকেই ‘নান্দীকার’-এর হাত ধরে নাট্যজীবন আরম্ভ করেন। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, ‘শের আফগান’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘ভালোমানুষ’ একের পর এক হিট প্রোডাকশন। নিজের দলের ছেলেমেয়েদের বলতেন ‘ভালো মানুষ না হলে নাটক করা যায় না।’ বিশ্বাস করতেন নাটক করতে হবে মতাদর্শের জন্য, মতাদর্শই হবে নাটকের এক এবং একমাত্র হাতিয়ার। পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্মিত কেয়া চক্রবর্তীর বায়োপিক ‘নাটকের মতো’ ছবিতে কেয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা পাওলি দামকে বারবার দেখা গেছে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করতে। বাস্তবজীবনেও কেয়া বারবার বলতে চেয়েছেন প্রলেতারিয়েত-এর কথা। মেকাপ আর মঞ্চ নয় কেবল, একেবারে নিম্নবর্গের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে না পারলে প্রকৃত নাট্যকার হওয়া যায় না, এই বিশ্বাস তাঁর যাপনে বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শঙ্খ ঘোষ স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ‘কেয়ার মৃত্যুর পরদিন সকালে কোনও এক বাড়ির পরিচারিকা তার কর্ত্রী গৃহিণীকে এসে বলেছিল, শুনেছেন, কেয়া চক্রবর্তী মারা গেছেন? একটু অবাক হয়ে গৃহিণী তাকে জিজ্ঞেস করেন: শুনেছি, কিন্তু তোমরা জানলে কী করে? বাঃ আমরা শুনব না? খবর পেয়ে আমাদের বস্তিসুদ্ধ লোক কেঁদে সারা। আমরা যে সব দল বেঁধে ওর ‘ভালোমানুষ’ দেখতে গিয়েছিলাম। উনি তো আমাদের কথা বলতেন। উনি তো আমাদেরই লোক ছিলেন। আমরা জানব না?’
রুদ্রপ্রসাদ-অজিতেশের নান্দীকারকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য দিনের পর দিন জুতোর কোম্পানির বিজ্ঞাপন লিখেছেন। মায়ের গয়না ও নিজের গয়না বিক্রি করে নান্দীকারকে চালিয়েছেন। আবার এইভাবে সংগ্রাম করেই মাকে ঘুরতে নিয়ে গেছেন, মায়ের পেসমেকারের খরচা বহন করেছেন। সংসার ও নাট্যদল চালানোর জন্য জীবনের শেষের দিকে বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেও আরম্ভ করেছিলেন।
এমনই ছিলেন শিল্পী কেয়া চক্রবর্তী। ‘তিন পয়সার পালা’ দেখে মুগ্ধ হয়ে সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ বলেন, ‘সবরকম চরিত্রে আমি কিন্তু তৃপ্তিকে এমন সাবলীল অভিনয় করতে দেখিনি। …কেয়াকে আমি দুই ক্ষেত্রেই দেখেছি, বিশেষ করে বলব, ‘তিন পয়সার পালা’র কথা।’
কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, ‘শরীর, যৌনতা, সতীত্ব এ সব ব্যাপারে তার বোধ অভ্যস্ত সংজ্ঞার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। খুব সহজেই—সাবলীলতার সঙ্গে—পুরুষের সামনে, এমনকী নিজের ছাত্রদের উপস্থিতিতেও, সে শরীর বা ঋতু সংক্রান্ত এমন কথা বলতে পারত, যা কোনও বাঙালি মেয়েই উচ্চারণ করতে পারে না।’
এহেন এক ব্যক্তিত্বের মাত্র ৩৪ বছর বয়সে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভিত নড়ে গিয়েছিল শিল্পীমহলের। অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধা জানাতে সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস মেরিটাইম অ্যাকাডেমির অধ্যাপিকা মধুবণী ঘোষ (Madhubani Ghosh) ফেসবুকে একটি প্রোফাইল শুরু করেছেন অভিনেত্রীর নামে। পাশাপাশি মধুবণী ঘোষ কেয়া চক্রবর্তীকে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামেই চালু করেছেন একটি পুরস্কারের। তৈরি হয়েছে কেয়া চক্রবর্তীর নামে ওয়েবসাইট, যেখানে পাওয়া যাবে তাঁকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন কবি ও লেখকদের কবিতা, বিবিধ প্রকারের রচনা। বাংলা থিয়েটারের জগৎ বিভিন্ন ও বিবিধ রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে বারবার, কিন্তু নাটকের ইতিহাসে কেয়া চক্রবর্তীর অবদান চিরকালীন। গতকাল অর্থাৎ ২৭ মার্চ ছিল ‘বিশ্বনাট্যদিবস’। বিশ্বনাট্যদিবসে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য রাখা রইল নাট্যব্যক্তিত্ব কেয়া চক্রবর্তীর জন্য। তাঁর অবদান নাট্যজগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।