প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী
পরিচালনা: চিত্ত বসু
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: দীপু
সে সময় একই দিনে উত্তমকুমার নামক মহাতারকার দুটি হলে রিলিজিং চেনে দুটি আলাদা ছবি রিলিজ করা কোনও বিচিত্র ঘটনা ছিল না। মানুষের মনে একটা অলিখিত ভরসার জায়গা তৈরি হচ্ছিল উত্তমকুমার যেটা করবেন পর্দার বুকে, সেটাই ঠিক। ভারতবর্ষে এ উদাহরণ, আর কোন অভিনেতার ঝুলিতে আছে বলতে পারব না যে, একই দিনে দুটি হলে রিলিজিং চিনে দুটি আলাদা ছবি মুক্তি এবং দুটিই সুপার ডুপার হিট। রাজেশ খান্না তিনটে হলে তিনটি আলাদা দিনে মুক্তি পাওয়া ছবির একসঙ্গে জুবলি করার রেকর্ড আছে। কিন্তু একই অভিনেতার দুটি বা ততোধিক হলে একসঙ্গে ছবি রিলিজ করছে এবং দুটো ছবিই বাম্পার হিট তা বোধ হয় ভূ-ভারতে খুব কম। বাঙালি জনমানসে দীর্ঘ কয়েক বছরের যাত্রা পথে এ ধরনের ঘটনা জল ভাত হয়ে গিয়েছিল। উত্তমকুমারের আগে বা উত্তমকুমারের পরে কোনও মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির নায়কের কপালে এ জয় টিকা দেখা যায়নি।
যে বছরটি উত্তম-সুচিত্রার ভালো বাসার মাখোমাখো ছবি দিয়ে ইনিংস শেষ করেছে এবং যে বছরটি ইনিংস শুরু করেছে সুচিত্রা সেনকে দিয়ে সে বছরে তো দর্শকরা মনের স্বাভাবিক গতিতে প্রত্যাশা করেছিলেন আরও অনেক সুচিত্রা-উত্তমের ছবি তাঁরা পাবেন। কিন্তু সুচিত্রা সেনের সমগোত্রের দেখতে এক নায়িকা মালা সিনহা, উত্তম কুমারের বিপরীত অভিনয় করছেন এবং কাকতালীয় ভাবে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছবি মুক্তির দিনই তাঁরও ছবিও রিলিজ করছে। আগামী দিনে উত্তম সুচিত্রা জুটি, যখন কিছুটা অপ্রতুল হয়ে পড়বে এ ধরনের ঘটনাও তার অনেকটা অংশে দায়ী বলে চিত্র-মোদী দর্শকগণ মনে করেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল
মালা সিনহা’র আগে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘ঢুলি’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শক মনে জায়গা পেয়েছেন। উত্তমকুমার-র সঙ্গে ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবিতে। দাপটে অভিনয় করে মানুষের মনের অনেকটা অংশ দখল করেছেন এরপরও সুচিত্রা সেনকে সঙ্গে নিয়ে উত্তমকুমারের যে জয়যাত্রা তার সমান্তরাল হিসাবে মালা সিনহা শুধু বোম্বের নায়িকার মুকুট মাথায় নিয়ে অতিরিক্ত আলো টেনে নেওয়ায় উত্তমকুমার নামক তারকাকেও মহাফাঁপরে পড়তে হয়েছিল। অভিমানী সুচিত্রা বেশ ইচ্ছে করেই উত্তমকে ছেড়ে অন্য নায়কদের সঙ্গে ছবি করাতে যেন একটু বেশি মনোযোগী হচ্ছিলেন। যে সুচিত্রা কিছুদিন আগে বোম্বেতে ‘দেবদাস’ ছবি দিলীপ কুমারের মতো নায়কের সঙ্গে অভিনয় করে এসে সারা ভারতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা
এরকম একটা প্রেক্ষিতকে মূলধন করে ‘বন্ধু’ ছবির প্রস্তুতিপর্ব তৈরি হয়েছিল। ছবিটির সূচনা পর্ব থেকে পরিচালক অত্যন্ত সুচতুরভাবে নায়কের পাশাপাশি সহ নায়ক হিসাবে অগ্রজ অসিতবরণ-কে কাস্ট করেছিলেন। এরপর ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, হরি বসু, বেচু সিংহ প্রমুখ, মহিলাদের মধ্যে মলিনা দেবী, শোভা সেন প্রীতি মজুমদার প্রভৃতিদের অংশগ্রহণে ছবিটি অতি উত্তম ভাবে মানুষের মনে দখল করেছিল।
এ ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ গান। সুরকার নচিকেতা ঘোষের অনবদ্য সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং গীতা দত্তের কণ্ঠে যে সব গান তৈরি হয়েছে। তা বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতে এক চিরস্থায়ী সম্পদ। আজও বাঙালির ঘরে ঘরে যদি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের টপ টেন অ্যালবাম বাজে সেখানে এ ছবির দুটি গানের যে কোন একটি গান থাকবেই। ছবিটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য উত্তম কুমারের আঙ্গিক অভিনয়। শুধুমাত্র চোখ ও মুখের ভঙ্গি দিয়ে অভিনয় সম্পদকে মানুষের মনে জায়গা করে দেওয়া যায়। তার অতি উত্তম উদাহরণ ‘বন্ধু’ ছবিটি।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৫: রাজা সবকিছু হাতে করে প্রজার মুখে তুলে দেবেন এমনটা ভাবার আর সময় নেই
ছবিটির নির্মাণ পর্বে পরিচালক চিত্ত বসু পই পই করে কাহিনিকার সলিল সেনগুপ্তকে ডেকে বলেছিলেন সুচিত্রা উত্তমের পাশে এই ছবি যেন দাঁড়াতে পারে সেই মানে চিত্রনাট্য লিখতে হবে। সবসময় খেয়াল রাখতেন কোনওভাবেই উত্তমকুমারের ক্যামেরা ব্যবহার যেন ছবিতে কম না হয়। তাই ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে সমস্ত কলা-কুশলীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
উত্তমকুমারের মুখ বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে যেহেতু বাণিজ্যিকভাবে ছবি হিট দেওয়ার কারণ তাই গানের দৃশ্য বা যে কোনও ডায়ালগ থ্রোয়িং-এর সময় উত্তমবাবুর রেফারেন্স যেন সবার আগে থাকে। এ ধরনের ঘটনায় সিনিয়র শিল্পীদের একটু অস্বস্তি হয় বটে কিন্তু ছবির পরিচালক সেদিকটাতে নজর দিয়েই বাজারে চলমান অন্যান্য সুপার-ডুপার হিট ছবিগুলোর সঙ্গে ‘বন্ধু’ ছবির কৌলিন্য এক মানে রাখতে পেরেছিলেন।—চলবে।
>* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।