মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


তিনি ও কেএল সায়গল।

ছোটবেলা থেকে যাঁদের বাবা, মা বলে জানতেন তাঁরা ছিলেন রতনচন্দ্র দাস এবং রাজোবালা। বাবা রতন দাস ছিলেন লার্জার দ্যান লাইফ বলতে যা বোঝায় তাই। আয়ের থেকে তাঁর ব্যয় ছিল বেশি। নানাবিধ ব্যয়, রেসের মাঠ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধার লেগেই থাকতো, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও কাননের নিজেকে সুরক্ষিত মনে হতো, কারণ তাঁর বাবার দরাজ গলার পাশাপাশি ছিল খোলা মন। বাইরে যাই হন বাড়িতে ঢুকলে অন্য মানুষ, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতেন মা, দিদি আর কাননকে। কানন মানে কানন দেবী। তিনিই ভারতীয় সিনেমার প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার। ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল, হাওড়ায় তাঁর জন্ম। খুব ছোটবেলায় পড়তেন হাওড়ার সেন্ট অ্যাগনেস কনভেন্ট স্কুলে। নানান বিষয়ের বই ছিল বাড়িতে। খুব তাড়াতাড়ি পড়তে শিখে যান কানন। ওই ছোট বয়সে বইয়ের পাতায় ডুবে যেতেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জানা পড়া চরিত্রগুলোর অনুকরণ করতেন। বাবা রতন দাস মেয়েকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন, গান ছিল মেয়ের প্রাণ। পছন্দের গানে সম্মোহিত হতেন, বিভিন্ন বাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট হতেন।
অভিনয় জীবনের মধ্যগগনে থাকাকালীন ১৯৩৮ সালে আলাপ হল কেএল সায়গলের সঙ্গে। সায়গল ভিন গ্রহের মানুষ ছিলেন, সবার প্রতি মায়া, বাচ্চাদের মতো সরলতা, সবার সঙ্গে কথা বলা চায়। কাননকে বলতেন ‘বহেনজি’। তিনি আর কানন দেবী যেকোনও গান সঙ্গত ছাড়া সুরে গাইতে পারতেন। সায়গল তাঁকে শিখিয়েছিলেন নির্ভয়ে গান গাইতে। গান থেকে গানে, রাগ থেকে রাগে, ভাব থেকে ভাবে অনায়াসে যেতে পারতেন সায়গল সাহেব, অথচ কোনও প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। তাঁরা জানতেন নিজেদের গান নিজেদেরই গাইতে হবে। একে তো সাইলেন্ট ছবির জমানা শেষ করে সবাই টকিতে পৌঁছেছেন, তার ওপর গান। অনবদ্য দক্ষতায় দু’জনে গাইলেন ‘লচমি মুরত দরশ দিখায়ে’, ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়’, ‘ডোলে হৃদয় কি নইয়া’।

জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে কঠিন রোগে কানন বাবাকে হারালেন। বাবার হাত ধরেই পাড়ার পুজো থেকে সার্কাস থেকে যাত্রা, থিয়েটার, নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া; নানান আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্র তখন কলকাতা। বাবা চলে গেলেন, কাননের কলকাতায় যেন অন্ধকার নামলো। বাবার চিকিৎসায় নিঃস্ব মা, প্রচুর ঋণের বোঝা, আত্মীয়-স্বজনের নিরন্তর গঞ্জনা থেকে বুঝলেন তাঁর বাবা-মায়ের কোনওদিন বিয়েই হয়নি। মা ও মেয়ে নিরাশ্রয় হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। কলকাতায় জায়গা হবে না বুঝে তাঁরা চন্দননগরে দিদি অমিয়ার বাড়ি গেলেন। অমিয়া বিয়ের পর ভিন্ন মানুষ। কানন এবং রাজোবালাকে দেখে জ্বলে উঠলেন। প্রথমেই পরিচারিকাদের ছাড়িয়ে দিলেন। শুরু হল মা ও মেয়ের কঠিন জীবন। দিনরাত ওই বাড়ির নানাবিধ কাজ তার সঙ্গে অপমান, অসম্মান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর একবেলা খেতে পাওয়া। মায়ের অসম্মান চরমে পৌঁছলে সাত বছরের মেয়ে হাত ধরে টানতে টানতে নিজের মাকে ওই বাড়ি থেকে বের করেছিলেন। দু’জনে আবার চড়ে বসলেন হাওড়াগামী ট্রেনে। মাথায় একটাই চিন্তা কোথায় যাবেন, কী করবেন?
আরও পড়ুন:

দশভুজা: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪০: দুর্বল বা অসহায়রা একত্র হলে তাঁরাই অজেয় হয়ে ওঠেন

সাল ১৯২৬, বয়স তখন দশ, চোখে পড়লেন সেই সময়ের ছোটখাট রোলে অভিনয় করা তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি তাঁকে নিয়ে গেলেন ইন্দ্রপুরী স্টুডিও (তখন ম্যাডেন থিয়েটারের অধীনে, নামে ছিল জ্যোতি স্টুডিও)। অতি বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন কাটালেও তাঁর পৃথক সৌন্দর্য সকলের চোখে পড়তো। টানা টানা চোখ, মুখ ও নাকের সর্বভারতীয় গড়ন; অডিশন দিলেন নির্বাক ছবির জন্য। মনোনিত হলেন ‘জয়দেব’ (১৯২৬) ও ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯২৭) ছবিতে ছোট রোলে, তখন তিনি কানন বালা। ‘জয়দেব’-এ রাধা এবং কৃষ্ণ উভয় ভূমিকাতেই অভিনয় করলেন। অনেক হাত ঘুরে মাসের শেষে টাকা এসে পৌঁছত হাতে। তাতেই আনন্দ। তাঁর মা রাজোবালাকে আর পরিচারিকার কাজ করতে হতো না, দশ বছরের মেয়ে নিজের সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। চন্দননগর থেকে কলকাতায় আসার পর অন্ধগলিতে স্থান হয় দু’জনের।

অভিনেতা, পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ।

কলকাতার সেই সব অঞ্চলে তখন কোন বাড়িতে বারবনিতারা থাকে আর কোন বাড়িতে গৃহস্থরা, বোঝার উপায় থাকতো না। গৃহস্থরা বাড়ির বাইরে হোর্ডিং টাঙাতো ‘গৃহস্থদের থাকার জায়গা’। সেই ছোট বয়স থেকে তথাকথিত ‘খারাপ’ মেয়েমানুষদের দালাল, তাদের খদ্দের, নারী পুরুষের অন্যরকম সম্পর্ক, তাঁর বয়সি বাচ্চা মেয়েদেরও ছাড় নেই। দেখতে দেখতে তাঁর বড় হওয়া, বিকেল হলে পাড়ার ভোলাদার কাছে ভক্তিগীতি শেখা আর গাওয়াতে ছিল মনের আরাম। প্রতিবেশী জনৈকা আশ্চর্যময়ীর ভালোবাসা ভরিয়ে রাখতো। প্রথম রোজগারের টাকা থেকে তাঁকে শাড়ি কিনে দেন। অজানা কারণে কানন বালা ১৯২৮-৩০ পর্যন্ত কোনও অভিনয় করলেন না। কিন্তু তাঁর গান শেখা বন্ধ হল না। সিনিয়র সহকর্মী ও সুরকার হীরেন বসু, কথাকার ধীরেন দাস এবং স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে সেই সময় তিনি তাঁর জীবনের প্রথম রেকর্ডিংগুলো করছিলেন কখনও এইচএমভি, কখনও মেগাফোন, কখনও কলম্বিয়া থেকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

হে নূতন…

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৬: লিঙ্গ পরিচিতিতে খাদ্যাভ্যাসের রাজনীতি

ইতিহাস কথা কও: পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

গান, নাচ থেকে অভিনয় সবই নিষিদ্ধ তখন ভদ্র বাড়ির মেয়েদের। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধীরেন্দ্রনাথ নাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দাদাসাহেব ফালকে তাঁদের পরিবারের মেয়েদের নিজস্ব পরিসরে অভিনয় করাতেন। কিন্তু কানন ছোট থেকেই অন্য ধারার মানুষ, দুর্ভাগ্যকে অতিক্রম করে কি করে নিজের কাজকে আরও পরিশীলিত, সুশিক্ষিত করা যায় সবসময় সেই চিন্তা। সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ তাঁর কাছে তখন স্বর্গ পাওয়ার মতো। দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা।

ম্যাডান থিয়েটারের প্রযোজনায় অভিনয় করলেন ‘ঋষির প্রেম’ (১৯৩১), ‘জোর বরাত’ (১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘প্রহ্লাদে’ (১৯৩২)। অভিনয় জীবনের পুরোটাই কাজ করে গিয়েছেন কোনও না কোনও প্রডাকশন হাউজের হয়ে মাস মাইনের ভিত্তিতে। যেমন, রাধা ফিল্মসের ১৯৩৩-১৯৩৬, নিউ থিয়েটারর্সে ১৯৩৭-১৯৪১, এমপি প্রডাকশনসে ১৯৪২-১৯৪৮ এবং নিজের শ্রীমতী পিকচার্সে ১৯৪৯-১৯৬৫ কাজ করেন। ১৯২৬- ১৯৩৫ এই সময় সবচেয়ে বেশি কাজ করেন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জয়দেব’, ‘ঋষির প্রেম’, ‘জোর বরাত’, ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘কণ্ঠহার’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’। এই জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নল দময়ন্তী’ (১৯২০) এবং ‘রামায়ণে’র (১৯২১) পরিচালক হিসেবে সেই সময় ভারত বিখ্যাত ছিলেন। তিনিই প্রথম কাননকে সেটের নিয়মানুবর্তিতা শেখান, শেখান চরিত্রের প্রয়োজনে ঘনিষ্ঠ অভিনয়ের প্রয়োজনীয়তা। ‘জোর বরাত’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘খুনী কৌন’ এবং ‘মা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সাইলেন্ট ছবির চাইল্ড আর্টিস্ট থেকে ক্রমশ টকির সফল অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না, অথচ সহ অভিনেতারা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬০: একটু বসো চলে যেও না…

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

কেএল সায়গল, প্রমথেশ বড়ুয়া, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, পৃথ্বিরাজ কাপুর, অশোক কুমারের মতো বিশিষ্ট অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয়। বাড়িতেই মাস্টারমশাই আসতে শুরু করলেন। পড়াতে লাগলেন রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি। নানাবিধ বই পড়া অন্যতম নেশায় দাঁড়ালো। সহ গায়িকা আঙ্গুর বালা বলেছিলেন, ‘কানন ছিল সবার থেকে আলাদা। স্টুডিও পাড়ার সব মেয়েরা যখন গসিপে ব্যস্ত থাকতো, কানন তখন গাছের তলায় বসে একমনে বই পড়তো’। আর গান মানে তো গুরু আল্লা রাখা, অনাদি দস্তিদার, পঙ্কজ মল্লিক, উস্তাদ আলি আকবর, ধীরেন মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী ও রায় চাঁদ বড়ালের কাছে শেখা। আল্লা রাখা তাঁকে বলতেন, ‘বেটি, আপ আচ্ছি তরহা রিয়াজ করিয়ে, দেখোগে সারি হিন্দুস্তান মে কিতনি ইজ্জত হোগি…..’ পণ্ডিত রবিশঙ্করেরও ব্যক্তিগত ভালোলাগা ছিল তাঁর গায়কীর প্রতি। বিখ্যাত সুরকার রায় চাঁদ বড়াল তাঁকে হিন্দি, উর্দুর যথাযথ উচ্চারণ শিখিয়েছিলেন।

যৌবনে।

‘শ্রী গৌরাঙ্গ’, ‘চার দরবেশ’ এবং ‘মনোময়ী গার্লস স্কুলে’র সাফল্যের পর তাঁকে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সবার হৃদয়ে তিনি, ফ্যাশন স্টেটমেন্টেও তিনি। ১৯৩৬-১৯৪১ নিউ থিয়েটারর্সে থাকাকালীন সেই বছরগুলো ছিল তাঁর অভিনেত্রী জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যানার তখন নিউ থিয়েটারর্স। তাদের ছবি মানেই তখন দ্বিভাষিক, হিন্দি অথবা উর্দু এবং বাংলা। সেই সব ছবির গানও তখন অবাঙালি বলয়ে খুব জনপ্রিয়। দেবকী বসুর ‘বিদ্যাপতি’ এবং প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ (১৯৩৭) কাননকে দেবীকে সর্বভারতীয় স্টার বানায়। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তি’ ছবির নামকরণ করেন। সেই প্রথম শর্তসাপেক্ষে তাঁর গান ছবিতে ব্যবহৃত হয়। তিনি শর্ত দেন কাননকে গাইতে হবে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’। পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া, সহ অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তাঁর অভিনয় এই সময় তাঁকে সত্যিই মুক্তি দেয়। তাঁর স্থায়ী আসন গড়ে দেয় মানুষের মনে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

‘মুক্তি’ রিলিজ করার কিছু বছর আগে খুব নাটকীয় ভাবে তাঁর পরিচয় হয় ব্রাহ্ম সমাজের কট্টর সমর্থক ও তৎকালীন সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রের সঙ্গে। পুরুষ প্রধান ইন্ডাস্ট্রিতে দাপুটে প্রযোজক, পরিচালক, সহ অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতে অভ্যস্ত কানন সেই প্রথম মনের সাড়া পেলেন। অশোক মৈত্রের বিদ্যাবত্তা ছিল ঈর্ষণীয়। হিন্দু স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড হয়ে তিনি কিছুদিন শান্তিনিকেতনেও পড়াশোনা করেন। এমনিতেই তাঁর মনে কাননের জন্য বিশেষ জায়গা ছিল, তার ওপর দু’জনের পরিচয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হল। সেই প্রথম নায়িকা ভালোবাসার পরিবর্তে ভালোবাসা পেলেন। উচ্চবিত্ত মহলে তো ওঠাবসা ছিলই কিন্তু সেই প্রথম উচ্চ মেধামহলে যাতায়াত শুরু হল। অশোকের বন্ধুরা তাঁর বন্ধু হলেন। তাঁর মা কুসুমকুমারী দেবী, বোন রানি মহালানোবিশ ও তাঁর স্বামী প্রশান্তচন্দ্র মহালানোবিশ (বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক) সকলে কাননকে সাদরে গ্রহণ করলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন হেরম্ব চন্দ্র স্বয়ং। সিনেমার গায়িকা-অভিনেত্রী হবেন তাঁর বাড়ির বউ!

মুক্তি ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর ১৯৪০ সালে অশোক মৈত্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। হেরম্বচন্দ্র তার আগেই প্রয়াত হন। দুটি হৃদয়ের সুন্দর অভিপ্রায় থাকলেও তখনকার রক্ষণশীল কলকাতার কঠোর সমালোচনা সেই বিয়েকে সফল হতে দেয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও সেই বিয়েতে উপহার পাঠানোর জন্য খুব বেশি সমালোচিত হতে হয়। কারণ একটাই কানন নায়িকা, ভারতবর্ষ জুড়ে তাঁর একটাই পরিচয় তিনি গায়িকা ও নায়িকা। খারাপ কথার চাষ হতে লাগলো। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনো, বারান্দায় দাঁড়ানো একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। অশোক মৈত্রের মতো প্রগতিশীল মানুষ যে তাঁকে বিয়ের পর অভিনয় ছাড়তে বলবেন তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, কিন্তু হল তাই। ধারাবাহিক অবসাদে ডুবলেন কানন। দুঃখে, অভিমানে একদিন বসলেন অশোকের দেওয়া সবচেয়ে দামী ও ভালো কাঞ্চিপুরম সিল্ক আর বেনারস থেকে আনা শাড়িগুলো কাঁচি দিয়ে কাটতে, তারপর সম্বিত ফিরে পেলেন। দুঃখ, যন্ত্রণা তো এই প্রথম নয়, সবই তো কেটে গিয়েছে। নিজেকে বোঝালেন, এই পর্বও কেটে যাবে, কিন্তু কীভাবে নিজেও জানতেন না।—চলবে

ঋণ: মেখলা সেনগুপ্ত, সোমা ভট্টাচার্য, বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে।
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাস। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content