পুত্রের সঙ্গে।
স্কুলে ওয়ার্ক এডুকেশনের জন্য বলা হয়েছিল চেনা গাছ বানিয়ে আনতে। ছোট্ট মেয়েটির বাড়িতে কেউ গুরুত্ব দিল না। অনেকবার বলার পর, মা রাতের বেলা একটা আকাশী রঙের মার্বেল পেপার এনে দিলেন পাড়ার দোকান থেকে। সকালে মেয়েটি সেই কাগজ আর বাড়ির ব্যবহৃত ঝাঁটা থেকে কটা কাঠি নিয়ে স্কুলে চলল। বন্ধুরা সবাই বাড়ির লোকের সাহায্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর গাছ ফুল বানিয়ে এনেছে। সে স্কুলে বসেই বন্ধুদের থেকে আঠা ইত্যাদি নিয়ে এক ফুলগাছ বানাল। শিক্ষিকা প্রশ্ন করলেন, এটা কী ফুল বানিয়েছো? সে সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিল আকাশী ফুল। মৃদু হাসলেন শিক্ষিকা। সেটা আবার কী ফুল? সেটা সুন্দর ফুল। সোজা আকাশে উঠে গিয়ে ফোটে। কেউ নাগাল পায় না। এ হল উত্তর। মনে মনে ভাবছিল সেদিন তার আকাশী ফুলের কুঁড়িটি আকাশ পানে উঠবে। সূর্যের আলোয়, বাতাসে দুলতে দুলতে তার পাপড়িগুলো একটু একটু করে মেলে দেবে। জীবন সম্বন্ধে অবোধ বালিকার আকাশকুসুম ভাবনা।
টানাটানির সংসারে মা-বাবা মেয়ের পড়াশুনায় নজর দিতে পারতেন না। মা চাকরিতে যাবার পথে সকাল সাড়ে ৯টায় স্কুলে নামিয়ে দেয়। স্কুল চত্বরে ধুলো মেখে খেলে। তারপর চাকরি শেষে মা নিয়ে যায়। সেও স্কুল ছুটির অনেক পরে। মেয়েটি তাই কারও কাছে কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই বড় হল। মাধ্যমিক ভালো ভাবে পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হল। সঙ্গে টিউশন করতে লাগল। বাড়িতে টাকার যোগান দেবার জন্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খুব আগ্রহ তার। কষ্ট করে পড়ে ও খুব ভালো ফল করলো। ভর্তি হল বাড়ির কাছে পলিটেকনিকে। পড়া শেষ হওয়ার আগেই ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পেল। পাওয়ার এক্সেসরিজ-এ, ফিলিপসের কো-মেকার সংস্থা একটি। কিন্তু সে আরও আরও পড়তে চায়। তাই চাকরির সঙ্গে তার বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যও আবেদন করল। সুযোগ মিলল। কিন্তু মাঝপথে সে উচ্চশিক্ষা থামিয়ে সেই পুরোনো কথা, মেয়েকে পাত্রস্থ করা হল। মেয়ে একটাই অনুরোধ শ্বশুরমশাইকে করল, “আমি না, পড়তে খুব ভালোবাসি। পড়তে পারব তো”?
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৪: বরাকপারের কথা
কী দেখে কে পাত্র ঠিক করেছিল কে জানে। বিয়ের দিন সাতেকের মধ্যে আবিষ্কার হল যে, ছেলেটি অসুস্থ। প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা, সঙ্গে অসংলগ্ন ব্যবহার। বাড়ির লোকেরা যখন সাধারণ ডাক্তার ছেড়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায়, তখনই বোঝা গেল। ছেলেটি মানসিক রোগগ্রস্ত। এ জন্য সে বারবার চাকরি ছাড়ে। অসুস্থ না হলে সে একদম ভালো মানুষ। ভালো ব্যবহার করে। স্তম্ভিত হল মেয়েটির বিয়ের রোম্যান্স ও স্বপ্ন। তবু হাল ছাড়ল না। মনে করল স্বামী তো সবসময় খারাপ নয়। যখন সে সুস্থ তখন এক সহৃদয়, মানবিক দায়িত্ব সম্পন্ন মানুষ। এছাড়া সামাজিক অসম্মানেরও ভয় থাকে সাধারণ মেয়েদের। তাই ভাবলো দেখি চেষ্টা করে। কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার হল ছেলেটি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী। মেয়েটির পড়াশুনো মাথায় উঠল। স্বামীকে দেখভাল করা, মাঝে মাঝে এসাইলাম এ দেওয়া, সংসারের কাজ সবই সামলাতে হয়। ইতিমধ্যে একটি পুত্র সন্তানও হয়েছে তার। স্বামী কিছুদিন সুস্থ থাকার সময় নিজের জমানো টাকা, সামান্য গয়না গাটি সব দিয়ে খুব ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলল। শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলে নিজের পড়াশুনো চালাতে পারবে না। তাই। এমটেক-এ কৃতকার্য হল। ছেলে বড় হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?
শ্বশুর বাড়ির লোকজন হঠাৎ ছেলের পড়াশুনো নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ছোট থেকে কোন স্কুলে পড়বে, কীভাবে যাবে, টাকা পয়সা কীভাবে যোগান হবে এসব যারা খোঁজ নেয়নি তারা। হঠাৎ উচ্চ মাধ্যমিকের পর ছেলের পড়ার জন্য লোন নেবার ব্যবস্থা করতে কোমর বেঁধে লেগে গেল। মেয়েটি ভাবল তার ছেলের নামে এক বিরাট অঙ্কের লোন নেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণভাবে বাধা দিল ও শেষ পর্যন্ত সফল হল। যখন মোটামুটি সব গুছিয়ে নিয়ে আসছে, তখনই পরপর এসব বিপর্যয়। স্বামী, স্ত্রী ও পুত্রর বিষয়ে উদাসীন। বারবার অসুস্থ হওয়ায় তার তখনকার চাকরিটি গিয়েছে। এছাড়া তার কর্মদক্ষতাও নেই আর। অধিকাংশ সময় কাটায় তার পরিবারের লোকের সঙ্গে। স্ত্রীর প্রতি ক্রমাগত বিরক্তি প্রকাশ করে। ছেলেও বাবার প্রতি এক ক্ষোভ ও রাগ নিয়ে বড় হয়।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৩: মহিলা সহকর্মী বা স্ত্রী কি কেবল খেলার পুতুল?
একদিন স্বামী উন্মাদনার বশে, বিনা বস্ত্রে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। পিছন পিছন ছেলেকে নিয়ে ছুটতে থাকে মেয়েটি। পুলিশের সহায়তায় জামাকাপড় পরিয়ে ধরে আনে বাড়িতে। তারপর এসাইলাম। সিদ্ধান্ত নিল সুস্থ করে স্বামীকে কোনও রিহাব সেন্টারে দেবে। তার জমানো সব টাকাপয়সা দিয়ে। সংসার সামলে এসাইলামে যাওয়া-আসা করে মেয়েটি। সঙ্গে বাইরের অন্যান্য কাজ। হঠাৎ একদিন শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসে মেয়েটির অবর্তমানে তার স্বামীকে এসাইলাম থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বলে তারাই তার দেখাশুনা করবে। আর মেয়েটির ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে যায়। মেয়েটির নামে দরকারি ডকুমেন্ট লোপাট করার মিসিং ডাইরি করে। পোস্ট অফিস, ব্যাংক সর্বত্র-এর কপি দেয়। মেয়েটি তার ফ্ল্যাট থেকে উৎখাত হল।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ
এ বার আরেক নতুন লড়াই মেয়েটির। পুলিশ, মহিলা কমিশন সব জায়গায় ন্যায় বিচারের আবেদন করে। কিন্তু কোনও সুরাহা হয় না। মহিলা কমিশন কিছুটা চেষ্টা করলেও মানসিক প্রতিবন্ধীদের বিশেষ কিছু আইন থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত তার ফ্ল্যাটটি উদ্ধার করা গেল না। ছেলের বিএ পরীক্ষা চলছে। তার মাঝে বাড়ি থেকে উৎখাত। বাবা-মায়ের অবর্তমানে সেখানকার জমিতে একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট পায়। সেখানে এসে উঠল। প্রায় সর্বহারা হয়ে। সংসার চালানোর পয়সা নেই। ছেলে বড় হয়েছে। তার পড়াশুনো। নিজের চাকরি ও ছাড়তে হয়েছে। কোনও মতে একবেলা রান্না করে দু’ তিনবার খায়। ছেলে মাকে সহযোগিতা করে। কিন্তু সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছেলের এমএ পরীক্ষা শেষ করে কিছু একটা পেলেই আবার জোর কদমে আকাশী ফুলের মতো হাত বাড়াবে। অনে–ক দূর পর্যন্ত। যেমনটি সাধ ছিল।
এ লেখার আকাশী ফুলটি নিবেদিতা দে সেন।
এ লেখার আকাশী ফুলটি নিবেদিতা দে সেন।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।