গওহর। ছবি: সংগৃহীত।
সাল ১৯০২, কলকাতার এক হোটেলে অস্থায়ী স্টুডিও তৈরি করা হয়েছিল তাঁর জন্য। তিনি গাইবেন এবং সেই গান রেকর্ড করা হবে। তিনি প্রবাদপ্রতিম সংগীত শিল্পী গওহর জান। সেই প্রথম ভারতে কোনও সংগীত শিল্পীর গান গ্রামাফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেড (GTL) রেকর্ড করবে বলে স্থির করে। নেপথ্য কাহিনি ছিল অন্যরকম। এইসময় গ্রামাফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেডের রেকর্ডিস্ট উইলিয়াম ফ্রেডরিক গেইসবার্গ কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে তাদের স্থানীয় কার্যালয় খুলতে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় আসার পর ব্রিটিশ সংগীত বোদ্ধা ফ্রেডরিক এক বাঙালি বাবুর গানের আসরে নিমন্ত্রণ পান। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি সেই সময়ের কলকাতার জনপ্রিয়তম শিল্পী গওহর জানের গান শোনেন। গওহরের গান তাঁর পুরো সফর বদলে দেয়। গওহর জান সেই সময় দশেরও অধিক ভাষা জানতেন এবং গাইতে পারতেন হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল থেকে দেশজ সব রকমের গান।
১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর তিনি কালো রঙের সুসজ্জিত পোশাকে পরিচারক ও সংগতের লোকজনদের নিয়ে হোটেলের সেই অস্থায়ী স্টুডিওতে জীবনের প্রথম গান রেকর্ড করতে উপস্থিত হন। টেবিলে উঠে, রেকর্ডিং হর্ন পরে তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে গান গাইতে বলা হয়, যাতে তখনকার মাস্টার শেলাক ডিস্কে গানটি রেকর্ড করা যায়। তিন মিনিটের মধ্যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের উপযোগী কিছু তাঁকে গাইতে বলা হয়। নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তিনি তা করেন আর রেকর্ডিং এর শেষে বলে ওঠেন—মাই নেম ইজ গওহর জান! এ ভাবে বলা তাঁর সমস্ত রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে বিশেষ লাভদায়ক হয়ে ওঠে। প্রথম দিকের রেকর্ডিংগুলোর মধ্যে তাঁর গুরুভাই গণপত রাও রচিত রাগ সোহিনীর ঠুমরী বিশেষ জনপ্রিয় হয়।
আরও পড়ুন:
রিভিউ: মধ্যমানের ভিএফএক্স আর সবাইকে সন্তুষ্ট করতে যাওয়াই কাল হল আদিপুরুষের
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে গানের শেষে এইভাবে শিল্পীর নিজের নাম বলা আবশ্যিক ছিল কারণ ভারত থেকে গান রেকর্ড হয়ে সেই সময় রেকর্ডগুলো জার্মানির হানোভার শহরে যেত প্রসেসিং এর জন্য। সেখানকার টেকনিশিয়ানরা অপরিচিত শিল্পীদের গানের শেষে তাঁদের নামের উচ্চারণ দিয়ে চিনে, লেবেল লাগিয়ে ভারতে পাঠাতো বিক্রির জন্য। গওহরের সেই উচ্চৈঃস্বরে, সুশিক্ষিত, সম্মোহনী গান শুধু যে দেশের মধ্যে তা নয়, ভারতের বাইরেও শাস্ত্রীয় সংগীতের দরজা খুলে দেয়। যে গান ছিল গণিকা পরিসর এবং ধনী সম্প্রদায়ের সান্ধ্যবাসরের সাধন তা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। গওহর হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের প্রথম শিল্পী যার গান রেকর্ড করা হয়। সেই যুগে তিনি তাঁর গান রেকর্ড করার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে তিন হাজার টাকা নেন আর তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি এবং জনপ্রিয়তার কারণে জিটিএল তাঁর এই দাবি মেনে নেয়।
সুইডেন, অস্ট্রিয়া থেকে তৈরি হয়ে আসা দেয়াশলাইয়ের বাক্সের ওপর তাঁর ছবি থাকতো। ছবি: সংগৃহীত।
এইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড এই ছিল জন্মসূত্রে গওহরের নাম। ১৮৭৩ সালের ২৬ জুন উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের এক ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। গওহরের ঠাকুরমা ও ঠাকুরদা ছিলেন যথাক্রমে হিন্দু এবং ব্রিটিশ। বাবা রবার্ট ইয়ার্ড ছিলেন আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান এবং স্থানীয় বরফকলের ইঞ্জিনিয়ার। মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস ব্রিটিশ পরিবারভুক্ত হলেও আদতে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত। অ্যাঞ্জেলিনার বয়স যখন মাত্র ছয় তখন খুব বাজে ভাবে তাঁর বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা ভিক্টোরিয়া তখন তাঁর বন্ধু, হিতকরী খুরশিদের সহায়তায় মেয়েকে নিয়ে বেনারসে চলে আসেন। সেখানে ইসলাম গ্রহণ করে মা ভিক্টোরিয়া নিজের নাম রাখেন বড়ি মলকা জান আর মেয়ের নাম রাখেন গওহর জান। ভারতে তখন আরও তিনজন মলকা জান বিখ্যাত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় হওয়ায় নিজের নামের আগে ‘বড়ি’ বসিয়ে নেন গওহরের মা। বেনারসে থাকাকালীন কত্থক নাচ এবং গানের জন্য বিখ্যাত হন মা মলকা জান।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন
সাল ১৮৮৩, গওহরের মা পাকাপাকি ভাবে তাঁকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে তখন সংগীতপ্রেমী নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের উপস্থিতির কারণে গান বাজনার মানচিত্রে কলকাতার কদর বাড়ে। প্রায় পুরো উত্তর ভারত থেকে শিল্পীরা কলকাতায় পাড়ি জমাতে শুরু করেন। পেশায় গায়িকা মলকা জান নবাবের ব্যক্তিগত অনুরাগিনী ও নর্তকী হিসেবে পরিচিতি পান। তিন বছরের মধ্যে তিনি চিৎপুর রোডে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে নিজের বাড়ি কেনেন। এইসময় গওহর পাতিয়ালা ঘরানার কালু খান বা কালু উস্তাদ ও উস্তাদ আলি বক্সের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত এবং কিংবদন্তি শিল্পী বৃন্দাদিন মহারাজের কাছে কত্থক শিখতে শুরু করেন।
এছাড়া চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তন শেখেন, রবীন্দ্রসংগীতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। গওহর সেইসময় ‘হমদম’ এই ছদ্মনামে গজল লিখতে ও সুর দিতে শুরু করেন। সংগীতের আরও নানা ধরন যেমন ধ্রুপদ, টপ্পা, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, দাদরা, চৈতি, গজল, ধামার, বিষ্ণুপুরী এবং কাজরি গানে পারদর্শী হয়ে ওঠেন গওহর। কর্মজীবনে তিনি দশেরও বেশি ভাষায় প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড করেন।
এছাড়া চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তন শেখেন, রবীন্দ্রসংগীতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। গওহর সেইসময় ‘হমদম’ এই ছদ্মনামে গজল লিখতে ও সুর দিতে শুরু করেন। সংগীতের আরও নানা ধরন যেমন ধ্রুপদ, টপ্পা, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, দাদরা, চৈতি, গজল, ধামার, বিষ্ণুপুরী এবং কাজরি গানে পারদর্শী হয়ে ওঠেন গওহর। কর্মজীবনে তিনি দশেরও বেশি ভাষায় প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড করেন।
মা মলকা জানের সঙ্গে গওহর। ছবি: সংগৃহীত।
হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যালের ক্ষেত্রে পারম্পরিক ‘খেয়াল’ গানের বিস্তার করাই রীতি কিন্তু গওহর জান সেই গানকে তিন মিনিটেরও কম সময়ে গাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। কিছু সেকেন্ডের মধ্যে আলাপ সেরে নিয়ে স্থায়ীর মুখড়াকে কয়েকবার নানাভাবে গেয়ে অন্তরায় চলে যাওয়া এই পদ্ধতির মধ্যেও তিনি পরিবর্তন আনেন। পরিবর্তিত বন্দিশের দ্রুতগামী আভাস দিয়ে তান-সরগমে চলে যাওয়া ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। রাগ মালকোষের ‘কৃষ্ণ মাধো রাম নারায়ণ’ এইভাবে গেয়ে তিনি সকলকে অবাক করেন। এর মধ্যে গেইসবার্গের দেওয়া চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে তৎকালীন বিখ্যাত গায়িকা সুজান অ্যাডামসের মতো করে এক নিঃশ্বাসে গেয়েছিলেন সুর কি মলহার।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৫: আমাদের নাকি রোজই চুল পড়ে!
গানের আসরে গওহরের প্রথম অভিষেক ঘটে যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পনেরো। তাঁর প্রথম পরিবেশনাতেই বিহারের দারভাঙ্গা দরবারের কর্তারা এত মুগ্ধ হন যে কদিনের মধ্যে তাঁকে দরবারের প্রধান সংগীত ও নৃত্য শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ধীরে ধীরে রাজা ও জমিদারদের এবং কলকাতার মহফিলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ঠুমরী গাইতে গাইতে তাঁর নৃত্য পরিবেশন খুবই সমাদৃত হয়। এছাড়া ভারতের স্টেট রাজসভাগুলো থেকেও একের পর এক ডাক, এমনকি রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষের সময়েও দিল্লি থেকে বিশেষ আমন্ত্রণ আসে গওহরের জন্য। আর এই সুবাদে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে পর্বতসম হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর উন্নাসিক মনোভাব ও উচ্ছ্বসিত প্রকৃতি তাঁকে সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করেছিল। সবসময় ভারী গয়না এবং এমব্রয়ডারি করা শাড়ি তাঁকে সেইসময় আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করেছিল।
নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। ছবি: সংগৃহীত।
সেই সময় কলকাতায় সাধারণ জনগণের জন্য ঘোড়ায় চড়া নিষিদ্ধ ছিল। তিনি গওহর তাই ভাইসরয়কে দিনে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কলকাতার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতেন। নিজের পোষা বিড়ালের বাচ্চা হওয়ায় তিনি কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে এলাহি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেন। কিন্তু এত খ্যাতি, প্রশংসা, সাধনার মধ্যেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। বেনারসের ছগন রাই এবং নিমাই সেনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সেসব সম্পর্ক কোনও পরিণতি পায়নি। বম্বেতে গুজরাতি থিয়েটারের বিখ্যাত অভিনেতা অমৃত কেশব নায়কের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলেও কেশবের অকালমৃত্যুতে সেই সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। কেশবের সৃষ্টিতে তাঁর গাওয়া একটি ‘দাদরা’ (আন বান জিয়া মে লগি) খুব জনপ্রিয় হয়। মূল রাগ ছিল ‘গারা’।
কিশোরী গওহর। ছবি: সংগৃহীত।
এরপর খানিক ভাগ্যের সঙ্গে আপোষ করে তিনি ব্যক্তিগত সহযোগী ও তবলিয়া আব্বাসের সঙ্গে বিবাহ করেন। এই এক সিদ্ধান্ত তাঁকে অখ্যাতি ও অন্ধকারে নিয়ে যায়। সম্পর্কে ছোট আব্বাস বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ও স্ত্রীর সম্পত্তি দেদার নষ্ট করেন। আব্বাসের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা, বিখ্যাত আইনজীবীদের পারিশ্রমিক মেটাতে গিয়ে সর্বশান্ত হন গওহর। সে সময় মহীশূরের মহারাজা নলবাডি কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ার গওহরের পাশে দাঁড়ান এবং তাঁর রাজদরবারে সংগীত শিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ততদিনে তিনি লড়াই করার সমস্ত ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেন। অবশেষে ১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মহীশূরের কেআর হাসপাতালে এই বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে, রেখে যান শাস্ত্রীয় ঘরানার গান গাওয়া ও উপস্থাপনের ভঙ্গি, যা আজও বহু বিখ্যাত গায়িকার অনুকরণ ও আশ্রয়ের আধার হয়ে থেকে গিয়েছে।
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।