রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মুক্তির তারিখ: ০২/০৮/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ: দর্পণা, ইন্দিরা ও প্রাচী
পরিচালনা: মানু সেন
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: রমেশ
সে এক অন্য সময় শুরু হয়েছে উত্তম কুমারের হাত ধরে। পাড়ায় পাড়ায়, নগরে নগরে শুধু তারই জয়জয়কার। ১৯৫৭ সাল তাঁর জীবনে যে পরিমাণ এবং যে মানে সাফল্যের তরী বয়ে এনেছিল সারা জীবনে এই বছর আর একটাও আসেনি। মাত্র দশ বছর আগে যে শিল্পী সকলের মাঝে একটু জায়গা পাবার জন্য মাথা ঠুকে মরেছেন, আজ তাঁরই কাছে সকলে এসে নিজেকে নিবেদন করার জন্য মাথা ঠুকছে। একদিকে ‘হারানো সুর’ ছবির প্রযোজনা ও মূল নায়কের চরিত্রের রূপদান, অন্যদিকে চলছে পেশাগত নায়কের চরিত্রে অন্য পরিচালকের তত্ত্বাবধানে নিজেকে উপস্থাপন।

আসলে মানুষের জীবনে যখন সবুজ অধ্যায় চলে তখন রক্তিম অধ্যায় ভেবে দেখতে বেশ কষ্ট লাগলেও সেটাও সুখকর অভিজ্ঞতার বাহক হিসাবে কাজ করে। ‘হারানো সুর’ ছবি এমন একটি মাইলস্টোন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে এবং উত্তম কুমারের ফিল্মি ক্যারিয়ারে যে অন্য অনেক ছবি নির্মাণ হয়েছে এর মুখ চেয়ে। আমরা আজকে ‘পুনর্মিলন’ ছবির মূল্যায়ন করতে বসে কেন ‘হারানো সুর’-র সালতামামিতে মেতে উঠলাম সেটা কিছুটা বলা সঙ্গত না হলে সারস্বত মর্যাদা কোন ছবিরই তৈরি হবে না।

‘পুনর্মিলন’ মানু সেনের পরিচালনায় উত্তম কুমারের জীবনে এক বছরে দুটি ছবি মুক্তির ইতিহাসের সাক্ষী। বছর শুরু হয়েছে ‘হারজিত’ ছবি দিয়ে আবার মাস আষ্টেকের ব্যবধানে একই পরিচালকের আরেকটি ছবিতে উত্তম কুমারের অভিনয়।
বিষয়টা ব্যবসায়িক দিক দিয়ে স্বাস্থ্যকর হলেও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সুস্বাস্থ্যের পরিচয় নয়। কিন্তু উত্তম কুমার নামক ম্যাজিক থাকাতেই একজন পরিচালক কতটা উৎসাহী হলে তবে একই বছরে একই নায়ককে দুটি ছবিতে কাষ্ট করেন তা ভেবে দেখার বিষয়। আসলে উত্তম বাবুর সমস্ত কেরিয়ারে যে মানের ছবি মুক্তি পেয়েছে সেখানে একটা মাপকাঠি না রাখলে নয়। উনি নিজের ক্যারিয়ার সম্বন্ধে ভীষণ উদাসীন ছিলেন এবং টলিউডের বাংলা ইন্ডাস্ট্রির একজন নির্ভরযোগ্য সচেতন অভিভাবক যখন পরিণত হয়েছিলেন তখন বিধাতার অলঙ্ঘন নিয়মে তাকে চলে যেতে হয়েছে।

তিনি যদি চিন্তা ভাবনা করে ছবি নির্বাচনে মন দিতেন তাহলে যে ছবিগুলো কালজয়ী হয়েছে সেগুলোর মান আরো ভালো হতো। তবে যাঁরা ক্ষণজন্মা তাঁদেরকে এত চিন্তা করার সুযোগ ঈশ্বর দেন না, আবার তাঁরা যেটা করে বসেন সেটাই সকলের কাছে অভাবনীয় হয়ে ওঠে। ‘পুনর্মিলন’ ছবিতে নায়িকার চরিত্রে যথারীতি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল।

এ বছরে মোট চার থেকে পাঁচটি ছবিতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে বিভিন্ন ছবির পরিচালকরা বা প্রোডাকশন হাউজ কাস্ট করেছিলেন। অধিকাংশ ছবিতে সুচিত্রা সেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনিতা গুহ, সন্ধ্যারানি ইত্যাদি। সুচিত্রা সেনের পাশাপাশি সিরিয়াস ছবিতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি দর্শকের মনে যথেষ্ট দাগ কেটেছে। যেমন সুচিত্রা সেনকে পছন্দ করা অত্যন্ত প্রিয় একজন পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত তিনি আর কিছুদিন পর ‘অভয়ের বিয়ে’ নামক একটি মনে রাখার মত ছবি নির্মাণ করবেন যেখানে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রাখবেন। এ ভাবে উত্তম কুমারের বেয়ে চলা তরীতে কখনও সুচিত্রা সেন, কখনও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পালে হাওয়া দিয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

আমরা ‘পুনর্মিলন’ ছবির মূল কেন্দ্রে প্রবেশ করলে দেখতে পাবো ছবিটি আগাগোড়া একটি পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্রবিন্দু করে আবর্তিত হয়েছে। সেখানে জহর গঙ্গোপাধ্যায় নামক একজন মেধাবী চরিত্রাভিনেতাকে পরিচালক সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন একটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া এবং পুনরায় গড়ে ওঠার যাত্রাপথই পুনর্মিলন ছবির কাহিনি। আমরা এই ছবিতে অত্যন্ত ব্যস্ত উত্তম কুমারের বেশ কিছু গুণাবলী দেখতে পাবো সেগুলো ধীরে ধীরে আলোচনা করব ছবির প্রেক্ষিতে।

উত্তম কুমার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনে চলতেন না কখনও। অভিনেতার মূল কর্তব্যই তো চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে বদলে বদলে নেওয়া। সেটাই কাঙ্খিত। নয়তো পড়ে থাকে তো শুধুই স্টারসত্তা, ইমেজ। অভিনেতার আর চরিত্র হয়ে ওঠা হয় না। কিন্ত উত্তমকুমার এখানেই আলাদা।

এ প্রসঙ্গে তাঁর দুটি ছবির কথা বলা যায়। এক হল ‘স্ত্রী’, অন্যটি ‘সন্ন্যাসী রাজা’। খেয়াল করুন চরিত্রে কতোটা মিল। সেই রোয়াব, দাপট, মদ্যপানের অভ্যাস, বাইজি, গান-টান মিলে একাকার। ওই যে স্ত্রী ছবিতে বলছেন না… “তোমার হাতে পাউডার মাখতে এলুম…” ওইটাই তো মোটের উপর মুড, দুটি চরিত্রেরই, কিন্তু এখানেই তিনি অনন্য। মিল সত্ত্বেও তিনি দুটি চরিত্র পৃথক করতে সক্ষম হচ্ছেন। যে কেউই চেনা একটা ফর্মুলায় ফেলে নিত হয়তো, উত্তমকুমার সেখানেই সমস্ত অবয়ব এক রেখেও অদ্ভুত এক সূক্ষতা আনলেন হেলায়। এই না হলে জাতশিল্পী!
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-৩: অবশেষে অভাবনীয় প্রাপ্তি ও স্বপ্নপূরণ

আসলে চরিত্রের সঙ্গে তাঁর কোনও দূরত্ব থাকত না একটুও। অভিনীত চরিত্রের গহনে প্রবেশ করতে পারতেন তিনি, খড় মাটির কাঠামোয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। এখানেই তিনি অনন্য। ‘পুনর্মিলন’ ছবিতে এভাবেই সুচিত্রা সেনের সঙ্গে রোম্যান্টিক যুগের মধ্য গগনে পারিবারিক দায়িত্ব সচেতন বড়ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মন টেনে নিয়েছিলেন তিনি।

ছবিটিতে সব উল্লেখযোগ্য বিষয় পার্শ্বচরিত্রাভিনেতাদের দাপট। যেমন জহর গঙ্গোপাধ্যায় তেমন পাহাড়ি সান্যাল তেমন ছবি বিশ্বাস এনাদের অভিনয়ের সূক্ষ কারুকার্য ছবিটিতে যেন চাঁদের হাট বসিয়ে দিয়েছিল। আর সামাজিক প্রেক্ষিতে মানুষের মানসিক গঠন কিভাবে বদল ঘটে তার একটা সাক্ষাৎ দলিল এ ধরনের ছবিগুলো। পৃথিবীতে যুগে যুগে যত শিল্পনির্মাণ হয়েছে সেখানে সমসাময়িক মানুষের আনন্দ বেদনার কথাই তো নানা রূপে ধ্বনিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার

‘পুনর্মিলন’ ছবিও সেই বাঁধা গতের বাইরে নয়। আমরা যে মন নিয়ে ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’ দেখেছি তার প্রস্তুতিপর্ব ছিল এ ছবিগুলি। এ ছবিগুলো ছিল বলে উত্তমকুমার ওই ধরনের কালজয়ী ছবিতে নিজেকে তিলে তিলে প্রস্তুত করতে পেরেছেন, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মনে রেখেছিলেন।

আজকের যুগে এই ছবিটির রেটিং হয়তো খুব বেশি হবে না কারণ যেখানে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস চলছে ‘অমানুষ’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘সাগরিকা’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’-এর মতো ছবি। কিন্তু একটা সুন্দর পরিবারের অংশীদার হওয়ার মধ্যে মানুষের চোখে মুখের যে পরিবর্তন ঘটে সেগুলো যেন উত্তমবাবু অত্যন্ত সচেতন ভাবে ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
বড় ছেলেকে বাবা-মা যখন অবলম্বন করতে চাইছেন এবং একটা সময় সেই অবলম্বন যখন নড়বড়ে হয়ে বাড়ির বড় ছেলে বাড়ি ছাড়া হয়েছে এবং সেই ছেলে আবার পুনর্মিলনের আহ্বান নিয়ে ছবির সমাপ্তি দৃশ্য বাড়ি ফিরছেন সেসময় ক্যামেরার সামনে ওনার চোখে মুখের যে অভিব্যক্তি তা যে কোন দেশের যেকোনও অভিনেতার অনুসরণীয়। ছবিটির অন্যান্য ত্রুটি মানুষকে এ ছবির জন্য বেশি ভাবতে বাধ্য না করলেও উত্তমবাবু নিজে ভালো ভালো ছবির জন্য অনেকটা প্রস্তুতি পর্ব সেরে নিতেন এ ধরনের ছবিতে অভিনয় করে। যে কারণে তিনি সকলের নয়নের মণি মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content