শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মুক্তির তারিখ: ০২/০৯/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী
পরিচালনা: অজয় কর
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: অলোক
যে ছবি কথার পিঠে কথা দিয়ে, সুরের পরে সুর দিয়ে দর্শকসমাজে নিবেদিত হয়েছে, তার বিশ্লেষণ ইতিহাসের এক একটি সোপান বটে। তার কথা কয়েক প্রজন্ম একই মেধায় একই মননে সঞ্চিত রাখবে। ছবির নাম ‘হারানো সুর’। উত্তম-সূচিত্রার সারাজীবনের আপন করে নেওয়ার ছবি। সময়টা এরকম, উত্তমকুমার এক এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বীরূপে তাঁর কাঙ্খিত শিল্পী হবার পুজোর ডালি সাজিয়ে যাচ্ছেন।

ইতিহাসের সালতামামি বলে দিচ্ছে এই প্রথম প্রযোজক উত্তম কুমার আত্মপ্রকাশ করছেন। পরিচালক হিসাবে যাকে পাশে পেয়েছেন তিনিও অত্যন্ত গুণী এবং প্রতিশ্রুতিমান। সংগীত পরিচালনায় তৎকালীন ভারতবর্ষের রোম্যান্টিকতার শেষ কথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নায়িকার চরিত্রে অবিসংবাদিতভাবে সুচিত্রা সেন।
এহেন একটি প্যাকেজকে নিয়ে ছবির প্রেক্ষিত হয়েছিল, অনেক প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ছবি রিলিজ করেছিল, মানুষের মন জয় করেছিল ও ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে অমরত্বের আসন দখল করে নিয়েছে।
স্বভাবতই এ ছবির অগ্রপশ্চাৎ আলোচনা করতে গিয়ে রংবেরঙের অনেক ঘটনা পরস্পর গলা জড়াজড়ি করি মাথার মধ্যে একটা অস্বস্তির পোকা তৈরি করে দেবে। আমরা সে পথে হাঁটবো না। ছবিটির সারস্বতগুণবিচার ছাড়াও মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখে নেব ব্যক্তির উত্তমের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।

চলচ্চিত্রশিল্পের হাত ধরে অতি প্রতিষ্ঠিত উত্তম কুমার নিজেকে অন্যভাবে গড়ে তুলছেন। ‘শ্যামলী’ নাটকের মাধ্যমে ষ্টার থিয়েটারে মুখ দেখানো বন্ধ হয়েছে। সাফল্যের ঝুলিতে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ এ ধরনের ব্লকবাস্টার ছবিগুলোর একের পর এক পুনর্মুক্তি মানুষকে বিহ্বল করে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ দেখছে নিত্যনতুন চমক। আগেই বলেছি এ বছরের সমস্ত ছবির গড়পরতা যে ওঠা পরা তার নজির উত্তমের ক্যারিয়ারে আর কখনও নেই। একই বছরে ‘চন্দ্রনাথ’, একই বছরে ‘পথে হল দেরি’, একই বছরের ‘জীবন তৃষ্ণা’, একই বছরে ‘হারানো সুর’ এরকম নানা রঙের ফসল উত্তমকে সর্বোত্তম করার পথে এগিয়ে দিচ্ছিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

ছবিটির তৈরি ঘিরে অনেক রকমের উত্তমোচিত গল্প, বাজারে প্রচলিত আছে। অনেকগুলো সিন বেটার করার জন্য ফাইনাল টেক হয়ে যাওয়ার পরও রিটেক দিতে হয়েছে। ক্রমাগত বোম্বে থেকে ডাক আসা সুচিত্রা সেনকে সেখানে সময় দিতে গিয়ে এখানকার ছবির কাজ ব্যাহত করতে হয়েছে, অন্যান্য পরিচালক প্রযোজককে দেওয়ার সময়ের মান রাখতে নিজের প্রযোজনা সংস্থার ছবিকে মাঝপথে বন্ধ করে রাখতে হয়েছে।

এ ধরনের চাপানউতোর, একটা শিল্পী মনকে কোন মানের ক্ষতবিক্ষত করে তা একমাত্র সমব্যথী মানুষই জানতে পারবেন। আমরা হলে বসে তিন ঘণ্টার এ ছবি দেখি আবিষ্ট হই, মোহগ্রস্ত হই, তারপর হল থেকে বেরিয়ে এসে স্মৃতির মনিকোঠায় খুশির জল সেচন করি। কিন্তু ছবিটি যখন তৈরি হয়েছিল গল্পের বুনন থেকে সংগীতের পরিচালনা সবই যেন এক মায়াময় পরিবেশে তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

আসলে উত্তম কুমার নামক অবয়বটি এমনই এক ক্ষনজন্মা রূপ নিয়ে জন্মেছিলেন যে, অসম্ভব বলে কোন জিনিস তাঁর অভিধানে ছিল না। ব্যক্তি উত্তম সে সময় নানা রকম ঝড়ঝাপটায় বিধ্বস্ত। ‘সবার উপরে’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে সেখান থেকে ধাওয়া করা এক মহিলা, উত্তম কুমারের সঙ্গে দেখা করবেন বলে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। তার স্বামী উত্তমবাবুর বাড়িতে ভবানীপুরে গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছেন তার স্ত্রীর খবর নেবেন বলে।
হঠাৎ করে গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে তাঁর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা, যেমন উত্তম বাবুকে আশঙ্কিত করে তুলেছিল তেমনি বিব্রত করে তুলেছিল তার পরিবারের লোকজনদেরও। তারই কিছুদিন আগে সুচিত্রার সঙ্গে সন্দেহের বশে তার স্বামী দিবানাথ সেন অনেক রাতে মদ্যপ অবস্থায় উত্তমের বাড়ি হামলা করে গিয়েছেন। পরের দিনই রমা তথা সুচিত্রা সেন বিষয়টি মেরামতির জন্য ছুটে এসেছেন উত্তমজায়া গৌরী দেবীর কাছে। সেখানে আভিজাত্যের রূপোলি মোড়কে অভিমানী গৌরীর দ্বান্দ্বিক উপস্থাপনায় দর্পাহত সুচিত্রা, উত্তমকে স্টুডিও পাড়ায় একান্তে অনেক দাম চেয়ে বসেন। প্রযোজক ও পরিচালকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং নায়িকার এ ধরনের আবদার, ধৈর্যশীল উত্তমকেও অনেক সময় বিচলিত করে তুলেছিল।
আজও ভাবলে অবাক লাগে একটা মানুষকে কতটা মানসিক চাপ নিয়ে বেড়াতে হতো যেখানে সুচিত্রার সঙ্গে মাখোমাখো গল্প বাজারে চালিয়ে প্রোডাকশন হাউজ সিনেমার কাটতি বাড়াচ্ছেন। হাতেনাতে নগদ মিলছে স্ত্রীর তিরস্কার। উল্টো দিকে সেসবের আঁচ থেকে গনগনে তাপ নিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে নায়িকা নিজেও। সময় সময় তারও মান অভিমানকে দাম দিতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা

এরকম পরিস্থিতিতে উত্তম কিভাবে ক্যামেরার সামনে অত সিরিয়াস ছবিকে প্রতিষ্ঠা করলেন তা ভাবলেই অবাক হয়ে যেতে হয়। আমরা যদি কেউ একবার তাঁর জায়গায় নিজেকে স্থাপন করে ব্যাপারটা কল্পনা করি বোধহয় বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারবো।

যাই হোক আলোছায়া প্রোডাকশনের ব্যানারে চিত্রগ্রহণ এবং পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন অজয় কর। রূপায়নে যথারীতি সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমার। চিত্রনাট্য লিখলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। সংগীত পরিচালনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সম্পাদনায় অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়। প্রধান সহকারী পরিচালনায় হীরেন নাগ। শিল্পনির্দেশনায় সুনিতি মিত্র। প্রদান কর্মাধ্যক্ষ ক্ষিতীশ আচার্য। একমাত্র পরিবেশক ছায়া বাণী প্রাইভেট লিমিটেড এরকম একটা সাজানো-গোছানো সংসারের শুরু হল ‘হারানো সুর’।
দেওদা মানসিক হাসপাতালে স্মৃতিভ্রষ্ট অলোক মুখার্জিকে সেদিন ঝড় জলের মাঝে খুঁজে পাওয়া গেল না। কর্তৃপক্ষ চারদিকে বৃথায় অনুসন্ধান করেন। অলোক ততক্ষণে হাসপাতালে ডাক্তার কুমারী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে হাজির হয়েছে সকলের অলক্ষ্যে। রোগী অলোকের প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে তার বাবার কাছে চলে যাবার তোড়জোড় করছিল রমা। হঠাৎ ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করে রমা, অলোকের ঘুম ভেঙে যায় ভীতিবিহল অলোকের কাতর অনুরোধে রমা মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেলে তাই অলোকের সন্ধানে আসা পুলিশের লোকজনকে ফিরে যেতে হয়। রোগীর বান্ধব আত্মীয় সেবিকা রমা, তাঁকে রোগমুক্ত করার জন্য রওনা হয় নিজের বাড়ি পলাশপুরে।

পলাশপুরের মাটি-জল-আকাশ- বাতাস নতুন হয়ে ধরা দেয় অলক্ষ্যে। একসময় পরিচর্যা পূর্ণাঙ্গ করতে রমাও ধরা দেয়। তুলে নেয় সকল দায়িত্ব কর্তব্যের অনুরোধে অসহায় অলোককে শুধু চিকিৎসকের করুণা দিয়েই নয়, স্ত্রীর প্রেমে মমতায় সঞ্জীবিত করতে রমা এগিয়ে আসে। দিন বয়ে যায় হাসি গান কলরবে পলাশ ফুলের সোনার দিন আর রুপালি রাত।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

এই ভরা আনন্দের হাটে সহসা দুঃখের রাগিনী বেজে ওঠে। রমার সাময়িক অনুপস্থিতির অবসরে পথে অলোক মোটর দুর্ঘটনায় পতিত হয়। আঘাত পায় সে সামান্যই কিন্তু ফিরে পায় সেই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া অতীতকে, বিস্মরনণের কুয়াশা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, গত দিনের স্মৃতি যেমন জেগে ওঠে তেমনি বর্তমানে সবকিছু পড়ে যায় ঢাকা। ফিরে যায় কলকাতায়। শুরু হয় তার পূর্বের জীবন। পলাশপুর অধ্যায় সম্পূর্ণ আত্মগোপন করে নেপথ্যে।

অতর্কিত আঘাত নামায় রমা, জীবনে ধৈর্য হারা না হয়ে বিপদকে বরণ করে। স্বামীর খোঁজে সে চলে আসে কলকাতায়। বহু চেষ্টায় অলোক কিন্তু রমাকে চিনতে পারেনি। বিস্মরণ কপটতা নয়। রমা সেই কারণেই সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় সবকিছু দুঃখ সহ্য করতে করতে। কিন্তু স্ত্রীর পরিচয়ে নয় গভর্নেস রূপে ভাগ্নী মালাকে পড়াতে। আশার আলো মনের কোনও উজ্জ্বল হয় এই ভাবেই হয়তো একদিন জীবন বীণার হারানো সুর আবার সুর তান লয়ে ঝংকৃত হয়ে উঠবে।
কল্পনার ক্ষেত্র উদার উন্মুক্ত, বাস্তবের যাত্রাপথ বন্ধুর দুঃখময়। সেখানে পদে পদে বাধা। কথায় কথায় সন্দেহ। তারি মাঝে শুরু হয় রমার কৃচ্ছসাধনা; জীবন- দেবতা কত নিকটে, তবু কি দুস্তর ব্যবধান রয়েছে উভয়ের মাঝে। রমার কথার আচরণে অলকের ভোলা মন আকুল হয়ে উঠে—কে এই মেয়েটি? কিছু মনে করতে পারে না।

ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় রমা অলোকের স্মৃতির তন্ত্রী আন্দোলন করে যায় বারে বারে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তবু সে হার মানেনা। অলোকের বাগদত্তা বধূ লতার কাছ হতে আসে তীব্র বাধা। লতা অন্তরায়। অজ্ঞাত কুলশীলা রমার প্রয়াসে। অলোকের প্রতি রমার আচরণ অসহনীয় তাই জন্য। না না, তা কী করে সম্ভব।

অবশেষে সময় আবার দুজনকে দুজনের দিকে এগিয়ে দেয়। ছবির শেষ দৃশ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় কণ্ঠে রমা রমা বলে আকুল আর্তি দর্শকদের চোখে কখন যে আনন্দের অশ্রু এনে দিয়েছে কেউ বুঝতে পারেনি! এ ছবির আর কি মূল্যায়ন বাকি রইল যার সুর আজও হারানো।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content