শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


বেগম রোকেয়া বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মেয়েদের জন্য এক স্বপ্নের জগত দেখেছিলেন তাঁর ‘Sultana’s Dream’- এ। অন্দরমহল থেকে বাইরে। জেনানা ফটকে আটকে নেই তারা। মেয়েরা বাইরের সবরকমের কাজ করছে। আর ছেলেরা ঘরে। এমন স্বপ্নের জগৎ অনেকটাই সত্যি হয়েছে আজ। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদ শহরে এমন একটি সাধু উদ্যোগ নিয়ে সরকার মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পর্যটনকে এগিয়ে নিতে ওখানকার এমটিডিসি-র (MTDC) মস্ত রিসর্টের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন মহিলাদের হাতে। তিন মাস হল এটি চালু হয়েছে। গত বছর নভেম্বর থেকে। শুধু ঔরঙ্গবাদ নয়। জানা গেল নাগপুরেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিন চারেক এমন মহিলা পরিচালিত রিসর্টে কাটিয়ে এলাম।
গেটের সিকিউরিটি দিয়ে শুরু। বর্ষা ও জয়া—এ দুই কন্যা ডিউটি করছে। শুধু রাত টুকুতে পুরুষ রক্ষী। এখনও মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে সমাজ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেনি। এজন্যই রাতে তাদের দেওয়া যাচ্ছে না। পুরো রিসর্টটির ম্যানেজার মনীষা। কুড়ি পঁচিশ জন মহিলা স্টাফ নিয়ে চালাচ্ছেন। বিকম পাশ করে এমবিএ করেছে। ছিপছিপে সুন্দর সপ্রতিভ মেয়েটি। রিসর্টের সঙ্গেই কোয়ার্টার্স-এ থাকে। ছোট্ট মেয়ে নিয়ে। স্বামী দূরে থাকেন। বলল, কোনও অসুবিধে নেই এক হাতে মেয়ে বড় করার ও পুরো রিসর্টের দায়িত্ব সামলানোতে। বিকেল তিনটে থেকে রাত এগারোটা যে সব মেয়েদের ডিউটি তাদের বাড়ি থেকে একটু আপত্তি এসেছিল। মনীষা বললেন, তাদের আশ্বস্ত করতে একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরাও বুঝেছেন ও সহযোগিতা করেছেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৭: রূপান্তরী

মুভি রিভিউ: ‘সজনী শিন্ডে কা ভাইরাল ভিডিয়ো’ সামাজিক বার্তা দেয়

রান্নাঘর সামলাচ্ছেন একজন বর্ষীয়ান মহিলা। বিভিন্ন পর্যটকের বিভিন্ন রকম খাওয়ার অর্ডার। হাসিমুখে সামলাচ্ছেন। বাড়িতে স্বামী অসুস্থ। মেয়ে পড়াশুনো করে। বাড়ির কাজগুলো সবই সামলাতে হয়। কিন্তু ভারী খুশি মনে পরিপাটি হয়ে তদারকি করছেন সব। পুরমপলি একটি মারাঠি খাবার। হাতে গড়া রুটির ভিতর ছোলার ডালের মিষ্টি পুর ভরা। নিটোল ফুলকো রুটি বানাচ্ছেন নিপুণ হাতে। আমরা তো এমন নিটোল ফুলকো অথচ পুর ভরা রুটি দেখে চমৎকৃত। রান্নাঘরের অন্য মেয়েরা বললো, ওদের মধ্যে উনিই এমন করে রুটি বেলতে পারেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

রিসর্টের ঘরের টিভি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম, এ বার বোধ হয় পুরুষ মিস্ত্রি আসবে। কিন্তু না, ছোট একটি মেয়ে এসে কি খুটখাট করে টিভি ঠিক করে দিল। পর্যটকদের মালপত্র ঘরে ঘরে বয়ে দেওয়া, ঘর, বাথরুম পরিষ্কার, হিসেব রাখা বিল করা, সবই মেয়েরা করে। শুধু দুটো কাজ তাদের নিরাপত্তার তাগিদেই করে না। একটার কথা আগেই বলেছি, রাতের সিকিউরিটি। আরেকটি রুম সার্ভিস। যখন তখন ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়াটি মেয়েরা দায়িত্ব নেবার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য তারা এটি চালু রেখেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

আমরা পৌঁছনোর পরদিন রিসর্টের কর্মীরা সংক্রান্তি উৎসব সেলিব্রেট করলো। সকাল থেকে ভারি খুশি সবাই। সবাই শাড়ি পরে মাথায় ফুল দিয়ে এসেছে। অতিথিদের খাওয়াদাওয়ার পাট মিটলে মস্ত ডাইনিং হলে নাচ গান খাওয়া দাওয়া করেছে। আমাদেরও দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু আমরা তো গিয়েছি বেড়াতে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। তাই আমরা ঘুরে যখন ফিরলাম তখন অনুষ্ঠান শেষ। কিছু ছবি দেখলাম। ভালো লাগলো স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত মেয়েদের দেখে।
আগে পাহাড় অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে অনেক হোম স্টেতে থেকেছি। সেগুলো বাড়ির বর্ষীয়ান মহিলা পরিচালনা করেন। পরিবারের সবাই সহযোগিতা করেন। দু’ একটি ট্যুরিস্ট পরিবার থাকতে পারে। কিন্তু এত বড় একটি রিসোর্ট সম্পূর্ণ মেয়েদের দায়িত্বে দেখে গর্বিত হলাম। মহারাষ্ট্র সরকারের এই উদ্যোগ কুর্নিশ করি। কিন্তু এখনও রোকেয়ার স্বপ্ন পূরণের অনেক পথ বাকি। কবে রাতের কাজে ও মেয়েরা নিরাপদ থাকবে, কবে পর্যটকদের ঘরে ও নিরাপদে নির্ভয়ে মেয়েরা খাবার দিতে যেতে পারবে, সব পরিস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে…সে দিনটাতেই দশভুজা নাম সার্থক হবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content