কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সেকালের মহীয়সী নারীরা, যাঁরা আগামী প্রজন্মের নারীদের পথ চলার অন্যতম পাথেয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক যিনি ছিলেন উনিশ শতকীয় পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতার বিরূদ্ধে এক দৃষ্টান্তমূলক বৈপ্লবিক প্রতীক। ‘দশভুজা’-র বিশেষ বিভাগ ‘অনন্যা’-তে আমাদের আজকের বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি।
উনিশ শতক, নবজাগরণের যুগ, আলোকোজ্জ্বল নগরজীবনের জাঁকজমকপূর্ণ সূচনালগ্নে আমাদের তিলোত্তমা কলকাতা তখন মত্ত অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ডদের অর্ধশিক্ষিত অহমিকার আড়ম্বরে, বাবু সংস্কৃতি সমৃদ্ধ কবিগান, তরজা, বুলবুলির লড়াই আর মেছোবাজার-চোরবাগানের গণিকালয়ের নিক্বণধ্বনিতে সন্ধ্যার শহর যখন ব্র্যান্ডির নেশায় নেশাচ্ছন্ন, তখনই অপরদিকে হিন্দুত্ববাদের পুনর্নির্মাণ কালে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যার সাধনার পাশাপাশি উত্থান ঘটছে রাধামোহন দেবদের মতো অন্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদ পরিপুষ্ট কৌলীন্যবাদের, যে কৌলীন্যবাদের শিকার পাঁচ থেকে আরম্ভ করে পঁচিশ সমস্ত বয়সের মেয়েরাই। লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর আনুকূল্যে, রামমোহনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে সতীদাহপ্রথা বন্ধ হলেও, গৌরীদান থেকে আরম্ভ করে বিধবাদের দুর্দশা, পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা থেকে সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা সবই বিদ্যমান ছিল এই ‘নবজাগরণ’-এর কালে। আরও কিছুকাল পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রবল প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ, নারী শিক্ষা আপাতদৃষ্টিতে চালু হলেও নারীর শিক্ষা, নারীর অভিজাত্য সবই নির্মিত হত পুরুষের প্রয়োজনের অনুপাতে। পুরুষের আয়তনে নারীকে গড়ে নেওয়ার এই ভয়ানক প্রবণতা কিন্তু পুঁজিবাদের সূচনালগ্ন থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, যে প্রবণতা আজও আমাদের সমাজে এক ভয়ানক আগ্রাসী কীটের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতর থেকে। নারীর শিক্ষা হবে পুরুষের পাশে, ‘স্বামী’ তথা ‘প্রভু’র পাশে যথাযথভাবে মানানসই হয়ে ওঠার জন্য, তার কোনও পৃথক ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে না। সমাজে ব্যক্তি হিসাবে নারীকে দেখার অভ্যাস ছিল না কখনওই। তবে এই প্রথাগত অভ্যাসের বিরুদ্ধাচরণ যে কেউ করেননি তা কিন্তু নয়। পুরুষের ছাঁচের বাইরে বেরিয়ে নিজের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় গড়ে নেওয়ার কাজেও কিন্তু ব্রতী হয়েছেন তৎকালীন বহু বিদুষী, ওই সময়ে দাঁড়িয়েই। এই সমস্ত বিদুষীর মধ্যেই চিরকালীন অনন্যা তিনি, যার ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে, অকুতোভয়চিত্তে বলতে ইচ্ছা করে–
‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।’
তিনি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। কেবল বাঙালি বা ভারতীয় নন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক তিনি। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (বিয়ের আগে ছিলেন কাদম্বিনী বসু) এবং আনন্দীবাই গোপালরাও জোশী, উভয়েই ছিলেন যুগ্মভাবে প্রথম মহিলা চিকিৎসক যারা পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভের পাশাপাশি চিকিৎসক হিসাবে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতাও অর্জন করেন সমানভাবে। ১৮৬১ সন বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নীলরতন সরকার, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মসাল হিসাবে, এঁদের পাশাপাশি এই নির্দিষ্ট সালটির গৌরবপূর্ণ অধ্যায়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছিল আরও একজনের জন্মতিথি, তিনি হলেন ড. কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাবার সহায়তাতেই উচ্চশিক্ষার জন্য কাদম্বিনী কলকাতায় আসেন এবং ভর্তি হন কলকাতার হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে (যার পরবর্তীকালে নাম হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়)। এরপরেই আসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার পালা আর লড়াই আরম্ভ এখান থেকেই। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে পুরুষ ও পৌরুষের বিদ্যাচর্চার পটভূমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মহিলা শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নৈব নৈব চ। লড়ে গেলেন শিক্ষক এবং পরবর্তীকালে স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়৷ প্রবল লড়াইয়ের পরে সাফল্যও আসে। পরীক্ষায় বসেন কাদম্বিনী এবং ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। তার সঙ্গে পরীক্ষায় বসেছিলেন দেরাদুন থেকে আগত বাঙালি খ্রিস্টান চন্দ্রমুখী বসুও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হন বেথুন কলেজে। ডিরেক্টর অব পাব্লিক ইনস্ট্রাকশন-এ ডব্লিউ ক্রফট-এর শিক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলকে রূপান্তরিত করা হয় কলেজে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেথুন কলেজ আরম্ভ হয় একজন ছাত্রী ও একজন লেকচারার নিয়ে। সাড়া পড়ে যায় শিক্ষামহলে। এখান থেকে ১৮৮২ সালে তিনি এবং চন্দ্রমুখী বসু পলিটিক্যাল ইকনোমিকসে স্নাতক হন। ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই গ্র্যাজুয়েট নারী যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য এক সমুদ্র মানুষের ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পরিধি ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল ট্রামলাইন পর্যন্ত। কাদম্বিনীর কৃতিত্বের খবর পৌঁছে গিয়েছিল লেডি লিটনের কাছ পর্যন্ত, লেডি লিটনের কাছ থেকে পুরস্কৃতও হন তিনি। এরপরেই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, মেডিক্যাল কলেজের প্রথম মহিলা শিক্ষার্থী হিসাবে কাদম্বিনী ১৮৮৪ সালে ভর্তি হলেন চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নে ব্রতী হয়ে। এই বছরই একুশ বছরের কাদম্বিনী বিয়ে করেন তার শিক্ষক বিখ্যাত সমাজসেবক ও মানবদরদি সাংবাদিক ৩৯ বছর বয়সি বিপত্নীক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়-কে। ভারতের মতো দেশে একজন মহিলা সেইসময়ে ডাক্তারি পড়ার সাহস দেখাবেন আর তাঁকে আধিপত্যকামী পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতার শিকার হতে হবে না এমনটা যদি হত তাহলে তো এই দেশের চিত্রটাই আগাগোড়া অন্যরকম হত।
‘বঙ্গবাসী’ কাগজে কাদম্বিনীকে ব্যঙ্গ করে প্রকাশিত হয় কার্টুনচিত্র, যেখানে দেখানো হয় স্বামী দ্বারকানাথকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কাদম্বিনী। বঙ্গবাসী কাগজের সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের এই বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে কিন্তু সেই সময়ে সরব হয়েছিলেন নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। আদালতে মহেশবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগও করেন তাঁরা, বিচারে মহেশবাবুর ছ’মাসের জেল এবং একশো টাকা জরিমানা হয়। কেবল এতেই থেমে থাকেনি নিগ্রহ, তাঁকে মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে তার শিক্ষকের তরফ থেকেও। মেডিক্যাল কলেজের এক বাঙালি শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে মেটেরিয়া মেডিকা ও তুলনামূলক শরীরবিদ্যা নামক দুটি পত্রে তাকে ফেল করিয়ে দেন। ফলস্বরূপ পাওয়া হল না এমবি ডিগ্রি। তার পরিবর্তে তাঁকে দেওয়া হয় ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা ‘জিএমসিবি সার্টিফিকেট’। কিন্তু সান্ত্বনা পুরস্কারে ভোলার পাত্রী তিনি ছিলেন না৷ ইডেন হাসপাতালে কাজের সুযোগ ছেড়ে দেন অবলীলায়৷ কারণ সেখানে তার এমবি’ডিগ্রি না থাকার কারণে তাঁকে নার্সের মর্যাদায় চাকরি করতে হত। কাদম্বিনীর লক্ষ্য তখন পাখির চোখের দিকে। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন স্কলারশিপ পেতেন মাসিক কুড়ি টাকা। ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ ১৮৮৮ সালে কিছুকাল তিনশো টাকা মাইনেতে চাকরি করেন ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে। এর কিছুদিন পরেই বাড়িতে আট সন্তানকে রেখে রওনা হয়ে যান ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ছোটটি তখনও মাকে চিনতেও শেখেনি। সঙ্গী বলতে মিস প্যাশ নামের একজন বিদেশিনি। তিন মাসের মধ্যে অর্জন করেছিলেন চিকিৎসক হিসাবে LRCP, LRCS এবং GFPS ডিগ্রি। ১৮৯৩ সালে তিনি ডাক্তারি পাশ করেন এবং এডিনবরার পাশাপাশি গ্লাসগো ও ডাবলিন থেকেও মোট তিনটি ডিপ্লোমা হাসিল করেন। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবং আনন্দীবাই গোপালরাও জোশী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। ভারতবর্ষ যেন সেইদিন এক অন্য সকাল নিরীক্ষণ করল। খুলে গেল মহাসমুদ্রের দ্বার। মানুষের সেবা করার অধিকার হাসিল করার জন্য কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পরে কনিষ্ঠতম সন্তান চিনতে পারেননি মাকে, কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু পুনরায় আশায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। যে হাতে একের পর এক অস্ত্রোপচার করতেন সেই হাতেই অনবরত লেস বুনে যেতেন। হ্যাঁ, এক রোগী থেকে অন্য রোগীর বাড়ি যাওয়ার সময়টুকুতে ফিটনে লেস বুনতে বুনতে যেতেন, সীমিত অবসরে ওইটেই ছিল ভালোবাসা। ১৮৯৮ সালের ২৭ জুন ছেড়ে চলে গেলেন বাবা ও পিসতুতো দাদার পরেই যিনি ছিলেন আজীবন সমস্ত লড়াইয়ের সঙ্গী, সহযোদ্ধা, ভালোবাসার মানুষ স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রবল শোক নিজের ভেতরে বহন করেও সেইদিন বিকালে এক জমিদারবাড়িতে গিয়েছেন সন্তান প্রসব করাতে। কোনও শোকই তাঁকে তাঁর কাজ থেকে, তাঁর পেশাদারিত্ব থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি কখনও।
চিকিৎসক ছাড়াও তাঁর আরও একটি বিশিষ্ট পরিচয় ছিল। ১৮৮৯-তে বোম্বাই-কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম ছয় নারীর মধ্যে কাদম্বিনী ছিলেন অন্যতম।পরের বছর কলকাতায় কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। পাশাপাশি স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন একজন অন্যতম কাণ্ডারি। বিবাহিত জীবনে সন্তান ধারণ করেও মাত্র তোরোদিন কলেজ কামাই করেছিলেন, মিস করেননি একটা লেকচারও। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন সুদূর বিলেতে বসে ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল। মিস ‘লেডি অব দ্য ল্যাম্প’ উৎসুক চিত্তে তার এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন ভারতের মতো দেশের বুকে কে এই বিস্ময় রমণী। কাদম্বিনীর সৎ কন্যা বিধুমুখী দেবী ছিলেন লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদার তাঁর রচিত ‘পাকদণ্ডী’ উপন্যাসে কাদম্বিনী সম্পর্কে বলেছিলেন—’তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হত অনেকটা ছোট। মস্ত দশাসই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রঙ, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটু কড়া ধরনের ভাব আমরা দেখতাম দূর থেকে। ১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।’
ভারতবর্ষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা পথ। মহিলারা এখন প্লেন চালাচ্ছেন, চাঁদে যাচ্ছেন কিন্তু আজও দেশের আনাচেকানাচে নারী নিগ্রহ, নারীর অবমাননা চলছে৷ আয়োজনও যেন চলছে সাড়ম্বরেই। ধর্ষিতা নারীর ধর্ষণের দায় তার পোশাকের, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে আঙুল উঠবে নারীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার দিকে, নারী সহ্য করবে, নারী লজ্জা পাবে, নারীর একা থাকা বারণ, নারীর সন্তানের পিতৃপরিচয় আবশ্যক। আরও কত কত কাঁটাতার এখনও অনবরত পেরোতে হচ্ছে নারীদের। হতাশা যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন মনে পড়ে উনিশ শতকে তথাকথিত নবজাগরণের আলো থেকে দূরে একাকী দাঁড়িয়ে আজীবন লড়ে যাওয়া এই প্রবল ব্যক্তিত্বময়ীর কথা। তাই তো তাঁর অনুপস্থিতি, তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও মনে হয় যেন তিনি অনবরত বলে চলেছেন—
‘বঙ্গবাসী’ কাগজে কাদম্বিনীকে ব্যঙ্গ করে প্রকাশিত হয় কার্টুনচিত্র, যেখানে দেখানো হয় স্বামী দ্বারকানাথকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কাদম্বিনী। বঙ্গবাসী কাগজের সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের এই বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে কিন্তু সেই সময়ে সরব হয়েছিলেন নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। আদালতে মহেশবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগও করেন তাঁরা, বিচারে মহেশবাবুর ছ’মাসের জেল এবং একশো টাকা জরিমানা হয়। কেবল এতেই থেমে থাকেনি নিগ্রহ, তাঁকে মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে তার শিক্ষকের তরফ থেকেও। মেডিক্যাল কলেজের এক বাঙালি শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে মেটেরিয়া মেডিকা ও তুলনামূলক শরীরবিদ্যা নামক দুটি পত্রে তাকে ফেল করিয়ে দেন। ফলস্বরূপ পাওয়া হল না এমবি ডিগ্রি। তার পরিবর্তে তাঁকে দেওয়া হয় ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা ‘জিএমসিবি সার্টিফিকেট’। কিন্তু সান্ত্বনা পুরস্কারে ভোলার পাত্রী তিনি ছিলেন না৷ ইডেন হাসপাতালে কাজের সুযোগ ছেড়ে দেন অবলীলায়৷ কারণ সেখানে তার এমবি’ডিগ্রি না থাকার কারণে তাঁকে নার্সের মর্যাদায় চাকরি করতে হত। কাদম্বিনীর লক্ষ্য তখন পাখির চোখের দিকে। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন স্কলারশিপ পেতেন মাসিক কুড়ি টাকা। ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ ১৮৮৮ সালে কিছুকাল তিনশো টাকা মাইনেতে চাকরি করেন ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে। এর কিছুদিন পরেই বাড়িতে আট সন্তানকে রেখে রওনা হয়ে যান ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ছোটটি তখনও মাকে চিনতেও শেখেনি। সঙ্গী বলতে মিস প্যাশ নামের একজন বিদেশিনি। তিন মাসের মধ্যে অর্জন করেছিলেন চিকিৎসক হিসাবে LRCP, LRCS এবং GFPS ডিগ্রি। ১৮৯৩ সালে তিনি ডাক্তারি পাশ করেন এবং এডিনবরার পাশাপাশি গ্লাসগো ও ডাবলিন থেকেও মোট তিনটি ডিপ্লোমা হাসিল করেন। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবং আনন্দীবাই গোপালরাও জোশী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। ভারতবর্ষ যেন সেইদিন এক অন্য সকাল নিরীক্ষণ করল। খুলে গেল মহাসমুদ্রের দ্বার। মানুষের সেবা করার অধিকার হাসিল করার জন্য কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পরে কনিষ্ঠতম সন্তান চিনতে পারেননি মাকে, কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু পুনরায় আশায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। যে হাতে একের পর এক অস্ত্রোপচার করতেন সেই হাতেই অনবরত লেস বুনে যেতেন। হ্যাঁ, এক রোগী থেকে অন্য রোগীর বাড়ি যাওয়ার সময়টুকুতে ফিটনে লেস বুনতে বুনতে যেতেন, সীমিত অবসরে ওইটেই ছিল ভালোবাসা। ১৮৯৮ সালের ২৭ জুন ছেড়ে চলে গেলেন বাবা ও পিসতুতো দাদার পরেই যিনি ছিলেন আজীবন সমস্ত লড়াইয়ের সঙ্গী, সহযোদ্ধা, ভালোবাসার মানুষ স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রবল শোক নিজের ভেতরে বহন করেও সেইদিন বিকালে এক জমিদারবাড়িতে গিয়েছেন সন্তান প্রসব করাতে। কোনও শোকই তাঁকে তাঁর কাজ থেকে, তাঁর পেশাদারিত্ব থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি কখনও।
চিকিৎসক ছাড়াও তাঁর আরও একটি বিশিষ্ট পরিচয় ছিল। ১৮৮৯-তে বোম্বাই-কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম ছয় নারীর মধ্যে কাদম্বিনী ছিলেন অন্যতম।পরের বছর কলকাতায় কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। পাশাপাশি স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন একজন অন্যতম কাণ্ডারি। বিবাহিত জীবনে সন্তান ধারণ করেও মাত্র তোরোদিন কলেজ কামাই করেছিলেন, মিস করেননি একটা লেকচারও। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন সুদূর বিলেতে বসে ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল। মিস ‘লেডি অব দ্য ল্যাম্প’ উৎসুক চিত্তে তার এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন ভারতের মতো দেশের বুকে কে এই বিস্ময় রমণী। কাদম্বিনীর সৎ কন্যা বিধুমুখী দেবী ছিলেন লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদার তাঁর রচিত ‘পাকদণ্ডী’ উপন্যাসে কাদম্বিনী সম্পর্কে বলেছিলেন—’তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হত অনেকটা ছোট। মস্ত দশাসই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রঙ, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটু কড়া ধরনের ভাব আমরা দেখতাম দূর থেকে। ১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।’
ভারতবর্ষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা পথ। মহিলারা এখন প্লেন চালাচ্ছেন, চাঁদে যাচ্ছেন কিন্তু আজও দেশের আনাচেকানাচে নারী নিগ্রহ, নারীর অবমাননা চলছে৷ আয়োজনও যেন চলছে সাড়ম্বরেই। ধর্ষিতা নারীর ধর্ষণের দায় তার পোশাকের, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে আঙুল উঠবে নারীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার দিকে, নারী সহ্য করবে, নারী লজ্জা পাবে, নারীর একা থাকা বারণ, নারীর সন্তানের পিতৃপরিচয় আবশ্যক। আরও কত কত কাঁটাতার এখনও অনবরত পেরোতে হচ্ছে নারীদের। হতাশা যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন মনে পড়ে উনিশ শতকে তথাকথিত নবজাগরণের আলো থেকে দূরে একাকী দাঁড়িয়ে আজীবন লড়ে যাওয়া এই প্রবল ব্যক্তিত্বময়ীর কথা। তাই তো তাঁর অনুপস্থিতি, তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও মনে হয় যেন তিনি অনবরত বলে চলেছেন—
তোমারে আমার চেয়ে বড়ো বলে নিয়েছিনু গনি।
তোমার আঘাত, সাথে নেমে এলে তুমি
যেথা মোর আপনার ভূমি।
ছোটো হয়ে গেছ আজ।
আমার টুটিল সব লাজ।
যত বড়ো হও,
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো, এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে’।।