বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


রাহেলা খাতুন বেগ।

‘মুক্ত করো ভয়, নিজের পর করিতে ভর না রেখো সংশয়’—এ গান লেখার নেপথ্য কাহিনি বেশ মজার। শান্তিনিকেতনে মেয়েদের জুজুৎসু শেখাতে মাস্টারমশাই এসেছেন। মেয়েরা সঙ্কোচে কুস্তির জন্য এগোতে দ্বিধাগ্রস্ত। সে পরিপ্রেক্ষিতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গান রচনা। যে গান, স্থান-কাল-পাত্র ছাপিয়ে সর্বকালীন ও সর্বজনের জন্য প্রযোজ্য। গুরুদেব যে মন্ত্র দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সেই মন্ত্রবলে আপন শক্তিতে ভরসা রেখে মেয়েরা নতুন নতুন পথের দিশারী হয়ে উঠছে।
উঠেছে বলাটা সঠিক নয়। কারণ সর্বকালেই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নির্ভীক মহিলা ছিলেন। মনে পড়ে গেল মহাশ্বেতা দেবীর সাদা দিদিমার কথা। ওঁর মায়ের মাতামহী। তিনি তখন বৌ-মানুষ। ঘটি নিয়ে শীতের বিকেলে শৌচাগারে গিয়েছেন। “ঝাঁপের বাইরে এসে বসলো এক বাঘ। সাদা দিদিমা বাঘের গন্ধে ভয়ে আটাশ।…কাকে ডাকেন, কি করেন, উঠে দাঁড়িয়ে জল বোঝাই পিতলের ঘটি দু’ হাতে তুলে বাঘের মাথায় মারলেন। বাঘ ও ঘাবড়ে গিয়ে কেন যেন লম্বা ছুট দিল।” স্মৃতিকথা সংগ্রহে তাঁদের পরিবারের এমন বেশ কিছু মহিলার গল্প আছে। আরও কত না জানি এমন মহিলা আছেন। ব্যক্তিত্বময়ী, নির্ভীক, নিজের আলোতে আলোকিত। লোকের অগোচরে কত কি করে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রীপুজো

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

কিছু মহিলার কথা লিপিবদ্ধ। আবার কিছু বিস্মৃতির অতলে। আজকের কথা নয়। পঞ্চাশ ষাট বছর আগের তিন কন্যার ঘটনা বলার জন্য এ গৌরচন্দ্রিকা। তিন ভিন্নধর্মী মহিলা। হিন্দু মুসলমান, খ্রিস্টান। সমাজসেবায় নিবেদিত প্রাণ। কমিউনিটি হেলথে কাজ করতেন। উচ্চপদে। গ্রামের মানুষকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সন্মন্ধে সচেতন করাই যাদের ব্রত। প্রথম জন মিস রাহেলা খাতুন বেগ। ছোট থেকেই লক্ষ্য স্থির। মানুষের সেবা। নার্সিংয়ের ডিপ্লোমা নিয়ে দেশ বিদেশের ট্রেনিং ও পুরস্কার ঝুলিতে নিয়ে প্রথমে সিঙ্গুরে ট্রেনিং সেন্টারে হেলথ ভিজিটর ও পরে সিঙ্গুরে হেলথ স্কুলে ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশ বছর জনস্বাস্থ্য দপ্তরে কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। ওঁর সঙ্গে থাকতেন সিঙ্গুরের গোলাপমহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। বনলতা খান। তিনিও ভিন্নধর্মী। খ্রিস্টান। এরা দু’জন বোঝানোর চেষ্টা করতেন বাড়ির লোকদের। মেয়েদের লেখাপড়া করতে স্কুলে পাঠাতে অনুরোধ করতেন। মা ও শিশুর যত্ন শেখাতেন। সস্তায় পুষ্টিকর খাবার করা শেখাতেন। অন্য ধর্মের বলে গ্রামের হিন্দু বাড়ির লোকেরা খুব সহজে এদের গ্রহণ করতে পারতেন না। ঘরে ঢুকতে পারতেন না। এমনও শুনলাম যে, উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলে ফিরছেন, খানিক দূরে গিয়ে পিছন ফিরে দেখেন বাড়ির লোক উঠোনে গোবর ছড়া দিয়ে শুদ্ধ করছে। তবু থেমে থাকেননি। যতদিন ছিলেন, দরিদ্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের আলো দেখানোর প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন। গ্রামের লোকেরা বেগকে বলতেন বড়মা।

গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই বড়মা বুকে টেনে নিয়েছিলেন তাঁর এক সহকর্মীকে। হিন্দু, ব্রাহ্মন বাড়ির মেয়ে। গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের সখ্য একসঙ্গে থাকতে থাকতে গভীর হয়। সঙ্গে সিঙ্গুর হেলথ স্কুলের প্রিন্সিপাল জয়েস বিশ্বাসও ছিলেন।

এক আদর্শের সূত্রে গাঁথা হল তিন কন্যার জীবন। মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান। কেউই বিয়ে করেননি। কল্যাণীতে বাড়ি করে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। জয়েস বিশ্বাস ছিলেন ডাক্তার। দেশ-বিদেশে যোগাযোগ ছিল। এদের কাজের অনুপ্রেরণা দিতেন এবং নতুন নতুন ভাবে মানুষকে সেবার পরিকল্পনা বানাতেন। প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে এমন অন্যরকম নারীর জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ড খুব বিরল। তিন ধর্মের অবিবাহিত তিন কন্যা চমৎকার এক দৃষ্টান্তমূলক জীবন কাটিয়েছেন। হিসেব ছিল কী কী কাজ করা গেল তাই নিয়ে। কারও ধর্ম নিয়ে নয়। ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা ছিল সমাজের কিছু মানুষের।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

গায়ত্রীদেবীর মুখে শোনা, রাহেলা খাতুন বেগ মারা যাবার পর তার মৃতদেহ ছুঁতে তাকে বাধা দিয়েছিলেন একজন। গায়ত্রীদেবী হিন্দু তাই। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি কারী ধর্মকে অনায়াসে উপেক্ষা করতে পেরেছেন এ তিন কন্যা। তাদের সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন পরিবারের লোকেরা। বিশেষত বাবা মা। রাহেলা বেগ-এর বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশে। তাঁর বাবাই তাঁকে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তা করেন। ভারতে রাহেলার কোনও আত্মীয়-পরিজন ছিল না।

গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা রাহেলার সঙ্গে কথা বলে অভিভূত হন। বেগ অসুস্থ হলে নিজের মেয়েকে বলেন তাঁর দেখাশুনা করতে। নিজের মেয়েকে ওঁর সঙ্গে থাকতে অনুপ্রাণিত করেন। প্রথাভাঙ্গা এ আচরণের কথা জেনে খুব বিস্মিত হলাম। ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা। তিনি তাঁর মেয়েকে বলছেন অন্য ধর্মের মহিলাকে সেবা করতে। মানবিকতার এ জয়গাথা বিরল। শুনেছি গ্রামের এক হিন্দু মহিলা শিবরাত্রি উপবাস ভাঙতেন মিস বেগকে প্রসাদ খাইয়ে। প্রথা ভেঙে, ব্রাহ্মণ ভোজন না করিয়ে। এমন প্রথা ভাঙার কথা কোথায় কার জীবনে লুকিয়ে আছে আমরা কেউ জানি না।

জয়েস বিশ্বাস।

এদের বাড়িতে কোনও পুজো পাঠ হতো না। ঘরের দেওয়ালে আছে যিশুর ছবি, মা টেরেজার ছবি, মা কালীর ছবি। রাহেলা তাঁর শেষ জীবনে সেবা পেয়েছেন গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে। পরম মমতায় তাঁর সবরকম দেখাশোনা করেছেন তিনি। খাইয়ে দেওয়া, পরিষ্কার করা সব। যে কর্মময় জীবনের শিখা জ্বলেছিল এতবছর আগে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গায়ত্রী। অন্য দু’জন এখন স্বর্গগত। গায়ত্রীদেবী নিজেও এ কর্মযজ্ঞে সামিল ছিলেন। এখনও চেষ্টা করেন সেই কাজের অনুপ্রেরণা তাঁর ছাত্রীদের দলে সঞ্চারিত করতে। লেখালেখি করে, স্মৃতিচারণ করে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content