শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


মালতীর লড়াই।

মালতীর বয়স তখন নয়। বিধবা মা। সংসার চালাতে পারে না দুই মেয়ে নিয়ে। তাই তাকে এক বাড়িতে কাজ করতে পাঠালো। সে বাড়ি এক শিক্ষক দম্পতির। নিজের ছেলে, ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে সব নিয়ে বেশ জমজমাট। মালতীও তাদের একজন হয়ে সে বাড়িতে একদম নিজের লোকের মতো থাকতে লাগলো। ছোটখাট কাজকর্ম করে, ছোট ভাইকে দেখে, সবার সঙ্গে খেলাধুলা করে। যেহেতু শিক্ষক পরিবার, তারাও চেষ্টা করেন মালতীকে একটু লেখাপড়া শেখাতে। কিন্তু পড়া করতে তার ভালো লাগে না। স্বনির্ভর হতে কিছু তো একটা জানতে হবে। তাই সেলাইস্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে।

খুব সুন্দর সেলাই শেখে মালতী। সেলাইয়ের পরীক্ষাও দেয়। পরীক্ষায় পড়াশুনোর অংশটি গৃহকর্ত্রীর সহায়তায় উতরে যায় প্রথম বিভাগে। এ বার তাকে আত্মরক্ষার পাঠ নেবার জন্য ক্যারাটে ক্লাসেও ভর্তি করে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য সে যেন স্বনির্ভর হতে পারে ভবিষ্যতে। ক্যারাটেতে পরপর তিনটি বেল্ট পেল মালতী। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সে। খুব আনন্দেই কাটছিল মালতীর জীবন। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পাঠ হচ্ছিল; একে অপরের সুবিধে অসুবিধেয় পাশে থাকা যেমনটি যৌথ পরিবারে হয়। কিন্তু মালতির বয়স হয়ে উঠেছে কুড়ি।
মালতীর মায়ের চিন্তা বিয়ে দেওয়া। যাঁরা তাকে এতদিন ধরে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছেন তাঁদের ওপর ভরসা হল না। বিয়ে না দিলে মেয়ের জীবন বৃথা। তাই তড়িঘড়ি তাকে গ্রামের বাড়ি এনে বিয়ে দেওয়া হল। শুরু হল এক অন্য জীবন। শুধু সংসারে গাধার খাটুনি খাটে, মার খায়। স্বামী মদ খায়। সামান্য আয়। কিন্তু মালতীর চিন্তাধারায় এক অন্য স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন তার এতদিনের কাজের বাড়ির কাকা ও কাকিমা। তাই কিছুদিন বাদে সে একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সেলাইয়েরর সার্টিফিকেট ছিল। তারই সাহায্যে একটি দোকানে সেলাইয়ের কাজ নিল। কিছু আয় হয়। কিন্তু সংসারে অত্যাচার কমে না।

পাশেই থাকে ভাসুর। মালতী ও তার স্বামীকে বাড়ি থেকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর তিনি। বলেন জমির দলিলে মালতীর স্বামীর নাম নেই। পড়াশুনা না জানলেও মালতীর এ বুদ্ধিটুকু আছে যে দুই ভাই থাকলে দুজনেরই বাবার জমির অংশীদার হওয়া উচিত। ভাসুর দলিল দেখায় না। মালতী সোজা এসডিও অফিসে গিয়ে নিজের সমস্যার কথা বলে, আর্জি করে সত্যি জানার। অফিসার তাকে দলিল দেখার ব্যবস্থা করে দেন। এ বার সে বাড়ি ফিরে জোর গলায় বলে যে বাড়িতে তাদেরও ভাগ আছে। এ হল মালতীর প্রথম জয়। তাদের বাড়ির অংশ আলাদা হয়। ভাসুরের অত্যাচার বন্ধ হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪: কৃষ্ণভাবিনী দাসী— প্রথম মহিলা ভ্রমণ কাহিনিকার

মালতী যেখানে কাজ করত সেখান থেকে তার স্বনির্ভর হওয়ার মানসিকতা, সততা, ভাইবোনকে ভালোবাসা এ সব শিক্ষা পেয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল বেশ কিছুদিন। রক্তশূন্য, দুর্বল। কিন্তু কারও ভ্রূক্ষেপ নেই সে জন্য। স্বামী নিত্য মারধর করে, নেশা করে। একদিন মার খেতে খেতে ঘুরে দাঁড়ালো। হাতের কাছে একটি সেলাইয়ের কাঁচি ছিল। তাই দিয়ে স্বামীকে দিল এক ঘা। কপাল কেটে রক্ত পড়তে লাগলো। মালতী সবাইকে বলল, রোজ রোজ সে মার খায়। আর খাবে না। তাই পাল্টা মার। মালতির জয় হল। তারপর থেকে মারধর বন্ধ। ধীরে ধীরে নিজের মধ্যেই শক্তি সঞ্চয় করে সেরে উঠতে থাকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৩: ইতিহাসের পাতায় লাচিত বরফুকোন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

ইতিমধ্যে তার একটি মেয়ে হয়েছে। মেয়েকে পড়াশুনো শেখানোর প্রতিজ্ঞা করে সে। মালতীর একটি স্বল্পবুদ্ধি বোন ছিল। তাকেও মা একটি নেশাগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব মুক্ত হয়েছেন। বোনের একটি ছেলে। বোনকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অত্যাচার করে। স্বল্পবুদ্ধি, বুঝতে পারে না। গাধার খাটুনি খাটে। স্বামীর কাছে মার খায়। মালতী সহ্য করতে পারে না। বোনকে ছেলে সমেত নিজের কাছে নিয়ে আসে। বোনের ছেলেটি অটিস্টিক। মালতীর সংসারে খরচ বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

কীভাবে সামলাবে সব? সে যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছে সে কাকিমার পরামর্শ তার কাছে বেদবাক্য। তার কথামতো সকালে হোমসার্ভিস খুলল। রুটি তরকারি। সাহায্য নিল বোন ও বোনের ছেলের। ধীরে ধীরে বিকেলে ও বাজারে একটা বড় ছাতার তলায় বিকেলের রকমারি টিফিন বানাতে শুরু করল। ব্যস, আর পয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। হই হই করে চলে মালতীর দোকান। কল্যাণীর কাঁঠালতলা বাজারে মানিকের মায়ের দোকান বললেই এক ডাকে সবাই চিনবে। মানিক হল বোনের সেই স্পেশাল চাইল্ড, যাকে মালতী পরম স্নেহে নিজের কাছে টেনে আশ্রয় দিয়েছে।
মালতীর স্বামীর ছিল একটা সাইকেল সারানোর দোকান। পুরোনো অভ্যাস মতো নেশা করা ছাড়েনি। বউ-বাচ্চা দেখার কোনও দায়িত্ব তার নেই। রাতে কোনওদিন খাবার কিনে এনে একা একা খায়। দুপুরে দোকানে খায়। মালতীও তার খাওয়ার দায়িত্ব নেয় না তাই। বোন তার ছেলে এবং নিজের মেয়ে—এ চারজনে একসঙ্গে খাবার খায়। পরম মমতায় স্বল্পবুদ্ধি বোন ও তার অটিস্টিক ছেলের দেখাশুনা করে। তাদেরও নিজের ব্যবসার কাজে লাগায়। মালতী খুব ব্যস্ত এখন। হাসিমুখে ছুটে ছুটে সব সামলায়। বোন মাঝে মাঝে তার শ্বশুর বাড়ি যায়। নিজের ঘরের অধিকারটুকু রাখার জন্য। মালতী তার হাতে একখানা লাঠি ধরিয়ে দেয়। স্বামী মারলে যেন মার খেয়ে চলে না আসে। দু ঘা দিয়ে আসে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content