শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


বোনের সঙ্গে।

‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’—এমনটাই বিশ্বাস ছিল আগে। পুত্র হওয়ার আশে অনেক কন্যার জন্ম দেওয়া, বা দ্বিতীয় বিয়ে করায়ও দ্বিধা হত না। কন্যা বোঝা। যাকে অন্য স্কন্ধে যত তাড়াতাড়ি দেওয়া যায় তত স্বস্তি। এমন এক পরিবারে জন্ম পর পর দুটি মেয়ের। তৃতীয় মেয়েটি স্পেশাল চাইল্ড। তারপর পুত্র সন্তানের আশা ত্যাগ করলেন বাবা। যিনি পেশায় ডাক্তার। তিনি খারাপ দেখতে মেয়েকে অনেক ধনসম্পদ যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেছেন। কন্যা সন্তান পালনে লাভ নেই। তাই শৈশবেই তাদের দাদুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। দিদিমা থাকেন না। তাকেও মোটা টাকায় পাত্রস্থ করা হয়েছিল বলে স্বামীর সন্তানের মা হওয়া ছাড়া কোনও পরিষেবা দেননি। বয়েস বাড়লে স্বামীর পরিবারে থাকতেনই না। তাই নাতনিরা চাকর বাকরের তত্বাবধানে বড় হল।
স্কুলে ভর্তি করতেও তাদেরই একজন গেল, যা হয় একটা জন্মতারিখ দিল। নিজের মতো বড় হয় তারা। মায়ের স্নেহ নেই। কারও যত্ন নেই। চুলে জট পাকায়, শীতে হাত পা খসখসে হয়। স্কুল শেষে বেড়াল-কুকুরের সঙ্গে খেলা করে বাড়ি ফেরে। পড়াশুনায় ভালো। তুখোড় বুদ্ধি। স্কুলে প্রাইজের দিন প্রাইজ পায়। সবার বাবা-মা আদর করে। এ মেয়ের প্রাইজ নিয়ে দেখানোর জন্য বাবা-মা নেই। কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবা-মা তো কলকাতায়। সমাজসেবা করেন, বড় বড় পার্টি তে হাজিরা দেন। উন্নয়নে শামিল হন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

ছোট থেকে বন্ধু হয় কুকুর, বেড়াল। তারা বেশ পায়ে পায়ে ঘোরে। আদরে সাড়া দ্যায়। বাবা-মা মাঝে মাঝে দু’একদিনের জন্য দেখতে আসে। সে দিন মেয়েটির ভারী আনন্দ। মায়ের পিছু ছাড়ে না। আঁচল ধরে ঘোরে। মায়ের যাবার সময় আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদে। চায় না মা চলে যাক। মা আঁচল ঝেড়ে মেয়েকে ছাড়িয়ে চলে যায় বাবার পিছু পিছু। পুরুষ মায়ের মাতৃত্ব শোষণ করে নেয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

তারপর দিন যায়। সে মেয়ে বড় হয়। সে কত কত পরিক্ষা দিল। ভালো ফল করল। তারপর একদিন সরকারি কলেজে চাকরির পরীক্ষাতেও সফল হলো। বাবা-মা জানেন না বা জানার তাগিদ নেই মেয়ের সাফল্যের কথা। কারণ হাজার হোক মেয়ে তো। ছেলে তো নয়। চাকরির নিয়োগের চিঠি বাড়ির ঠিকানায় গেলে সেটা এক কাকা লুকিয়ে ফেলেন। বাড়ির মেয়ে পড়ালেখা জেনে চাকরি পেলেই সম্পত্তি দাবি করতে পারে সে ভয়ে। সম্পত্তি যাবে পুরুষের দখলে। কিছুদিন বাদে মেয়েটি অফিসে খোঁজ নিতে গিয়ে বেজায় বকা খেল। ‘আপনার কি চাকরি করার ইচ্ছে নেই?’ যাই হোক সে যাত্রা সামলানো গেল ডুপ্লিকেট বার করে।

পথকুকুরের শুশ্রূষায়।

সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে মেয়েটি। সারাজীবন ভালোবাসা পায়নি কারও। তাই বাবা-মা যখন বিয়ে ঠিক করল আবার বুক বাঁধলো আশায়। এ বার একটা ভালোবাসার মানুষ, সংসার ও সন্তান পাবে। অনেক ভালোবাসা উজাড় করে দেবে। একটা কথা পুরোনো দিনে প্রচলিত ছিল। যার সুখ হয় না মায়ের কোলে, তার সুখ নেই কোনও কালে।

এক্ষেত্রে বোধ হয় তাই হল। সংসার সন্তান সবই হল। কিন্তু ভালোবাসা মিললো না। স্বামীও সেই পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক। স্ত্রী শুধু সেবা করবেন ও সন্তানের জন্ম দেবেন। তাই রান্না খারাপ হলে ও তরকারির বাটি ছুঁড়ে মারে, ঠোঁট কেটে যায়। হাসপাতালে গিয়ে মেয়েটি বলে বাথরুমে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটেছে। সংসারের সমস্ত কাজ করে নিজের কলেজের ও নানারকম দায়িত্ব পালন করেন। আর পথের যত কুকুর, বেড়াল তাদের দেখভাল করে। ওষুধ, খাবার খাওয়ায়। নিজের পয়সা খরচ করে। এছাড়া সমস্ত কাজের ফাঁকে গবেষণার কাজটিও সেরে ফেলে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪১: রিল জীবিকা বনাম জীবিকার বাজারে মেয়েরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর

লেখাপড়া না জানা বাড়ির কর্মচারী স্কুলে ভর্তি করেছিল, যা হয় একটা জন্মতারিখ বলে। তাই মেয়েটি নির্দিষ্ট বয়সের আগেই অবসর নিল। ইতিমধ্যে বাবা-মাও বৃদ্ধ হয়েছেন। সঙ্গে ছোট বোনটি, যার দেখভাল করা কষ্ট। মেয়েটি বাপের বাড়ি এলো। সপরিবারে। বৃদ্ধ বাবাকে শেষ জীবনে সযত্নে দেখাশুনা করলো। তারপর মা-কে। বাবা-মা এখন অসমর্থ হয়ে এ মেয়ের ওপরই নির্ভর।

অন্য মেজাজে।

এছাড়া তাদের তৃতীয় সন্তান, যে স্পেশাল চাইল্ড তার ভবিষ্যৎ ওই মেয়ের ওপর উইল করে দেওয়া হল। অনাদরে অবহেলায় মানুষ হওয়া মেয়েটি সম্পূর্ণ যত্ন নিয়ে, প্রথমে বাবা-মা ও পরে সেই বোনকেও পরিষেবা দিল। এতটুকু অযত্ন হতে দিল না। কোনও স্বস্তির নিঃশ্বাস মিলল না, মিলল না কোনও ভালোবাসার ঠাঁই। কিন্তু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে পরিবারকে, আর তার ছোটবেলা থেকে ভালোবাসার সঙ্গী পশুপাখিকে। কলেজে সহকর্মীরা তার অবসর নেওয়ার পরেও ক্যাম্পাসে কুকুর দেখলে বলে ওঠে, আরে মঞ্জু দি নেই। তোরা খাবার পাবি না রে।

* একলা চলা মেয়েটি ড. মঞ্জু মণ্ডল, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, সরকারি কলেজ।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content