শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি : ঔর্ব চক্রবর্তী

বাস্তুশাস্ত্রের উপদেষ্টা ও আচার্য হচ্ছেন আঠারোজন৷ মৎস্য পুরাণের ২৫২ অধ্যায়ে এঁদের কথা উল্লিখিত আছে৷

ভৃগুরত্রির্বসিষ্টশ্চ বিশ্বকর্মা ময়স্তথা৷
নারদো নগ্নজিচ্চৈব বিশালাক্ষঃ পুরন্দরঃ৷৷
ব্রহ্মা কুমারো নন্দীশঃ শৌনকো গর্গ এব চ৷
বাসুদেবোহনিরূদ্ধশ্চ তথা শুক্রবৃহস্পতি৷৷
অষ্টাদশৈতে বিখ্যাতা বাস্তুশাস্ত্রোপদেশকাঃ৷


অর্থাৎ ভৃগু, অত্রি, বশিষ্ঠ, বিশ্বকর্মা, ময়, নারদ, নগ্নজিৎ, বিশালাক্ষ, পুরন্দর, ব্রহ্মা, কুমার, নন্দীশ, শৌনক, গর্গ, বাসুদেব, অনিরুদ্ধ, শুক্র ও বৃহস্পতি—এঁরা হলেন বাস্তুশাস্ত্রের আঠারো উপদেষ্টা ও আচার্য৷

আদিদেব ব্রহ্মার চারটি মুখ থেকে চারটি বেদ ও চারটি উপবেদের সৃষ্টি হয়৷ পূর্বদিকের মুখ থেকে ঋগ্বেদ, পশ্চিম দিকের মুখ থেকে সামবেদ, উত্তর দিকের মুখ থেকে অথর্ববেদ ও দক্ষিণ দিকের মুখ থেকে যজুর্বেদ৷ এছাড়া চারটি উপবেদও ব্রহ্মার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়৷ সেগুলি হল যথাক্রমে আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ ও স্থাপত্যবেদ৷ এই স্থাপত্যবেদ ও বাস্তুশাস্ত্র একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত৷

আদিদের ব্রহ্মা হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টির প্রধান প্রাণপুরুষ৷ ইনিই বাস্তুর প্রধান উপদেষ্টা ও আচার্য৷ আদিদেবের মানসপুত্রদের যথাক্রমে বশিষ্ঠ, অত্রি, ভৃগু, নারদ এবং ঋষিদের মধ্যে শৌনক ও গর্গ প্রমুখ এই বাস্তুশাস্ত্রে আরও উন্নততর শৈলী যোগ করে তাকে আরও পূর্ণত্ব প্রদান করেছেন৷ তাঁদের মতামত ও চিন্তাশৈলীগুলি বিভিন্ন পুরাণ, উপনিষদ ও ধর্মগ্রন্থে ছড়িয়ে আছে৷ ব্রহ্মার দিব্যসভায় গ্রহরূপে বিরাজ করেন শুক্র৷

বাস্তুর আর এক প্রাণপুরুষ হচ্ছেন বিশালাক্ষ অর্থাৎ শিব৷ এঁরই পুত্র কার্তিক (কুমার) ও অনুচর নন্দীশ৷ এঁরাও এঁদের মূল্যবান ও সুচিন্তিত মতামতের দ্বারা বাস্তুশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন৷
সৃষ্টির পালনকর্তা হচ্ছেন বিষ্ণু৷ তাঁর অবতার বাসুদেব (শ্রীকৃষ্ণ) ও তাঁর পৌত্র অনিরুদ্ধ হচ্ছেন বাস্তুশাস্ত্রের দুই অন্যতম উপদেষ্টা৷ দেবরাজ ইন্দ্র বৈবস্বত মতান্তরে পুরন্দর নামে পরিচিত হন৷ ইনিও বাস্তুশাস্ত্রের এক বিশিষ্ট উপদেষ্টা৷
পরমজ্ঞানী আচার্য বৃহস্পতি বাস্তুশাস্ত্রের এক অন্যতম উপদেষ্টা৷ বাস্তু আচার্য গান্ধাররাজ নগ্নজিৎ হচ্ছেন কৌরবরাজ ধৃতরাষ্ট্রের শ্বশুর৷ আচার্য বরাহমিহির বৃহদ্ সংহিতায় বলেছেন—
নগ্নজিতা তু চতুর্দশদৈর্ধ্যেন দ্রাবিড়ং কথিতম্


এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আরও কিছু বাস্তু উপদেষ্টা ও আচার্যের নাম আমরা জানতে পারি৷ তাঁরা হলেন বরাহমিহির, কালিদাস, ভাস্করাচার্য, নারায়ণ ভট্ট, শ্রীপতি, মাণ্ডব্য, লল্লু, ফেরু, শার্ঙ্গধর৷ প্রমুখ৷

বিশ্বকর্মা
দেবশিল্পী ও স্থপতি বিশ্বকর্মা প্রভাসের পুত্র৷ মা যোগসিদ্ধা৷ অষ্টবসুর অষ্টতম হলেন প্রভাস৷ অসংখ্য রকমের হস্তশিল্পের আবিষ্কারক বিশ্বকর্মা দেবতাদের স্থপতি ছাড়াও সকল রকম আভূষণের নির্মাতা৷ দেবতারা যে বিভিন্ন রকমের রথে আরোহণ করতেন সেগুলির স্রষ্টাও এই বিশ্বকর্মাই৷ বিশ্বকর্মার পাঁচ পুত্র চার কন্যা৷ ইন্দ্রসভায় এক সন্ন্যাসীরূপে তিনি বিরাজ করেন৷ বিশ্বকর্মার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল যমরাজার বিশাল প্রাসাদ, জলের নীচে বরুণদেবের সুবিশাল প্রাসাদ, পুষ্পক রথ যা আকাশে ওড়ে এবং সেই প্রসিদ্ধ রথটি যাতে চড়ে অর্জুন কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন৷ শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা ও রাবণের লঙ্কা এরই সৃষ্টি৷

দানবেন্দ্র ময়
পরমধার্মিক ও পরম শৈব দানবেন্দ্র ময় শিবের কৃপায় ভূতলে নির্বিবাদে বসবাস করেন৷ বিশ্বকর্মা যেমন দেবশিল্পী ও স্থপতি, তেমন ময় হলেন দৈত্যকুলের শিল্পী ও স্থপতি৷ তাই একে দানব বিশ্বকর্মাও বলা হয়৷ এঁর নিপুণ নির্মাণকার্য বহুবার বিশ্বকর্মা ও দেবতাদের সম্ভ্রমসূচক প্রশংসা লাভ করেছে৷ ময়ের অদ্ভুত নির্মাণ প্রাচীন ত্রিপুর৷ সোনা, রুপো ও লোহা দিয়ে তৈরি এই বিশালকায় নগরী আকাশ, ভূমি ও জলে চলাচল করতে পারত৷ তিনি এই মহানগরী তৈরি করে সেটিকে নিজের ছেলেদের দিয়ে দেন৷

ময়ের মেয়ে মন্দোদরী রাবণের স্ত্রী ছিলেন৷ তাঁর দুই ছেলে মায়াবী ও দুন্দুভি ত্রেতা যুগে বানররাজ বালির সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন৷ যুধিষ্ঠিরের দিব্যসভা ভবন ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেছিলেন দানবশিল্পী ময়৷ মায়াবীদের পরম আচার্য ময় ইন্দ্রজাল ও অনেক আসুরি সিদ্ধিরও প্রবর্তক৷ হিমালয়ে দীর্ঘকাল ধরে তপস্যার পর ব্রহ্মার বর পেয়ে ময় একাধারে দেবতা, দানব ও অসুরদের অবিসংবাদী স্থপতি হয়েছিলেন৷
* বাস্তুবিজ্ঞান (Vastu Shastra): সুরেন্দ্র কাপুর (Surendra Kapoor), বিশিষ্ট বাস্তুবিদ।

Skip to content