সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


সুরের মূর্ছনায়।

ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব থেকে পাকাপাকি ভাবে চলে আসা কাপুর, আনন্দেরা স্বাধীনতার আগে থেকেই বম্বে সিনে ইন্ডাস্ট্রির ভাগ্য বদলাতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে প্রভাব বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রির ওপর পড়েছিল, সেই প্রভাব কখনও আরবসাগরের তীরে পৌঁছয়নি। ফলে তাঁদের নির্মিত বিখ্যাত পৃথ্বী থিয়েটার, আর কে ফিল্মস, নবকেতনের ব্যানারের নীচে আসার জন্য সেই সময়ের সিনে আর্টিস্ট থেকে শুরু করে সিনেমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষের হুড়োহুড়ি ছিল দেখার মতো। এসবের মধ্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, নিজের মাদকতাময়, সুমধুর গলাকে সঙ্গী করে বছরের পর বছর গেয়ে গিয়েছেন কালজয়ী সব গান, প্রথম জীবনে তাঁকে কোথাও লাইন দিতে হয়নি। বরং সুরকাররা তাঁর প্রতিভাকে ব্যবহারের জন্য লাইন দিয়েছেন।

লতা মঙ্গেশকর, অনিল বিশ্বাস ও গীতা দত্ত।

তিনি হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রের এবং আধুনিক গানের প্রতিভাময়ী নেপথ্য গায়িকা গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী বা গীতা দত্ত। নামই গীতা, জীবনও গীতিময়। অকালে চলে না গেলে ভারতের নেপথ্য গায়নের মানচিত্র হতে পারতো অন্যরকম কারণ সুরসম্রাজ্ঞীর সম্ভ্রমের পাত্রী ছিলেন তিনি। আবার ছিল বন্ধুতাও। দু’ জনের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ছিল ভিন্ন। একজন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মহারাষ্ট্রের অধিবাসী আর একজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (সাল ১৯৪২) জাপানি সেনার ভয়ে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরের ভিটেমাটি ছেড়ে, বলা ভালো জমিদারি ছেড়ে বাবা-মার সঙ্গে কলকাতা, আসাম হয়ে বম্বের দাদারের এক চিলতে ফ্ল্যাটে ওঠেন। তখন বারো বছর বয়সী গীতার মনের আরাম আর আশ্রয় শুধু গানে।
দশ ভাইবোনের পঞ্চম তিনি আর তাদের ঘেঁষাঘেঁষির সংসার। বাঙালি হাই স্কুলে পড়তে শুরু করলেও পড়ায় মন ছিল না, মন ছিল গানে। মীনা কুমারীর মতো ধ্বস্ত শৈশব তাঁর না হলেও খানিক ধ্বস্ত কৈশোরের সাক্ষী ছিলেন তিনি। তাই ছোটবেলায় ফর্মাল ট্রেনিং হিসেবে যে গান আত্মীয় হরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে শিখেছিলেন সেই গান তিনি শেখাতে শুরু করলেন উপার্জনের স্বার্থে। কিন্তু বেশি দিন নয়, তাঁর তীক্ষ্ণ অথচ সুরেলা গলার গান পৌঁছায় সুরকার কে হনুমান প্রসাদের কানে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আবার শুরু হয় প্রথাগত শিক্ষা ও গ্রুমিং।

মহম্মদ রফির সঙ্গে।

১৯৪৬ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল, সেইসময় প্রসাদজির সুরে পৌরাণিক ছবি ভক্ত প্রহ্লাদে তিনি দুটি গানে দু’লাইন করে গাইলেন। সেই শুরু। গাওয়ার ধরন আর গলার সূক্ষ্ম কাজ অন্য সকলের পাশাপাশি মুগ্ধ করলো শচীন দেব বর্মনকে। তাঁর তত্ত্বাবধানে ও সুরে স্বাধীনতার বছরে ‘দো ভাই’ ছবিতে গীতা গাইলেন নয়টি গান। যার মধ্যে ‘মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া’ এবং ‘ইয়াদ করোগে ইয়াদ করোগের’ অপার সাফল্যর কারণে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যতটুকু ফিরে তাকাতে হয়েছিল তা শুধুই মানবিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। গানের দিক থেকে তিনি ছিলেন অনন্যা। পুরুষ প্রধান সুরকারদের মধ্যে দাপুটে নেপথ্য গায়িকা।

বন্ধু ও ননদ প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ললিতা লাজমি তাঁর স্মরণে বলেছিলেন, অজন্তার ফ্রেস্কো পেন্টিংয়ের মতো ছিলেন তাঁর গীতা বৌদি অথচ গলার দাপট ছিল স্পষ্ট। আঠারো বছর হতে না হতে ন’শো গান গেয়ে ফেলেন তিনি। হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, নেপালী সব ভাষায় সমান স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাঁর। রোমান্টিক থেকে ভক্তিগীতি থেকে ক্লাবের গান, কোনও কিছুই তাঁর অধরা ছিল না। ক্লাবের গান মানে সেই ইউরোপীয় ক্লাবের ধাঁচ আর পাশ্চাত্য ঘরানার রং-ঢং এ কোনও মহিলার গান যাতে শরীরী আবেদন স্পষ্ট।
আরও পড়ুন:

দশভুজাঃ দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর

বাইরে দূরে: বাংলা— ইতিহাস যেখানে ঘুমিয়ে আছে

খাই খাই: আজ একটু ভিন্ন স্বাদের রান্না করতে চান? তাহলে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন বিলেতি ধনেপাতা দিয়ে ভোলা মাছ

কিন্তু বাংলায় বা হিন্দিতে তেমন গান? তিনি গাইলেন ১৯৫৪ তে ওপি নাইয়ারের সুরে ‘বাবুজি ধীরে চল না’ আর ১৯৫৯-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘এই মায়াবী তিথি’। দেশ আগে যা শোনেনি তাই শুনলো। এই মায়াবী তিথিতে বাঙালি দর্শক দেখলো উত্তমকুমারের অস্বস্তি, বিব্রতভাব আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ। এই ঘরানার পথ তিনি আর আশা ভোঁসলে মিলে আরও প্রশস্ত করলেন। একই ছবি হাওড়া ব্রিজে (১৯৫৮) ওপি নাইয়ারের সুরে আশাজি গাইলেন ‘আইয়ে মেহেরবাঁ’ আর তিনি গাইলেন ‘মেরা নাম চিন চিন চু’।

বিয়েতে ললিতা লাজমি তাঁর ভাইকে সাজিয়েছিলেন।

যদিও শুরুটা আরও আগে হয়েছিল তাঁর কাকাকে দিয়ে। হ্যাঁ, ওই সম্বোধনই তিনি করতেন শচীন দেব বর্মনকে। ১৯৫১-তে সাহির লুধিয়ানভির ‘তদবির সে বিগড়ি হুই তকদির বনা লে’, যে গানকে শচীন দেব বর্মন গজল হিসেবে উপস্থাপিত করবেন ভেবেছিলেন তা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদল। গাইলেন গীতা রায়। ভাঙলেন সব রেকর্ড। তাঁর ভাই মুকুল রায় দিদির স্মরণে বলেছিলেন, অদ্ভুত সব ক্ষমতা ছিল তাঁর দিদির। অল্প সময় গীতিকার, সুরকারদের সঙ্গে কথা নিয়ে বসলেই অনায়াসে গাইতে পারতেন বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। দিনে ছ’টা গানও তিনি রেকর্ড করেছেন। রেকর্ডিংয়ের পর ভাইকে স্কুল থেকে নিয়ে চলে যেতেন কোনও সিনেমার প্রিমিয়ারে। অসম্ভব প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল, আবেগপ্রবণ আর জেনে, বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা যেন একটু বেশি ছিল অন্য সকলের থেকে। তাই ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যেই বিরাট মাপের স্টার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর তদবির সে বিগড়ি হুইর শুটিং দিয়ে নবকেতনের বাজি ছবির মহরত হয়েছিল। পরিচালনা ও চিত্রনাট্যের দায়িত্ব ছিলেন গুরু দত্ত।
আরও পড়ুন:

শসা খেতে না পসন্দ? তাহলে শরবত খান, উপকার পাবেন বেশি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১১: ভাগ্যের ফেরে হাস্যকর ‘লাখ টাকা’ [১০/০৭/১৯৫৩]

শরীরচর্চা: জিম-ট্রিম: আকর্ষণীয় ট্রাইসেপ চাই? রইল সহজ সমাধান

ইংলিশ টিংলিশ: সবাই যদি বলে ‘very beautiful’, তুমি বলে দ্যাখো ‘ravishing’ বা ‘magnificent’!

১৯৫১-তে রিলিজ হওয়া বাজির ছ’টা গানের মধ্যে ‘আজ কি রাত পিয়া’ এবং ‘শুনো গজর ক্যায়া গায়ে’ সুপারহিট হয়। গান পরিচালক ও গায়িকাকে কাছে আনে। গীতায় মুগ্ধ গুরু আদতে কর্ণাটকের মানুষ হলেও তাঁর ছোটবেলা কাটে কলকাতার ভবানীপুরে তাই ঝরঝরে বাংলায় কথা বলতে পারতেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিন বছরে দু’ জনের বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এইসময় প্যার, মশাল, বাহার, এক নজর, জীবন জ্যোতি, জাল, অরমান ছবিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গান গেয়ে ফেলেন গীতা।

বিয়ের রাত।

ললিতা লাজমির স্মরণে আজও তিনি উজ্জ্বল। লিমুজিনে চেপে হবু শ্বশুরবাড়িতে এসে রান্নাঘরে ঢুকে যেতেন রান্না করতে, কখনও আবার সবাইকে নিয়ে বেড়াতে চলে যেতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর নাম উচ্চারিত না হলেও সবাইকে আশ্চর্য করে ১৯৫৩-তে লড়কি ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন বাত চলত নাই চুনরি রং ডারি। ভৈরবী রাগের ওপর তখনকার নিয়ম অনুযায়ী চার মিনিটের মধ্যে বিলম্বিত, দ্রুত এবং তরানা সহ তিনি, মহম্মদ রফি ও কৃষ্ণারাও তিনজনে গেয়েছিলেন এই গান। এরপর শচীন দেব বর্মনের সুরে মুলতানি রাগের ওপর মহম্মদ রফির সঙ্গে লগ গয়ি আঁখিয়া তুমসে মোরিতে তাঁর প্রকাশ ছিল যথাযথ। রাগ ভৈরবী, টোডি, বৃন্দাবনী সারঙ্গ, দরবারি কানাড়াতে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য দেখান তিনি। বাঙালি কায়স্থ মেয়ের সঙ্গে কোঙ্কনি ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলের বিয়েতে প্রাথমিক আপত্তি উঠলেও গুরু-গীতার এক হওয়া দুই মনের দু’ হাত এক হয় ১৯৫৩-এর এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায়। সেই মধুর নিশিতে পুরো বম্বে ইন্ডাস্ট্রির সকলে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিগেস্ট ওয়েডিং এভার—বলা হয় সেই বিয়েকে। বাঙালি আচারে সম্পূর্ণ সেই বিয়েতে গীতার বাংলোর বাইরে গাড়ির লম্বা লাইন পড়েছিল। খুব সুখী দেখাচ্ছিল সেদিন দু’ জনকে কিন্তু সেই রাতে অদৃষ্ট যেন অলক্ষ্যে হেসেছিল।—চলবে

তথ্য ও ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত তেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —’বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রীণা মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content