বিয়ের পর উপচে পড়া সুখের অধিকারিণী তিনি। দেখে হিরোইন বলে ভুল হতো। ইচ্ছে যে একদম ছিল না তাও নয়। তাঁর সেই ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে গুরু দত্ত দ্বিভাষিক (হিন্দি ও বাংলা) এবং দেশের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি গৌরীর শুটিং শুরু করলেন। মুখ্য নায়িকা চরিত্রে রইলেন তাঁর স্ত্রী গীতা দত্ত। এই ছবির সুরকার ছিলেন স্বয়ং এসডি বর্মণ। দুটো গানের রেকর্ডিংও হয়েছিল কিন্তু কখনও মুক্তি পায়নি। এই মুক্তি না পাওয়া দুটো গানের একটা ছিল ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই ও যে ডাকাতিয়া বাঁশি’।
একটা গানের শুটিংয়ের পর পরিচালক ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেন। শুটিং বন্ধ হল। এই ছিলেন গুরু দত্ত। যেমন নিয়মানুবর্তিতা, দূরদর্শী তেমন মাঝে মাঝে খামখেয়ালী। খুব হতাশ হলেন গীতা। এরপর আবার গুরু দত্ত চেষ্টা করলেন হরিদাস ভট্টাচার্যের ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’-তে গীতাকে দিয়ে অভিনয় করানোর। কিন্তু সেই চেষ্টাও বিফলে যায়। তাঁদের বিয়ের এক বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালে গুরু দত্ত পরিচালনা করলেন ‘আর পার’। সুরকার ছিলেন ওপি নাইয়ার। আটটা গানের মধ্যে সাতটাই গাইলেন গীতা। এর মধ্যে ‘বাবুজি ধীরে চল না’— আজও একই রকম জনপ্রিয়।
একটা গানের শুটিংয়ের পর পরিচালক ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেন। শুটিং বন্ধ হল। এই ছিলেন গুরু দত্ত। যেমন নিয়মানুবর্তিতা, দূরদর্শী তেমন মাঝে মাঝে খামখেয়ালী। খুব হতাশ হলেন গীতা। এরপর আবার গুরু দত্ত চেষ্টা করলেন হরিদাস ভট্টাচার্যের ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’-তে গীতাকে দিয়ে অভিনয় করানোর। কিন্তু সেই চেষ্টাও বিফলে যায়। তাঁদের বিয়ের এক বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালে গুরু দত্ত পরিচালনা করলেন ‘আর পার’। সুরকার ছিলেন ওপি নাইয়ার। আটটা গানের মধ্যে সাতটাই গাইলেন গীতা। এর মধ্যে ‘বাবুজি ধীরে চল না’— আজও একই রকম জনপ্রিয়।
১৯৫৫ তে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভে’-এ ‘ঠান্ডি হাওয়া কালী ঘটা’— মহম্মদ রফির সঙ্গে ‘উধর তুম হসীন হো’, ১৯৫৬-তে ‘অ্যায় দিল মুঝে বাতা দে’ খুব জনপ্রিয় হয়। এই সময় তাঁর হোম প্রোডাকশন ছাড়া অন্যত্র গাওয়া বন্ধ হয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার ফরমান সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিলেন সুরকাররা। একটা করে গান তাঁর জন্য তুলে রাখছিলেন কারণ তিনি যে তিনিই। তাঁর মতো যে কেউ নয়। কত মানুষের সঙ্গে সখ্যতা, পরিচয়, বন্ধুত্ব, হুল্লোড় অথচ কোথায় যেন আটকে গেলেন।
১৯৫৭ সালে মুক্তি পেল ‘প্যায়াসা’, ঠিক তার দু’বছর আগে ‘দেবদাস’-এ প্রথম তাঁর গলায় শোনা গিয়েছিল কীর্তনাঙ্গের ‘আন মিল আন মিল শ্যাম সাঁবরে’, তারই যেন সঠিক অনুরণন হল ‘প্যায়াসা’তে। শচীন দেব বর্মণের সুরে নিজের সবটুকু দিয়ে গাইলেন ‘আজ সজন মোহে অঙ্গ লগালে’, তার সঙ্গে ‘হম আপকি আঁখো মে’-র মতো প্রেমের গান। আর ছড়ালেন ‘জানে ক্যায়া তুনে কহি’-র চাপল্যের জাদু। ওদিকে নচিকেতা ঘোষের সুরে ওই একই সময়ে গাইলেন ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’। এইসময় তাঁর বাংলা শব্দের ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ, পৃথক পৃথক অক্ষরের ওপর বিশেষ জোর, নায়িকারা বুঝলেন গীতা দত্তের গানের লিপসিং মানে যা হোক করে গেয়ে দেওয়া নয়, শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে সুর, তাল ও অভিনয়ের সঠিক সমাবেশ।
আরও পড়ুন:
যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৭: রঙের খেলা আর উইসকনসিনের আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা—জীবনীশক্তিকে আরও উসকে দেয়
আজ একটু ভিন্ন স্বাদের রান্না করতে চান? তাহলে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন বিলেতি ধনেপাতা দিয়ে ভোলা মাছ
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ [১০/০৭/১৯৫৩]
মালা সিনহা থেকে সুচিত্রা সেন কেউ ব্যতিক্রম নন, কেউ এই ছক ভাঙতে পারেননি। সহজে বলতে গেলে গীতার গানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ধরে রাখা। মেলডির সঙ্গে এমনভাবে নিজস্ব ব্যাকরণ জুড়ে দিলেন, যার উচ্চারণ অন্যের অসাধ্য হয়ে গেল। সাল ১৯৫৮ তিনি বাঙালি শ্রোতাদের উপহার দিলেন নচিকেতা ঘোষের সুর ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠের ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’। একক ভাবে ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে আর তুমি যে আমার। এমন ভাবে সব ভোলা নায়কের উদ্দেশ্যে নায়িকাকে দিয়ে তুমি যে আমার বলালেন যে, শুধু বাঙালি নয় অনেক অবাঙালি শ্রোতাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম মজে রইলেন। দেশের কোন সিনেমাপ্রেমী না জানে ‘হারানো সুরে’ অলোক (উত্তমকুমার)-রমার (সুচিত্রা সেন) জনান্তিকে বিয়ের রাত আর সেই রাতে রমার ‘তুমি যে আমার’ বলা! এই গানের শেষ অংশে ভারতীয় ক্লাসিক সাহিত্যের সঠিক অনুকরণে নায়কের নায়িকাকে চিনতে না পারা, চেনার চেষ্টা করা, সেই বলাতেও চিরকালের জন্য তিনি। তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সিনেমার প্লেব্যাক শূন্য। অথচ নিজে যাঁকে তুমি যে আমার বলেছিলেন তাঁকে ধরে রাখতে পারলেন না। দুই শিল্পী সত্তার দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছেদ প্রকট হয়। একে অপরকে ছেড়ে থাকতে না পারা, আবার থাকাও!
গায়িকার স্টার ইমেজ, লিমুজিন, খ্যাতি, সন্দেহ, বেশিমাত্রায় অধিকার বোধ আবার স্বামীর কথায় সংসার জীবনে, কেরিয়ারের ক্ষেত্রে আপোষ— পরিচালকের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা, বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হওয়া সবই যেন সাধারণ মানবিক সম্পর্কের বিপরীতে গিয়েছিল। আকারে ইঙ্গিতে দায়ী হলেন তৃতীয় পক্ষ। যদিও তিনি কোনওদিন দায় নেননি। শেষের দিকে তাঁকে ডেকে ডেকে এনে ‘সাহেব বিবি গোলাম’-র শুটিং শেষ করাতে হয়েছিল। তখন থেকেই তিনি পরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকলেও ছাড়া ছাড়া ভাব বজায় রেখেছিলেন। তাঁর এমন ব্যক্তিত্ব, পরিশীলিত জীবন ও অভিনয় যে বেশিদিন তাঁর দিকে আঙ্গুল তোলা যায়নি।
আরও পড়ুন:
ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু
ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি
ষাট পেরিয়েঃ অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে
ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো
‘হারানো সুর’-এর প্রায় সমকালে গুরু দত্ত তৈরি করলেন দেশের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘কাগজ কে ফুল’। বাণিজ্যিকভাবে অসফল হলেও আজ দেশের ‘কাল্ট’ ছবিগুলোর অন্যতম এই ‘কাগজ কে ফুল’। ছবির সঙ্গে সঙ্গে তরুণ কবি, গীতিকার ক্যায়ফি আজমি, সুরকার শচীন দেব বর্মণ ও গীতা দত্তের গায়কীর অপূর্ব মিশেলে মুক্তি পেল চিরকালীন ‘ওয়ক্ত নে কিয়া ক্যায়া হসি সিতম’। এই গানই যেন দুটো জীবনের নিয়ন্তা হল। ‘কাগজ কে ফুল’-এর না চলা পরিচালক মেনে নিতে পারলেন না। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ও ‘চৌধভী কা চাঁদ’-এর সাফল্য কোনও কাজে এল না।
সৃষ্টি ও শূন্যতার মাঝে পড়ে শূন্য, রিক্ত, ভয়ানক মানসিক অবসাদে বিপর্যস্ত গুরু দত্ত তৃতীয় বারের চেষ্টায় ১৯৬৪ সালে সফল হলেন। তিন সন্তানকে ভুলে গীতা প্রায় একবছরের জন্য শয্যাশায়ী হলেন। ললিতা লাজমি বার বার বলেছেন কোনও তৃতীয় পক্ষ নয়, তাঁদের অস্থির শৈশব, জিন আর দিনের পর দিন নিজের সন্তানদের কাছে না পাওয়া দায়ী ছিল গুরু দত্তের শেষ হয়ে যাওয়ার মূলে। সুস্থ হয়ে শুরু হল গীতার দত্তের নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই কারণ তখন সন্তানদের একমাত্র আশ্রয় তিনি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির জটিল সমীকরণে ততদিনে সব বদলে গিয়েছিল। আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ নিঃসম্বল গীতা একের পর এক স্টেজ শো করে যেতে লাগলেন, পুজোয় বাংলা রেকর্ড বের করলেন। বাংলা ছবি ‘বধূবরণ’-এ (১৯৬৭) মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করলেন। সেই সময় সুধীন দাশগুপ্ত ও অনল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর গানগুলো আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু কিছুতেই যেন শেষ রক্ষা হচ্ছিল না। চূড়ান্ত অবসন্ন শরীর, মন মাঝে মাঝে একদম সঙ্গ দিত না। স্তাবক পরিবৃত হয়েও কাউকে না বলতে পারা কথা যেন কাল হল।
পুরোনো কলকাতার বাসিন্দাদের আজও মনে আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাইতে গিয়ে স্টেজে উঠতে না পেরে তাঁর সিঁড়িতে বসে পড়া আর একা গায়কের ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ গেয়ে চলা। যাঁর গলার আবেদনকে ভয় পেয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও একসময় ‘যাতা কাঁহা হ্যায় দিওয়ানে’ নিষিদ্ধ করেছিল, সেই তিনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আর গাইতে পারছিলেন না। কিন্তু শেষ বারের মতো ভরসা করেছিলেন পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য। নিজের ধারার ছবি তিনি বানাতে শুরু করেন বম্বেতে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৪: শোকবিহ্বল মা, ক্ষোভে উত্তাল ভাই — তবুও কি বনবাস?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৩: সমুদ্রশোষণ তো হল, এবার পূরণ করবে কে?
পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে
১৯৭১ সালে তাঁর ছবি অনুভবে দাম্পত্য প্রেমের গানে ব্যবহার করেন গীতার গলা। সৃষ্টি হয় ‘মুঝে জাঁ না কহো মেরি জাঁ’, ‘মেরে দিল যো মেরে হোতা’, ‘কোয়ি চুপ কে সে আকর’-এর মতো অসামান্য গান। ১৯৭২ সালে শেষ জাদু ছড়িয়ে গেলেন সুরের সাধিকা। প্রায় দুহিতার আসন্ন পরিণতি আঁচ করে শচীন দেব অসুস্থ অবস্থায় রোগশয্যায় অনেক দুঃখে বলেছিলেন যায় যাক, পরে নিজের গলায় রেকর্ড করেছিলেন ‘সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’। আসন পাকা হল অন্য দুই বিখ্যাত গায়িকার। আর পরবর্তী বাঙালি গায়িকার আবির্ভাবে আরও তিরিশ বছর কেটে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর জায়গা কেউ কখনও নিতে পারেননি। —শেষ
তথ্য ও ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত তেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাস। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রীণা মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।