প্রেক্ষাগৃহ : মিনার, বিজলী ও ছবিঘর
পরিচালনা : অসিত সেন
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম : রাজনাথ
পরিচালক অসিত সেন ছিলেন সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের খুব কাছের বন্ধু। ক্যা মেরা চালানোর হাতে খড়ি যখন থেকে তখন থেকেই সুচিত্রার সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা। যাই হোক ধীরে ধীরে অসিতবাবু সিনেমা জগতের অপরিহার্য হয়ে উঠছিলেন এবং উত্তম সুচিত্রাকে কাস্ট করে তিনি ছবি বানিয়েছিলেন যে ছবি সৌভাগ্যবশত মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালেই। একটা গোটা বছর এভাবে মণি-মুক্ত-রত্নখচিত হয়ে ছিল যে বাংলা সিনেমা কেন তাবড় হলিউড মুভি জগতেও এ দৃষ্টান্ত বিরল।
ছবিটির কাহিনি ছিল এরকম; পিতৃমাতৃহীন দেবকমলের স্বপ্ন নিজের অনাথ আশ্রমটিকে সার্থক করে তোলা। চাই প্রচুর অর্থ। পাতানো বোন শকুন্তলার সঙ্গে কোটিপতি হরনাথ সামন্তর পুত্র রাজনাথ সম্মত হলেই বিয়েটা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু শকুন্তলা তা চায়নি। তার মনে হয়েছে রাজনাথের রূপের চেয়ে রূপের মোহ বেশি। তাঁর বাবা হরনাথ কোটিপতি হলেও তিনি সুখী নন। কারণ জানে সুপ্রভা দেবী, রাজনাথের মাসিমা। একদিন হরনাথের মৃত্যু হয়। উইল অনুসারে অর্ধেক সম্পত্তির অধিকারী জানতে পেরে দেবকমল দাবি করে পুরো সম্পত্তি। বাবার সম্মান রক্ষা করতে এক কথায় ছেড়ে দিয়ে চলে যায় রাজনাথ। শকুন্তলা ভুল বুঝতে পারে। বাইরের ঐশ্বর্য ত্যাগ করে আসা রাজনাথের অন্তরের ঐশ্বর্যকে আবিষ্কার করে শকুন্তলা।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?
এরকম একটি জমাটি কাহিনিকে অবলম্বন করে পরিচালক অসিত সেন তৈরি করেছিলেন ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিটি। ছবিটির পরতে পরতে ইতিহাস। কাহিনিকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে উত্তম কুমারের প্রথম অভিনয় এই ছবির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং উত্তম কুমার পরস্পর পরস্পরের পূরক হয়ে বাংলা ছবির জগতে সাড়া জাগাবেন।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়
বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার
আসলে সে সময়টা এমনই ছিল যে কোনও পরিচালক যে কোনও কাহিনি নিয়ে উত্তম সুচিত্রার দ্বারস্থ হলেই ছবি হিট। নইলে একই বছরে চার চারখানা উত্তম সুচিত্রার ম্যাগনাম ওপাস চার রকম আলাদা পরিচালক হিট দিতে পারে!
উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের শুরুতে সাবলীলতার সঙ্গে যে স্বকীয়তার মিশ্রণ ছিল তাই পরবর্তীকালে সুচিত্রা-উত্তম জুটি জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ায় মূল কারণ। আমার একান্ত অভিমত এই যে, এই পর্ব থেকেই অভিনেতা উত্তম কুমার পিছনে সরে গিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন ইমেজ আদৃত রোম্যান্টিক উত্তম কুমার। যে কোনও অভিনেতা জানেন সিনেমায় অভিনয়ের সবচেয়ে কঠিন কাজ মেজাজ ধরে রাখা এবং মুহুর্মুহু তা বদলানো। যে অভিনেতা কাজটি যত ভালোভাবে করতে পারেন তিনি তত বড় শিল্পী। অভিনেতার পরীক্ষা ক্লোজ আপ শটে। সত্যি বলতে কি বাংলা সিনেমার বিদগ্ধ ক্লোজআপ এর ব্যবহার খুবই কম। হলিউডে একজন অভিনেতার মুখের উপর যেভাবে পরিচালক ক্যামেরা ধরে রাখেন তা আমাদের দেশের কোন অভিনেতা হলে তার অনুমতি দিতেন না।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪: কৃষ্ণভাবিনী দাসী— প্রথম মহিলা ভ্রমণ কাহিনিকার
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা
‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে দেখি, অসিত সেন যেহেতু নিজে একজন বড় ক্যামেরা বিশারদ ছিলেন তিনি ক্লোজআপে উত্তমকে অনেক বেশি ব্যবহার করেছেন। সারা জীবনে উত্তম কুমার অভিনয়যোগ্য দুর্লভ সুযোগ মত পেয়েছেন এ ছবি তার অন্যতম। তিনি চেষ্টা করতেন ছবির শ্রেষ্ঠ অংশগুলো অনেক সময় নির্বাক ভাবে প্রকাশ করতে। একজন শিল্পী তার নীরব অভিব্যক্তি দিয়ে যা প্রকাশ করতে পারেন শত কথাতেও তা সম্ভব নয়। উত্তম কুমার তার অভিনয় জীবনের ১০ বছর পূর্তিতে যেটা সবচেয়ে আগে করেছিলেন তা হল মঞ্চ এবং সেলুলয়েড অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করে সেলুলয়েডোচিত অভিনয় করা। এখন থেকে উনি শুরু করলেন ক্লোজআপ শর্ট এর মাধ্যমে চোখ মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে নির্মল অভিনয় করে যাওয়া।
আসলে উত্তম কুমারের ক্যারিয়ারের সমস্ত ছবি আলোচনা করলে দেখা যাবে বেশিরভাগ ছবিতেই তার অভিনয় বাকচাতুর্যে ভরা। কিন্তু যে ধরনের চরিত্র পেলে একজন অভিনেতা অভিব্যক্তি দিয়ে তা ফুটিয়ে তুলতে পারেন সে ধরনের চরিত্র সে সময় তাঁকে কেউ দেয়নি। ব্যতিক্রম উত্তম সুচিত্রার ছবি। ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিটিকে যত বেশি উত্তম সুচিত্রার বলে মাতামাতি করি, সেটা আদৌ তা নয়। এখানে ছবিতে উত্তম-অসিত এই জুটি কাজ করে গিয়েছেন।
উত্তম কুমার এই মূলধনটি সারা জীবন তার ক্যারিয়ারে বহন করে গিয়েছেন।—চলবে।
ছবি: সংগৃহীত।
উত্তম কুমার এই মূলধনটি সারা জীবন তার ক্যারিয়ারে বহন করে গিয়েছেন।—চলবে।
ছবি: সংগৃহীত।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।