রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: সংগৃহীত।

সাল ১৯৯৭, তাঁর পোস্টিং হল কাশ্মীরের রজৌরি ও পুঞ্চ জেলায়। বিভাগ: আতঙ্কবাদী দমন শাখা। কাজ মানে যেভাবে হোক সবরকম বিপদ এড়িয়ে সিনিয়রদের কাছে আতঙ্কবাদীদের খবর এনে দেওয়া। সেই খবরের ভিত্তিতে তাঁর সিনিয়ররা এনকাউন্টারে যাবেন, কিন্তু তিনি যাবেন না। কারণ তিনি একজন মহিলা। তিনি শাহিদা পরভিন। এখন তিনি ডিএসপি শাহিদা পরভিন। একসময় জম্মু ও কাশ্মীরের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের (এসওজি) অন্যতম প্রথম ও প্রধান মহিলা কম্যান্ডো ছিলেন তিনি।
শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ১৯৯৫ সালে সাব-ইনস্পেক্টর পদে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। চার বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারান। তাঁর মা তাঁদের ছয় ভাইবোনকে যেভাবেই হোক পড়াশোনা করিয়েছিলেন। শাহিদা অঙ্কে স্নাতক হওয়ার পর জম্মুর এক বেসরকারি স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুতেই মনের শান্তি পাচ্ছিলেন না। মনে ছিল দেশের জন্য আরও বড় কিছু করার। যদিও খুব সদর্থক পরিবেশে তিনি মানুষ হননি।

ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম প্রথম তাঁর বাড়ির সবাই ভাবতেন লোকে কী বলবে? ভোরবেলা উঠে মেয়ে দৌড়তে যায়! তারা তো বুঝবে না যে মেয়ে পুলিশের চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তিনি কোনওদিন অন্যের কথায় গুরুত্ব দেননি। চাকরিতে যোগদানের আগে এবং পরে নিজের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে গিয়েছেন। প্রথমে উধমপুরের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে দু’ বছর তাঁর প্রশিক্ষণ চলে।
আরও পড়ুন:

যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

পুরুষ প্রধান ছিল তাঁর বিভাগ। সেই সময় আতঙ্ক দমন শাখায় মহিলা পুলিশদের ফিল্ড ডিউটি দেওয়ার চল ছিল না। এখনও অনেকটাই তাই। প্রথম থেকে এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করেন তিনি। তাঁর মতে ডিউটি তো ডিউটিই, তার আবার পুরুষ-মহিলা কী? প্রথম প্রথম তাঁকে শুধু কাশ্মীরের আতঙ্কবাদী অধ্যুষিত এলাকা থেকে আতঙ্কবাদীদের খবর আনার জন্য নিয়োগ করা হতো। প্রথম চেষ্টাতেই তিনি খবর জোগাড় করতে সমর্থ হন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন, যে খবর জোগাড় করার জন্য তিনি তিন চার মাস প্রাণপাত করেছেন সেই খবর সিনিয়রদের না দিয়ে নিজেই এর ওপর কাজ করবেন।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ, এই ভেবে তিনি তাঁর টিম নিয়ে জীবনের প্রথম এনকাউন্টারে এগিয়ে যান। সেই যাত্রায় তিনি অসফল হন। উর্ধ্বতন পুরুষ অফিসারদের মধ্যে এই খবর জানাজানির পর কেউ তাঁর কাজে গর্বিত হন, কেউ আবার বলেন, ‘এটা কি মহিলা সুলভ কাজ? পুরুষ মানুষের কাজে (এক্ষেত্রে এনকাউন্টারে যাওয়া) হাত দিলে এই অবস্থাই হবে। হালকা ডিউটি করে রান্নাঘরের (চুলা-চক্কি) কাজ করবে, বাসন মাজবে, তা না এনকাউন্টার!’
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯: নুনিয়া

ডায়েট ফটাফট: ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কী কী ফল খাবেন, আর কোনগুলি এড়িয়ে চলবেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

কথাগুলো হালকাভাবে শাহিদা নেননি। বরং গায়ে মেখে নেন। প্রতিজ্ঞা করেন, শুধু নিজের রাজ্য নয়, গোটা দেশ, পুরো পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবেন, একজন মহিলা কি করতে পারেন। এরপর তিনি আর ফিরে তাকাননি। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট হিসেবে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

ছবি: সংগৃহীত।

১৯৯৭ থেকে ২০০২ পাঁচ বছর শাহিদা রজৌরি ও পুঞ্চে কর্মরতা ছিলেন। এক ইন্টারভিউতে তিনি জানান, ওই সময়ে মৃত্যুভয়ে তিনি কখনও ভীত হননি। যেকোনও মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন তিনি। সেই সময় একে-৪৭ এর পাশাপাশি তিনি সঙ্গে একটা পিস্তল রাখতেন। মাথায় সবসময় থাকতো যে যদি কখনও ধরা পড়ে যান, তাহলে ওই পিস্তল দিয়ে নিজের প্রাণ নিতে পারবেন। রোজ বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির চালককে গান চালাতে বলতেন, কারণ পরের দিন বেঁচে ফেরার নিশ্চয়তা থাকতো না।
আরও পড়ুন:

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

এইরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন তিনি কাজ করে গিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন দেশের অন্যতম সেরা এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট। মূল কাজই ছিল, রজৌরি ও পুঞ্চ জেলা থেকে হিজবুল ও লস্কর জঙ্গিদের নির্মূল করা। টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তিনি কখনও গোনেননি যে কতজন। কিন্তু পাঁচ বছর টানা তিনি ওই একই কাজ করে গিয়েছেন।

ছবি: সংগৃহীত।

২০০০ সালে শাহিদার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর বিভাগ তাঁকে প্রমোশন দিতে চাইলেও তিনি নেননি। তিনি জানান, যতদিন না তাঁর দলের প্রত্যেক সদস্যকে সমমর্যাদা দেওয়া হচ্ছে ততদিন তিনি প্রমোশনই নেবেন না। ২০০২ সালে তাঁকে তাঁর অসম বীরত্বের জন্য রাষ্ট্রপতি পুলিশ মেডেল দেওয়া হয়। সেই বছর আর্মি অফিসার গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এই সময় তাঁকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিএসপি শাহিদা পরভিন, দুই সন্তানের জননী প্রত্যয়ী শাহিদা বলেন, ‘একজন মা এবং স্ত্রীর কর্তব্যের পাশাপাশি ‘সিস্টেম’ আমাকে যেভাবে চাইবে সেভাবে আমি নিজের কাজ করে যাব’।
* দশভুজা (women – Special Article) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content