রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মুক্তির তারিখ: ১৪/১১/১৯৫৭ এবং ১৫/১১/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ: মেট্রো এবং মিনার, বিজলী ও ছবিঘর
পরিচালনা: কার্তিক চট্টোপাধ্যায়
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: চন্দ্রনাথ
আজ এমন এক স্মরণীয় ছবির আলোচনায় মেতে উঠবো যার পরতে পরতে শুধু ইতিহাস তৈরির হাতছানি। দুর্ভাগ্যের বিষয় ছবিটির প্রিন্ট এখন আর দেখা যায় না। কোথায় আছে কেমন আছে এরও কোন হদিস সেভাবে বাঙালি দিতে পারেনি। যে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের নোবেল সুরক্ষিত করতে পারেনি তার কাছে সুচিত্রা-উত্তমের ম্যাগনাম ওপাস ‘চন্দ্রনাথ’-কে সুরক্ষিত করার চিন্তা আকাশ কুসুম মাত্র।

আলোচনা যত গভীর হবে ছবিটির পার্থিব অস্তিত্ব ততটাই হারাবে। লোকমুখে শোনা যায়, বাংলাদেশে নাকি এখনও একটা প্রিন্ট আছে। আবার একদল মাথা ভারী আলোচক মন্তব্য করেন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউশনে এর প্রিন্ট নবজন্ম পেতে গিয়েছে। যতদিন না খেয়ে মুখ ধোয়া হচ্ছে ততদিন বলা যায় না ‘খেয়েছি’। কাজেই বর্তমান প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্ম অপেক্ষা করে থাকবে যদি কোনওদিন এর উদ্ধার হয়।
বর্তমান প্রতিবেদক তাঁর শৈশবের স্মৃতি থেকে একটি মাত্র তথ্য দিতে পারেন, সম্ভবত ছবিটি কলকাতা দূরদর্শনের আর্কাইভে আছে। কারণ অনেক আগে কলকাতা দূরদর্শন আশির দশকে একবার এর প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু তারপর সেই ছবির হদিস তাঁরা কোনওভাবেই আর দিতে পারেননি বা বর্তমান যেসব কোম্পানি ভিডিও-সিডি নির্মাণ করে সুনাম করিয়েছেন তাঁরাও যোগাড় করে উঠতে পারেননি।

অনেক হারিয়ে যাওয়া ছবি খবরের কাগজের প্রতিবেদন হয়ে তালিকাভুক্ত হলেও বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোগে ছবিগুলির পুনর্জন্ম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তপন সিনহা পরিচালিত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিটি। কিন্তু ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিটির অন্তত ৯০ দশকের পর থেকে বাঙালি সমাজকে দিয়ে উঠতে পারেনি সাংস্কৃতিকভাবে বা ব্যবসায়িকভাবে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

যাইহোক বর্তমানে দাঁড়িয়ে এর স্মৃতি তর্পণ করা ছাড়া আর সে সময় যাঁরা দেখেছিলেন বারংবার তাদের মুখ থেকে গল্প শোনা ছাড়া কোনও আর গতি নেই।

বলা হয়, ছবিটি চাটুজ্জেদের ছবি।
কাহিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চিত্রনাট্য নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, পরিচালনা কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, সংগীত পরিচালনা রবীন চট্টোপাধ্যায় এবং রূপায়ণের অন্যতম কাণ্ডারী উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়। মজার ব্যাপার হল মেট্রোতে যেদিন প্রথম মুক্তি পেলো এ ছবি, প্রথম দিনের প্রথম শো স্ক্রিনের উপর যে অপারেটর ফেললেন তাঁর নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, উত্তমকুমার-র পিতা।

কাজেই এরকম একটা চাটুজ্জেদের ছবি কাকতালীয়ভাবে বাজারে ইতিহাস গড়বে। সেটা কেউ আগাম কল্পনা করতে পারেননি। হাতে থাকা মূলধন বলতে বছর খানেক আগে কার্তিকবাবুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ‘সাহেব বিবি গোলাম’-র অসাধারণ স্ক্রিন প্রেজেন্ট। সঙ্গে সুচিত্রা সেনের আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি।
দর্শকসমাজে সবার আগে হুল্লোড় পড়ে গেল মেট্রোতে বাংলা ছবি, যা কখনও হয়নি এবং যেদিন দর্পনা ইন্দিরা ও প্রাচী সিনেমার চেনে এ ছবি রিলিজ করবে, মেট্রো কর্তৃপক্ষ তার একদিন আগে ছবি রিলিজ করে ইতিহাসের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে সুচিত্রা উত্তমের প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ প্যারাডাইস সিনেমা হলে মুক্তি পেয়ে একরকম ইতিহাস গড়েছিল। কিন্তু সেদিনও কেউ কল্পনা করতে পারেননি মাত্র চার বছরে এই জুটি এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যে, মেট্রো কর্তৃপক্ষকেও ভাবতে হবে হলিউড ছবির পাশাপাশি এই ছবিকে জায়গা করে দিতে।

ছবিটির কাহিনি এরকম: জমিদারিতে রুচি নেই চন্দ্রনাথের। বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে, ঘুরতে ঘুরতে একদিন উপস্থিত হলেন কাশীতে। উঠলেন পরিচিত পান্ডা, হরিদয়াল ঘোষালের বাড়ি। তিনি ছাড়া বাড়িতে এক বিধবা আর তার কিশোরী কন্যা সরযূ, সরযূর অনুপম সৌন্দর্যে তাকেই বিয়ে করে দেশে ফিরলেন চন্দ্রনাথ। সংসার ভরে গেল আনন্দে। কিন্তু সে আর কতদিন! সুখের সংসারে হঠাৎ এসে পৌঁছলো এক ভয়ঙ্কর চিঠি। সরযূর মা ভ্রষ্টা, কুলত্যাগিনী। চন্দ্রনাথ ত্যাগ করলেন সরযূকে। ততদিনে সরযূর গর্ভে চন্দ্রনাথের সন্তান। বাড়ি ছেড়ে এসে পৌঁছলেন কাশীতে। হরিয়ালের বাড়িতে। তিনিও স্থান দিলেন না। গরিব কৈলাস খুড়োর কুঁড়েতে জন্ম নিল চন্দ্রনাথের সন্তান। বিশ্বনাথ। একদিন চন্দ্রনাথ বুঝতে পারল তার ভুল। যে কলঙ্কে সরযূর মা কলঙ্কিনী, সেই কলঙ্ক তো কখনও সরযূকে স্পর্শ করেনি। তাহলে? চন্দ্রনাথ কাশী থেকে ফিরিয়ে আনলেন বিশ্বনাথকে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা

ছবিটির এই কাহিনি উত্তম সুচিত্রার দ্বৈরথকে যেভাবে নির্মাণ করেছিল তা ছিল সত্যিই কালোত্তীর্ণ। চিত্রনাট্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখনীকে অমর করেছেন সরযূ নির্মাণে। স্বাভাবিকভাবেই শরৎকাহিনিতে নারী চরিত্র দুঃখী এবং সেই দুঃখের বেড়াজাল থেকে তার উত্তরণের যাত্রাপথ যা, আগামী দিনে আমরা ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ তে দেখতে পাবো। কিন্তু কেন জানিনা সুচিত্রা উত্তমের সৃষ্টি, শরৎচন্দ্রের কাহিনিকে পর্দার বুকে জীবন্ত করে তুলেছিল। খুব জরুরি ছিল শরৎচন্দ্রের সশরীরে বেঁচে থাকা। তাঁর মানসপুত্র, কীভাবে উত্তম কুমারের অবয়বে ধীরে ধীরে প্রাণ পাচ্ছে তা, তিনি দেখে যেতে পারেননি।

যখনই কাহিনির কথা পাঠকরা, দর্শকরা আলোচনা করেন তখন দূর থেকে তাঁদের মনের মণিকোঠায় জমে থাকা একটা সাংগীত মূর্ছনা স্মৃতির দরজায় এসে কড়া নাড়ে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘রাজার দুলালী সীতা, বনবাসে যায় রে ‘বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মোর ভীরু সে কৃষ্ণকলি’। এ ধরনের নানা রকম ফসলের সমাহার ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিটির প্রথম থেকে শেষ অব্দি। ঘটনার ঘনঘটা যেভাবে দর্শক-শ্রোতাদের বেঁধে রেখেছিল তাতে ইতিহাস বলছে সে নিজেকে যেন পুনর্জীবিত করে তুলতে পেরেছে।
সঙ্গে সঙ্গে এ ছবি এমন একটা ইতিহাস তৈরি করল যে মাত্র দু’ মাস আগে আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা ‘হারানো সুর’-কে যেন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল। কিছু প্রেক্ষাগৃহে ‘হারানো সুর’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাশাপাশি ‘চন্দ্রনাথ’ এসে মাতিয়ে তুলল।

ইতিহাস এখানেই থেমে রইল না ১৫-২০ দিনের মধ্যে উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলায় রিলিজ করল, ‘পথে হল দেরী’ তারও কুড়ি দিনের মধ্যে মুক্তি পেল ‘জীবন তৃষ্ণা’। সারা বছর শেষ হল উত্তম-সুচিত্রার পারস্পরিক চাউনিতে। বছরে একটা করে এ ধরনের ছবি হলে যেখানে সারা বছর হল মালিকদের সমস্ত বিনিয়োগ কয়েকগুণ হয়ে ফিরে আসে সেখানে কলকাতার বুকে সমস্ত হলে রিলিজিং চেনে চার চারখানা উত্তম সুচিত্রার ছবি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যা ১৯৫৭ সালের পরে ঘটেনি আজও।

বাণিজ্যিকভাবে ‘চন্দ্রনাথ’-ই এই জুটির সফলতম ছবি ১৩ সপ্তাহ একটানা চলে ছিল, লাভ করেছিল ৭০০ শতাংশ। শরৎকাহিনি উত্তম-সুচিত্রার হাত ধরে মাত্র তিনবার পর্দায় এসেছে, প্রথম ‘চন্দ্রনাথ’ দ্বিতীয় ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ তৃতীয় ‘গৃহদাহ’।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

আমরা একটি ছবির পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে হারিয়ে যাবো না অন্য কোন সাধারণ আলোচনায়। কিন্তু ধীরে ধীরে উত্তমের ফিল্মোগ্রাফি যেভাবে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটি আলোচনা না করে রাখলে সারস্বত-মূলধন হানিকর জায়গায় পৌঁছে যাবে। সুচিত্রা উত্তমের ১৯৫৩ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত বাংলা ছবির বাজারে যে ক্রেজ তৈরি হয়েছিল তা কিন্তু পরের ১০-১২ বছরে হারিয়ে যাবে।

কথাটা এই ছবির প্রসঙ্গে উল্লেখ্য না হলেও ইতিহাসের দৃষ্টিতে মনে করিয়ে দিতে হবে এ সময় থেকেই দু’জন দুজনের বাইপাস পথ তৈরি হতে শুরু করে। কারণ ১৯৫৭ সালের মতো আর কোনও সাল তাদের জীবনে আসেনি, এ ছবি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বছর চার চারটি ছবিতে নায়ক উত্তম। ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’ ও ‘জীবন তৃষ্ণা’ ১৯৫৮ তে তিনটি ছবি। তিনটি উত্তমের সঙ্গে।

‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’ ও ‘সূর্যতোরণ’ ১৯৫৯ সালে যেদিন ‘চাওয়া পাওয়া’ মুক্তি পেল, সাফল্য পেল ভাবতে পারা যায় যে, টানা আটটি ছবির সাফল্য। তখন মনে হচ্ছে এ জুটির কাছের কেউ দাঁড়াতে পারবে না। এ যেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল। বিজয় রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ষ্টিভ ওয়। ঠিক সে সময়েই পাশাপাশি আরেকটি ছবি ‘দীপ জ্বেলে যাই’ রিলিজ করল। পরিচালক অসিত সেন। নায়িকা সুচিত্রা সেন। কিন্তু নায়ক উত্তম নন। ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’-র নায়ক বসন্ত চৌধুরী। ছবিও ব্যবসা করল ৪০০ শতাংশ। টানা ১২ সপ্তাহ চলল ছবিটা। আর রিসেলে তো এই ছবি সোনার খনি। কাজেই উত্তম-সুচিত্রার চূড়ান্ত সাফল্য যখন করতলগত, সেই ১৯৫৭ সালের পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে না দু’জনকে পাঁচ বছর।
যাইহোক ইতিহাসের দায়িত্ববোধ নিয়ে বিষয়টিকে আলোচনার টেবিলে না রাখলেও চলত কিন্তু আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে উত্তম সুচিত্রার সোনার জুটি একটা সময় কিছুদিনের জন্য পজ দেবেন এবং পাশাপাশি উত্তম বাবু অন্যান্য নায়িকাদের সঙ্গে বাংলা ছবিতে সোনার ফসল গড়ে তুলবেন। যাইহোক এ ছবিতে সহশিল্পী হিসাবে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাদের কথা সোনায় বাঁধিয়ে রাখতে হয়।

কমল মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, তুলসী লাহিড়ী, জীবেন বোস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, মলিনা দেবী, রাজলক্ষ্মী দেবী, রেনুকা দেবী কে ছিলেন না এ ছবিতে! আসলে ক্লাসিক উপন্যাস নিয়ে কার্তিক বাবু যখনই ছবি করেছেন সেখানে যত বেশি সংখ্যক চরিত্র থাকবে উনি সেদিকেই জোর দিতেন বেশি।

রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সে সময় হেমন্ত সন্ধ্যা জুটির প্রত্যেকটি গান, মানুষের মনে রেখাপাত করেছিল এবং সবচেয়ে বড় কথা ছবির নির্মাণ কৌশল, ছবিটিকে আজও সফলতম হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে।

এরকম একটি ছবির বহিঃপ্রকাশ মাথায় নিয়েই আমরা পরবর্তী ছবিগুলোর কথা আলোচনা করব। ওই যে ‘পথে হল দেরি’ বা ‘জীবন তৃষ্ণা’-র শুটিং শেষ হল বলে।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content