সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী, জন্মগতসূত্রে ভারতীয়, লেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ী চিরকাল তার লেখনীর মধ্য দিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তার শিকড়ের অস্তিত্বকে। আর সেই সন্ধান করতে করতেই তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে তৈরি করেছেন এক বিশ্ব সংযোগসূত্র। আমাদের ‘আমার উড়ান’-এ আজ এই প্রবাসী লেখিকার বিশ্ব সংযোগ সূত্রের চলনটিকেই খানিক ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা।

যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাৎ সব বাস্তুহীন৷
পুনর্বাসনের কাহিনি বদলে বদলে যায় মানচিত্রগত রাজনৈতিক তাৎপর্যের নিরিখে, কিন্তু পুনর্বাসিত মানুষদের গোত্র কিন্তু দেশ-কাল-ভেদে একই থেকে যায়। রাষ্ট্রীয় কূটনীতির প্রভাবে যখন কোনও দেশের মানচিত্রের ব্যবচ্ছেদ করা হয় তখন ব্যক্তি মানুষের দেশের সংজ্ঞা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগে বদলে যায়, মানুষ বাধ্য হন বদলাতে। এই চেতনাগত বিচ্ছিন্নতার বোধকে সঙ্গে নিয়ে তাকে চলতে হয় আজীবন। ঠিক তেমনই প্রবাস ও স্বদেশের ধারণাগত বিচ্ছিন্নতাবোধও ব্যক্তি মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মানসিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমন এক অস্থিরতাকে অবলম্বন করে, বিচ্ছিন্নতার কাতরতাকে আশ্রয় করেই কলম ধরেছিলেন ঝুম্পা লাহিড়ী। জন্মসূত্রে তিনি ভারতীয়, বেড়ে উঠেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। তাঁর বাবা কলকাতা থেকে ওদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে যাওয়া প্রথম দম্পতি। যে মানুষের কখনও নিজের শিকড় তৈরি হয় না, সেই মানুষ ভাসমান বাসিন্দার মতো এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে কেবল ভেসে ভেসে তার শিকড় খুঁজে ফেরে, কিন্তু নোঙর ফেলা হয় না তার কোথাও শেষমেশ। এই প্রবহমানতাই তাকে প্রবৃত্ত করে আসা যাওয়ার মাঝে থমকে থাকা নিজের আত্মপরিচয়ের সংকটকে টুকরো টুকরো চিত্রকল্পের সংযোগে শাব্দিক ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে। বাংলা তার পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত ভাষা, ইংরেজিতে তিনি ছেলেবেলা থেকে লেখাপড়া করেছেন। বাংলা লিখতে পারেন না, কিন্তু, বলতে পারেন, বুঝতে পারে কিন্তু আত্মস্থ করতে না পারার ভাষার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেন ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে, কার্যত এ ছাড়া তার আর উপায় নেই কোনও। হয়তো সেই অপারগতাই তাকে ভাষা থেকে ভাষান্তরে তার স্বদেশের বোধকে খুঁজে বেড়াতে প্রবৃত্ত করে। মাঝে বহুদিন ঝুম্পা ইতালির রাজধানী রোমে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি ইতালীয় ভাষায় লিখতে ও কথা বলার চেষ্টা করতেন। এইভাবে ধীরে ধীরে আরম্ভ করলেন ইতালীয় ভাষায় লিখতে, কিন্তু এখানেও শেকড় প্রোথিত করলেন। তার কাছে ছিল তার বাবা-মায়ের ভাষা, তাদের স্বপ্ন দেখার ভাষা অর্ধ অংশটুকু আর ছিল যে ভাষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখিকা পেয়েছেন সেই ভাষা। এর মধ্যে কোন ভাষাটা তার স্বপ্ন দেখার ভাষা? কোন ভাষার দ্যোতনায় নিহিত রয়েছে তার স্বদেশের ধারণা? এই আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে তৈরি হওয়া যন্ত্রণাই তাকে তার লেখনীর মধ্যে দিয়ে প্রবাসজীবনের এই সামগ্রিক যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত রেখেছে আজীবন। এক শৈল্পিক জীবনবোধের আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে ব্যক্তি মানুষের চেতনায় তার স্বদেশের তাৎপর্য।

লেখিকা কখনও ভাষার থেকে দেশকে আলাদা করে দেখতে পারেননি, আর সেই কারণে তার প্রতিটি রচনাতেই তার নিজস্ব ভাষিক চেতনার মানচিত্রে স্বদেশের সন্ধান করার যাত্রার ইতিবৃত্তটুকু উঠে এসেছে। ঝুম্পা লাহিড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য নেমসেক’। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোগোলের মধ্যে যেন লেখিকার ব্যক্তিগত আত্মপরিচয় সংকটের ছায়া পরিবর্তমান। ভারতীয় পরিচয়ের বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় গোগোল। তাই তার ভালো নাম নিখিলের বদলে ডাক নামটিকেই জীবনে প্রাধান্য দিতে চায় বেশি। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা তাকে আদতে শান্তি দেয় কি? নামের দ্যোতনাতেই এই উভয়সংকটের এক ভয়াবহ টানাপোড়েনের গল্প বলে ‘দ্য নেমসেক’। লেখিকার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য নেমসেক’ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, কিন্তু তার লেখিকাজীবনের যাত্রা আরম্ভ হয় ছোট ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালডিস’ দিয়ে। এটির প্রকাশকাল ১৯৯৯। সম্পাদনা করেছেন ‘নোবডি’স বিজনেস’

‘ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম’ ‘ইয়ার্স এন্ড’এর মতো একাধিক ছোট গল্পসংকলন। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। ২০০০ সালে ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালডিস-এর জন্য পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। ২০০২ সালে পেয়েছেন ‘গুগেনহেম ফেলোশিপ’। ওই একই বছরে তার ছোটগল্প ‘নোবডিস বিজনেস’ পেয়েছে সেরা আমেরিকান ছোটগল্পের সম্মান। এছাড়া পেয়েছেন আনএকাস্টমড আর্থ-এর জন্য ২০০৯ সালে এশিয়ান আমেরিকান সাহিত্য পুরস্কার, ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করা বিদেশি কথাসাহিত্যের জন্য গ্রেগর ফন রেজ্জরি পুরস্কার, ২০১৪ সালে দ্য লোল্যান্ড-এর জন্য ডিএসসি পুরস্কার, ২০১৪ সালে জাতীয় মানবিক পদক ও ২০১৭ সালে প্রাপ্ত মালামুদ পুরস্কারের মতো একাধিক পুরস্কার এবং সম্মাননা।

‘শুধু আসা যাওয়া, শুধু স্রোতে ভাষা’ এই আসা-যাওয়ার মাঝেই শব্দ থেকে শব্দান্তরে খুঁজতে চেয়েছেন ঝুম্পা নিজের দেশ-কালের সীমানাহীন পরিসরকে। ব্যক্তিগতজীবনেও পেয়েছেন তেমনই সাহচর্য। ঝুম্পার স্বামী আলবের্তো ভুরভুলিয়াসের সঙ্গে যখন তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন আলবের্তো ঝুম্পাকে বলেছিলেন—‘পৃথিবীর বহু দেশে আমি বড় হয়েছি। আমি জানি না আমি কোথাকার। কিন্তু আমি, আমার মা-বাবা-ভাই-বোন, আমরাই একটা ছোট দেশ। ঠিক এমন এক পৃথিবীর সঙ্গেই তো ঝুম্পাও চিরকাল এদেশ-ওদেশের তথা মহাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ব্যক্তি হিসাবে এক সেতুবন্ধ রচনা করতে চেয়েছেন আজীবন তার লেখনীর মাধ্যমে। মানববন্ধনের এই অটুট অচ্ছেদ্য সংযোগই তো আমৃত্যু চেয়ে এসেছেন বিশ্বকবি। ইংরাজি ভাষাতে হলেও প্রবাসের বুকে এক অন্য ভারতীয়তাকে আবিষ্কার করার যে প্রচেষ্টা ঝুম্পা এ যাবৎকাল ধরে করে চলেছেন তার জন্য তাঁকে আমারা কুর্নিশ জানাই। লেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ী ও ব্যক্তি ঝুম্পা লাহিড়ীর এই উড়ান আমাদের এইভাবেই সমৃদ্ধ করতে থাকুক এই ভরসাতেই আমরা বারবার বলে যাব—
‘সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন৷’

Skip to content