যে হাত দোলনা দোলায়, সে হাত রাজ্য শাসন করে। এমনটি ইংরেজি প্রবাদ। মায়ের হাতের শক্তি সব সাফল্যের চাবিকাঠি। মানুষ গড়ার প্রথম কারিগর মা। এমন এক মা, যার জন্ম হতদরিদ্র পরিবারে। একগাদা ভাইবোন। ভালো করে দু’ বেলা খাবার জোটে না। বাবা-মায়ের কিছুতে হেলদোল নেই। মেয়েটি নিজেই বিয়ে করল অল্প বয়েসে। ছেলেটিরও সামান্য আয়। যাই হোক করে চলে যাচ্ছিল। একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান ও হল। তারপর মেয়েটির স্বামী অকালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা গেল। মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি থেকে উৎখাত হল ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে। গানের টিউশন করে। সামান্য টাকায় চলে না। বাপের বাড়ির অবস্থাও তো তথৈবচ। টিউশনের সুবাদে এক তবলার মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল। সে সপুত্র মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হল। মেয়েটি স্বস্তি পেল। আশায় বুক বাঁধল।
নতুন শ্বশুরবাড়িতে আছেন শাশুড়ি মা। এরপরের ঘটনা বিরল। সৎ মায়ের পরিচিত চিত্র গল্পগাছায় দেখা যায় খুব খারাপ। সৎ বাবার চিত্রটি এখানে গল্পকে ছাড়িয়ে যায়। ছোট্ট শিশুটিকে চাকরের মত খাটায়, প্রচণ্ড গরমে জুতো রাখার ঘরে ফ্যান ছাড়া শুতে বাধ্য করে। মাঝে মাঝে কান ধরে বার করে দেয় বাড়ি থেকে। মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে তার হাত-পা টেপায়। আশ্চর্যের কথা বাচ্চাটির নতুন ঠাকুমা কিন্তু তাকে সুযোগ পেলেই বুকে টেনে নেন। ছেলের দাপটে সামনে কিছু করতে না পারলেও আড়ালে তাকে খাবার দেওয়া, সুযোগ মতো নিজের পাশে নিয়ে শোয়া, এসব করেন। বড় অসহায় শিশুটির মা। বুঝতে পারলেন বাড়িতে তার সঙ্গে ছেলেকে রাখা যাবে না। টিউশনের সামান্য টাকা দিয়ে ছেলেকে একটা সস্তার হস্টেলে রেখে স্কুলে ভর্তি করে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৫: বিদ্যারূপেন…
মুভি রিভিউ: আদুরের ‘মাথিলুকাল’ সারা ছবি জুড়ে মামুটির অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে
বেড়াল ছানাকে যেমন ঘুরে ঘুরে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখে মা বেড়াল তেমনি শিশুটিকে মা আবার অন্য জায়গায় নিয়ে যান। নিজের বোনেদের বাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখেন। তাদেরও অবস্থা খুব খারাপ। নিজেরাই দিন আনে দিন খায়। ছেলেটি ঘুরে বেড়ায়। কখনও স্টেশনে প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। খাবারের দোকানের সামনে কাউকে খেতে দেখলে হাত বাড়িয়ে খাবার চায়। ফুটফুটে সুন্দর দীঘল চোখের ছেলেটিকে দেখে পথচারীর মায়া হয়। কখনও সখনও একটা রুটি একটু তরকারি জোটে। কোনওদিন সবজি বিক্রেতার সঙ্গে বসে তাকে সাহায্য করে। এ ভাবেই বড় হতে থাকে। অসহায় মা। আরেকটি মেয়ে হয়েছে তার। এক আধদিন বাড়ি যায় ছেলেটি। বোনের সঙ্গে ভারী ভাব তার। অদ্ভুত লাগে, তাই না?
আরও পড়ুন:
দাঁত তোলার পর আবার দাঁত সেট করছেন? সমস্যা ডেকে আনছেন না তো?
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৬: ইতিহাসে চা
প্রথম কাজের সুযোগ এল বাল্বকভার তৈরির কারখানায়। সামান্য পয়সা। তারপর জামাকাপড় বিক্রি, জল বিক্রি। জলের বড় বড় কনটেইনার পিঠে নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ির ওপরে দেওয়া। ছেলেটি দেখতে ভারী সুন্দর। মাঝে টেলিভিশন সিরিয়ালে ও ছোট রোলে অভিনয় করে। যা সামনে পায় তাতেই কাজ। মায়ের বুক ফেটে যায়। লুকিয়ে-চুরিয়ে যে টুকু পারে ছেলের দেখাশুনা করে। ছেলেকে সাহস দেয়। নিশ্চয়ই সুদিন আসবে। এ ভরসা দেয়। টিউশনের পয়সা জমিয়ে জামাকাপড়, ভালো খাবার নিয়ে আসে। আর আছেন ঠাকুমা। এমন উদারমনস্কা বৃদ্ধা বিরল। নানা ভাবে নীরবে বৌমা ও তার বাচ্চাকে সাহায্য করেন। বৌমাকে যাতে তার অবর্তমানে বাড়ি থেকে ছেলে বার করে না দিতে পারে তার এক সুনিশ্চিত আইনি ব্যবস্থা করে রাখেন।
আরও পড়ুন:
বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা
এরপর আরেকটি মেয়ে আসে ছেলেটির জীবনে। সিনেমার গল্প নয়। সত্যি ঘটনা। বড়লোকের আদরের দুলালী। ছেলেটিকে শুধু ভালোই বাসে না। তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। হাত বাড়িয়ে দেয় সেই স্বপ্নের দেশে পৌঁছতে। স্বনির্ভর হতে। ছেলেটি রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াই বছরের একটি ইন্টেরিয়র ডেকরেশনের ডিপ্লোমা কোর্স করে। তারপর একে একে থ্রিডি ম্যাক্স, কার্পেনট্রির ডিপ্লোমাও করে ফেললো। সাহস, ভরসা, অর্থ সবই জোগাল সেই মেয়েটি। পড়াশুনো শেষ হলে ছেলেটির হাত ধরে বেরিয়ে এলো তার ধনী বাপের বাড়ি থেকে। নিজের বরাদ্দ পয়সা দিয়ে ছোট একটি ফ্ল্যাট কিনলো। সংসার পাতলো দু’জনে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা
আর পিছন ফিরতে হয়নি ছেলেটির। এখন সে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তারই নতুন ব্যবসায় বেশ কিছু লোক কাজ করে। নীলা এন্টারপ্রাইজ। আরেকটি বড় ফ্ল্যাট কিনেছে। একটি কন্যাসন্তান জন্মেছে। ঠাকুমা স্বর্গত। মাকে নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চায়। মা রাজি হননি। কাছাকাছি থাকেন। মায়ের সব খরচ সে আনন্দের সঙ্গে বহন করে। বোনের বিয়ে হয়েছে। সুন্দর সম্পর্ক তার সঙ্গে। আর সেই অত্যাচারী বাবা? তার থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। কারণ একসময় অসহায় মাকে আশ্রয় দিয়েছিল। মা, ঠাকুমা ও স্ত্রী —এই ত্রিবেনী শক্তি তাকে পায়ের নিচে এক শক্ত ভিত করে দিয়েছে। যে মাসিরা তাকে কিছুদিন করে আশ্রয় দিয়েছিল তাদের দেখভাল করে। এখন সে মহীরুহ। সকলের ভরসা ও আশ্রয়।
ত্রিবেণী শক্তির মূল চরিত্র: সুমন চক্রবর্তী, ত্রিবেণী শক্তিরা হলেন: রানি চক্রবর্তী, সবিতা চক্রবর্তী ও নীলাঞ্জনা চক্রবর্তী।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।