শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


পুজো করছেন স্কুলেরই শিক্ষিকা সংস্কৃতের মৌসুমী দিদি।

পুরবাসীর কল্যানার্থে পুজোআর্চা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরই কাজ ছিল দীর্ঘদিন ধরে। বাড়ির মেয়েরা প্রচুর পরিশ্রম করে উপবাসে থেকে সমস্ত আয়োজন করবেন, তারপর অপেক্ষায় থাকবেন কখন পুরোহিত এসে পুজো করবেন। ঈশ্বরের আরাধনার অধিকার নেই। এমনকি শালগ্রাম শিলা স্পর্শ করারও অনুমতি নেই মেয়েদের। সমাজ পাল্টাচ্ছে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এখন মেয়েদের সমান বা কিছু ক্ষেত্রে অধিক দক্ষতা প্রমাণিত।
পৌরোহিত্যের কাজ ও এখন সে সব বিধিনিষেধের বেড়াজাল মুক্ত। সর্বজনীন পুজো, বিবাহের মতো কাজে ও মেয়েরা পৌরোহিত্য করছেন। সম্প্রতি কল্যাণী বিধানচন্দ্র মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের সরস্বতী পুজো করলেন সেই স্কুলেরই শিক্ষিকা। সংস্কৃতের মৌসুমী মুখোপাধ্যায়। ছাত্রী, শিক্ষিকা সকলেই খুব উৎসাহী। সব আচার অনুষ্ঠানই নিষ্ঠা ভরে করেছেন। প্রথমবার দিদিমণি পৌরোহিত্য করলেন। বাড়ির নিত্য পুজো তো মেয়েরাই করেন। তাই মৌসুমী দিদিমণি নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে এসেছেন এ কাজে। শালগ্রাম শিলার জায়গায় নিজের ঠাকুরের আসনের ছোট গোপালকে এনেছেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৮: সুলতানার স্বপ্ন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

আনন্দে ভরপুর সকলে নতুন এই পদক্ষেপে। দীর্ঘদিন যিনি পুজো করতেন তিনিও উৎসাহ দিয়েছেন। এ পুরুষ পুরোহিতের সঙ্গে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। এ মানুষ হিসেবে সাম্যের জায়গা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথাও কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে কিনা। কিন্তু না, প্রবীণরাও প্রবল উৎসাহ দিয়েছেন। শুধু দু’ একজনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল পুরোহিত দিদিমনির পদবি কী। এ প্রশ্ন মনে আসাটা সেই বর্ণ বৈষম্যের সংস্কারের পিছুটান। আর কিছুদিন বাদে এরকম প্রশ্নও হয়তো উঠবে না। বিদ্যালয় হোক এ শুভারম্ভের পীঠস্থান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

একই সঙ্গে মনে পড়ল আরেক পুর হিতকারীর কথা। বছর দু’য়েক আগে কল্যাণীর চার্চে দেখেছিলাম ক্রিসমাসের প্রার্থনা পরিচালনা করছেন এক মহিলা পাদ্রি। অল্পবয়সী। কি সুন্দর শুভ্র বসনে দৃঢ় ভাবে সমস্ত অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। মোহিত হলাম। উনি রেভারেন্ড ডেকান অতিথি হালদার। স্কুল থেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন পাদ্রী হবেন। বাবা-মায়েরর একমাত্র সন্তান। তাঁদের থেকে কোনও বাধা আসেনি। গ্র্যাজুয়েশনের পর চারবছর থিওলজির ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষে কাঁচড়াপাড়া চার্চে ছিলেন। সেখান থেকেই কল্যাণী চার্চেএ ক্রিসমাসে পৌরোহিত্য করেন। নদীয়া মুর্শিদাবাদ ও উত্তর চব্বিশ পরগনার কিছু অংশ মিলে একটি ডাইওসিস। প্রায় চল্লিশ হাজারর ওপর খ্রিস্টান (প্রটেস্টান্ট) ধর্মাবলম্বীর সদস্য। অতিথি আছেন দায়িত্বপূর্ণ পদে। বিশপের প্রতিনিধিত্বে চার্চের মিনিস্ট্রির কাজ করেন। মূল কাজ পৌরোহিত্য। এ মুহূর্তে তিনি বদলি হয়ে আছেন দমদমে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

চার্চের নিত্যকার কাজ ছাড়া ও আছে নানারকম সামাজিক দায়দায়িত্ব। মহিলাদের, শিশুদের সেল আছে। সেখানে আলোচনার মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, এছাড়া সাপ্তাহিক মাস পরিচালনা, এডমিনিষ্ট্রেশনের কাজ সবই দক্ষতার সঙ্গে করছেন। পুরো ডাইওসিসে প্রথম মহিলা পাদ্রি। প্রশ্ন করেছিলাম কোথাও কোনও অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছেন কিনা। পাদ্রির পোশাকের সঙ্গে মাথা ও কান ঢাকা কাপড় না থাকায় কিছু মানুষের মেনে নিতে অসুবিধে হয়েছিল প্রথম দিকে। তবে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করায় ব্যাপারটির মীমাংসা হয়।

রেভারেন্ড ডেকান অতিথি হালদার।

রেভারেন্ড ডেকান অতিথি চমৎকার ভাবে নিজের কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবনের সামঞ্জস্য করে চলেছেন। বাবা-মায়ের দেখাশুনা করেন। একজন পাদ্রিকে জীবনসঙ্গী করেছেন। আর নিষ্ঠার সঙ্গে পুরহিতের কাজ করছেন।

অতিথি হালদার।

গর্বিত হলাম দুটি ধর্মে মেয়েদের এরকম ভূমিকায় দেখে। সংস্কারের বাঁধ ভাঙুক। জীবনের সবক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে মেয়েদের পদক্ষেপ পরুক। ছেলেদের প্রতিযোগী হিসেবে নয়। পুর-বাসীর পুরো-হিত তখনই হবে যখন সকলে সব কাজে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content