রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


সে এমন এক সময় যখন এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। মানুষ কোন হল-এর সিনেমা ছেড়ে কোন হল-এর সিনেমা দেখবে! কারণ, এক বছরে শুধুই তো উত্তম কুমারের ছবি রিলিজ হতো না। আরও অন্যান্য কলা কুশলীদের, অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের এবং অন্যান্য পরিচালকদের ছবি রিলিজ করত।

ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বোধহয় খুবই বিরল যে, কোনও একটি মাসে কোনও একজন নায়কের ছবি দুটি বা তিনটি একেবারে বেরোচ্ছে এবং প্রত্যেকটি হাউস ফুল যাচ্ছে। তখন উত্তম কুমার মানেই হাউসফুল আর হাউসফুল মানেই উত্তম কুমার। মানুষ যেন গিলতে যায় উত্তম কুমারের এক একটা সিনেমা।
আর উত্তমবাবুরও ক্যারিশমা বলিহারি! প্রত্যেক ছবিতেই নতুন নতুন কিছু সংযোজন করবেন, যা মানুষকে মশা মারতে ভুলিয়ে রাখবে। প্রতিটা ছবিতে চরিত্র অনুযায়ী তার চিত্রায়ণ অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের থেকে উত্তমবাবুকে অনেক কদম এগিয়ে দিয়েছিল। আমার ব্যক্তিগতভাবে মাঝে মাঝে মনে হয়, উত্তমবাবু যদি সময় পেতেন প্রত্যেকটি চরিত্রকে নিয়ে ভাবার তাহলে আমরা ওঁর থেকে আরও বেশি ভালো কাজ পেতাম।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী

কিন্তু ওঁকে কেন্দ্র করে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল তাতে একটি চরিত্রকে নিয়ে খুব বেশি ভাবার সময় তিনি পাননি, যেটুকু ভেবেছেন সেটুকুতেই অনবদ্য। কারণ উনি ক্ষনজন্মা। ওঁদের বেশি ভাবতে হয় না। যেখানে মাথার উপর বোঝা হয়ে ছেপে আছে নিজের প্রযোজনা। করা ছবির নানা রকম দায়িত্ব সেখানে প্রতিটা ভিন্নমাত্রিক ছবিতে নিজেকে উপস্থাপন বেশ কঠিন ব্যাপার।
আমরা হলিউডি অভিনেতাদের যদি ছবির ইতিহাস আলোচনা করি তারা হাতে গনে ৩০ বছরে ৩০টা ছবি করেছেন কিনা সন্দেহ! কিন্তু প্রতিটা ছবিতেই কালোত্তীর্ণ হবার উপাদান রেখে গেছেন। এমনকি বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র শিল্পী চার্লি চ্যাপলিনও একই বছরে এতগুলো ছবিতে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু উত্তমবাবুকে করতে হয়েছে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ সুরক্ষা করতে তাকে এ ধরনের বহু ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছে। কিন্তু মনে রাখার বিষয় একটাই প্রতিটা ছবিতেই উনি স্বর্ণ স্বাক্ষর রেখেছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৯: দিলবর মেরে কব তক মুঝে…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

এরকম একটা প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে ‘সুরের পরশে’ ছবি তৈরি হয়েছে, মুক্তি পেয়েছে। ক্যামেরার পিছনে যিনি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তার নাম চিত্ত বসু। তৎকালীন যুগের হেভি ওয়েট পরিচালক উত্তম কুমারের কেরিয়ারের বেশ স্মরণীয় কিছু ছবি পরিচালনা করে তিনিও বাজারে বেশ অগ্রণী।

এই ছবির সুর সংযোজনার দায়িত্ব নিয়েছেন অনুপম ঘটক একদা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ খ্যাত এবং সর্বকালের সেরা বেশ কিছু গানের স্রষ্টা। মূল ধরার বাণিজ্যিক ছবিতে যথারীতি ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, পাহাড়ি সান্যাল ও তুলসী চক্রবর্তী থাকবেনই।
ওঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে নায়িকার চরিত্রে মালা সিনহা, যিনি আর কিছুদিন পরে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাড়া জাগানো নায়িকাদের মধ্যে একজন রূপান্তরিত হবেন। এরকম স্টাফ আর্টিস নিয়ে ‘সুরের পরশে’ ছবি রিলিজ করলো, ছবিটির সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা চলমান অন্যান্য হিট ছবি অপেক্ষা উন্নত হয়নি বলে সে বছরের রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়েছে।

ছবিটিতে চিত্রনাট্যের তেজ অপেক্ষা উত্তমবাবুর উপস্থিতিকে গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছিল। তাই এর অনেক শিল্প গুণ পাশাপাশি ছবি অপেক্ষা পিছিয়ে পড়েছে। মানুষের চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে সমস্যার যদি বীজ লুকিয়ে থাকে তাহলে পরবর্তী অনেক অংশে তা বৃহত্তর ফল দান করে।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৫: দিল মেরা বানজারা!

‘সুরের পরশে’ প্রকৃতপক্ষে মিউজিক্যাল হিট বানানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু অনুপম ঘটক যে ধরনের মিউজিক নির্মাণে অভ্যস্ত তাতে ‘মণিহার’, ‘শাপমোচন’ এ ধরনের ছবি না করতে পারলে লাভ নেই। সে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ যখন মুক্তি পেয়েছে মানুষ ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’ দেখেননি। ‘পৃথিবী আমারে চায়’ দেখেননি যে কারণে মাথায় তুলে নিয়েছেন কিন্তু সেগুলো দেখার পর, হৃদয়াঙ্গম করার পর ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’-র মতো ব্লকবাস্টার হিট গান না থাকলে বা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-র মতো গান না থাকলে মিউজিকাল হিট ছবি বানানো কঠিন ছিল। পরিচালকের সেই দিক দিয়ে দূরদর্শিতার অভাব এ ছবির ছত্রে ছত্রে দেখা গিয়েছে।
আগেই বলেছি ক্যামেরা এবং চিত্রনাট্যে উত্তম কুমারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ছবিটি কিছুটা গোড়ায় গলদ এর সমস্যায় ভুগেছে যার ফলে সে সময় মানুষ ‘তাসের ঘর’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ দেখে যে আনন্দ উপলব্ধি করেছিলেন ‘সুরের পরশে’ দেখে সমপরিমাণ আনন্দ পাননি।
চিত্রমোদীদের ভাষায় ছবি শুধু উত্তম কুমারের কারণে প্রযোজককে পয়সা ফেরত দিয়েছে। অন্য নায়ক থাকলে ডাহা ফেল করত।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content