শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


নারী শোষিত, অবহেলিত। এ সব কথাই শুনে আসি আমরা। অনেক লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার গল্প শুনে চমকে উঠি। কিন্তু স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমতী, কর্তৃত্বময়ী নারী অনেক অনেকবছর আগেও ছিলেন। তাদের কথা ও অনেক লেখায় পাওয়া যায়। মহাশ্বেতা দেবীর ঠাকুমা, দিদিমা, এদের কথা পড়েছি। সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পুরুষরা তাদের মতামত সবার আগে নিতেন। সাগরময় ঘোষের বাড়ির এক বর্ষীয়ান মহিলা বাড়ির বাচ্চার মলদ্বারে জোঁক ঢুকে যাওয়ায় উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে চুনের জল খাইয়ে ডাক্তারি করেছিলেন। এমন এক বিদুষীর কথা বলি। প্রায় আশি নব্বই বছর আগের কথা। তাই আজকের দিনে বলার মতো কথা।

জন্ম তার অতি উচ্চঘরে। অত্যন্ত শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, প্রগতিশীল পরিবারে। ইংরেজি আদবকায়দা শিখে বড় হল মেয়ে। জন্মদিনে ফ্রিল দেয়া জামা, মোজা, টুপি পরা, কেক কাটা, এসব হতো। ইংরেজি স্কুলে পড়ত। অর্গান বাজানো, নাচ, গান সবই শিখল ছেলেবেলায়। তারপর পিতৃদেব কর্মসূত্রে কলকাতায় এলে সে ও কলকাতায় ইউনাইটেড মিশনারি স্কুলে ভর্তি হল। তেরো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট দেবার সময় তার বিয়ে ঠিক হল। পাত্র জুডিসিয়াল পরীক্ষায় সফল হয়ে চাকরির অপেক্ষায়। তার পিতা ছেলের বিয়ের জন্য আর অপেক্ষা করতে নারাজ। তাই চাকরিতে যোগদানের আগেই ছেলেকে সংসারী করে দিলেন। শিক্ষিত, সচ্চরিত্র, ছেলে। তার পরিবারও।
পাত্রর বড় ভাই মেয়ের বাবার বন্ধু। পিতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাই ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা নয়। অপূর্ব সুন্দরী মাত্র তেরো বছরের মেয়ের বিয়ে ঠিক হল এক স্বাস্থ্যবান আঠাশ বছরের যুবকের সঙ্গে। বিদ্বান পাত্রর আপত্তি ছিল এক স্কুল উত্তীর্ণ হয়নি এমন বালিকাকে জীবনসঙ্গিনী করার।মেয়ের বিদ্যানুরাগের সন্মন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তাই।

পাত্র বাংলার বাইরে থাকে। বাংলা পড়তে জানে না। বাঙাল ভাষা জানে। ইংরেজি জানে। বিয়ের দিন পাত্রর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতায় মাতলো মেয়ের বোনেরা। তখনকার দিনে মস্ত মস্ত যৌথ পরিবার। তুতো ভাইবোনেরা অগুনতি। ইংরেজি আদবকায়দায় বড় হওয়া সুন্দরী মেয়েটির বার্মা নিবাসী কাঠবাঙাল ভাষি পাত্র নিয়ে ঠাট্টা তামাশা চলতে লাগলো। কেউ বললো পাত্র এত্ত বড় রসগোল্লা একবারে মুখে ঢোকায়। কেউ বললো কাঁধটা এক্কেবারে যাকে বলে বৃষস্কন্ধ, মোষের মতো তাগড়াই। টুকটুকে ফর্সা মেয়ে কালো স্বাস্থ্যবান পাত্রর গলায় মালা পড়ানোর সময় বাড়ির পুরোনো পরিচারিকা ফুট কাটলো, এয়া রাম এ যে দেখি কাউয়ার মুখে কমলা!!! ভাগ্যিস বিয়েবাড়ির হট্টগোলে সে কথা পাত্রর কানে যায়নি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৪: আকাশী ফুল

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৬: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন—মেয়েদের আলোর দিশারী

বাসর ঘরে পাত্রকে সবাই পীড়াপীড়ি করতে লাগলো গান গাওয়ার জন্য। পাত্র তার ভারী গলায়, বাঙাল উচ্চারণে গাইল ‘প্রেমের সমাধি তীরে তাzমহলের মড়মড়ে গাঁথা কবির অশ্রুzল, তাzমহল,তাzমহল।” বাড়ির লোকেরা মনে মনে এ গান শুনে বললো তাজমহলের গা এ ফাঁটল ধরলো। বাসরে যার প্রেমের এ গান সে মানুষের কাছে এ সুন্দরী মেয়ে কেমন ভালোবাসা পাবে এ নিয়ে সকলে সন্দিহান হল।

এ হেন বাঙাল বাড়ি এসে সাহেবি শিক্ষায় বড় হওয়া মেয়েটি কিন্তু দিব্যি মানিয়ে নিল। এ পরিবারও অত্যন্ত প্রগতিশীল, কৃষ্টি সম্পন্ন ও বিদ্যানুরাগী। নববধূর পড়াশুনো বন্ধ হল না। অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে শ্বশুরবাড়ি। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে। তাই বিয়ের সাতদিন পরই স্বামী ও শ্বশুরমশাই চলে গেলেন বার্মায়। যুদ্ধের টালমাটাল অবস্থায় মাস দুয়েকের মধ্যে বার্মার বহুদিনের পাট চুকিয়ে স্বামী ও পরিবারের সব উপার্জনকারী পুরুষদের চলে আসতে হল। মেয়েটির পড়াশুনো কিন্তু চলতে লাগল। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক, আইএ, বিএ, একে একে সব পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করল। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় ঢাকা থেকে পরিবারটি উৎপাটিত হল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

এদিক ওদিক টানাপোড়েনের পর পরিবারটি স্থিতু হল যাদবপুরে। এ বারে আবার শুরু হল মেয়েটির পড়াশুনো। এমএ পড়া। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে বাংলা ও ইতিহাসে। পঞ্চাশের দশকে পর পর দুটি বিষয়ে এমএ। তারপর বিটি। ইতিমধ্যে দুটি ছেলে মেয়ে ও হয়েছে। বাড়ির মানুষদের পূর্ণ সহযোগিতা। ছেলেমেয়েরা যেখানে বসে পড়ে, সেখানে বসেই একসাথে পড়াশুনো করেন। পড়তে বসে গল্পগাছা করলে চলবে না। শ্বশুরের সেদিকে কড়া নজর। তাই যদি বা গল্পগাছা হয় শ্বশুরের পায়ের শব্দে কান খাড়া। তাড়াতাড়ি মনযোগী হয়ে পরতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বাস আসতে দেরি হলে স্ট্যান্ড এ বইয়ের দোকানে ঢুকে বই পড়তে শুরু করেন। এমনি তীব্র পড়ার নেশা।

এরপর আওয়ার লেডি কুইন অফ দ্য মিশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন দীর্ঘদিন। পরিবার তাকে যেমন সুযোগ করে দিয়েছে তিনিও পরিবারকে উজাড় করে দিয়েছেন—সেবা, ভালোবাসা, ছোটদের পড়ানো। বাড়ির কারও অসুখ-বিসুখে পরম মমতায় শুশ্রূষা করতেন। আর ভালোবাসতেন রেঁধে-বেড়ে খাওয়াতে। ইতিহাসের সাল তারিখ ছিল নখদর্পণে। বাংলা সাহিত্যে অবাধ সঞ্চরণ। স্কুলের সিলেবাসে রামায়ণ রাখেন সুপারিশ করে। চাকরির জায়গাটিও করে নিয়েছিলেন পরিবারের মতো। ছাত্রীরা যেন তার সন্তান।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৫: রবীন্দ্রনাথ নিজের ডাক্তারি নিজেও করেছেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

প্রেমের সমাধির গান দিয়ে, সকলের হাসির মধ্যে যে বাসর শুরু করেছিলেন তার স্বামী সেটি হয়েছিল অত্যন্ত সুখের এবং দীর্ঘ। শেষ জীবনে এক স্থূলকায়া প্রায় একশ কেজি ওজনের বৃদ্ধাকে অনেকেই দেখে থাকবেন গড়িয়াহাটের বুলেভার্ড থেকে ঢাকেশ্বরী পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে কেনাকাটা করছেন। রাস্তাঘাটে তার অনেক নাতি নাতনি। সবার সঙ্গে ভারী ভাব। অনেক গল্প রোজ। তাদের জন্য কেনাকাটা করছেন। একবার এক মারুতি ভ্যানের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলেন। লোক জড় হয়ে ড্রাইভারকে বকা ঝকা করতে লাগলো। উনিও অনেকক্ষণ স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বকলেন। তারপর ভিড় হালকা হলে পলায়নোদ্যত ড্রাইভারের সঙ্গে গপ্প জুড়লেন। তার বাড়ির খবর, হাঁড়ির খবর নিলেন। তারপর নিজের বাড়ির কথা বললেন। কত কাছে তাও নির্দেশ করলেন। নিমন্ত্রণে শেষ হল তার আলাপচারিতা, যেমনটি সবাইকে করেন, “কবে আইবা কও। তোমার জন্য পায়েস রাইন্ধা রাখুম”।

*এ গল্পের বিদুষী নারীর নাম অঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়
*এ ঋণ স্বীকার : কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content