রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


এ ছবি অন্য কারণে স্মরণীয়। একসময় বছরে একটা ছবি পেতে যে লোকটাকে সারা বছর দরজায় দরজায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাঁর একটা সময় এসেছে যখন এক মাসে দুটো ছবি মুক্তি পাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস তার গর্ভধারণ করছে এই ভাবে, কলকাতার বুকে যত মেন স্ট্রিম ছবি মুক্তির ব্যবস্থা আছে সেসব হল-এ আর উত্তম কুমারের ছবি রিলিজ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ যে ছবি একবার রিলিজ করছে সেই রিলিজিং চেন ছেড়ে সে ছবি সহজে সরছে না।

ফলে বাঙালি নতুন করে যেমন প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায় নামছে তেমনই উত্তম কুমারের ছবি রিলিজ করার মতো হলও সেই মুহূর্তে কলকাতার বাজারে কম পড়ে যাচ্ছে। এরকম একটা সময়কে মাথায় নিয়ে আমরা আজকের ছবি আলোচনা করব। সালতামামি ঘাঁটলে যে তথ্য উঠে আসবে তাতে গড়পড়তা লোকও বুঝতে পারবে; শহরাঞ্চল বা মফস্বলের যে হল-এর দিকেই তাকানো হোক না কেন, বছরের বেশিরভাগ সময়ই উত্তম কুমারের ছবিতে তা ভরা থাকতো।
কলকাতার বুকে রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী; শ্রী, প্রাচী ও পূর্ণ; মিনার, বিজলি ও ছবিঘর এবং উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলা—এই রিলিজিং চেন একচেটিয়া ছিল। কিন্তু চারটি চেনই সারা বছর ব্যস্ত থাকার দরুন মাঝে মাঝে সেখানে রাধা, বসুশ্রী এ ধরনের হলগুলো ঢুকে পড়তে লাগলো।

বিষয়টার গুরুত্ব এখানেই যে, উত্তম কুমারের ছবি রিলিজ করার প্রয়োজনে নতুন করে প্রেক্ষাগৃহের যোগান খুব দরকার। একটা শিল্পের এত বড় গৌরবের অগ্রদূত উত্তমবাবু। একজন অভিনেতার কাছে এর চেয়ে বড় সম্মানের আর কি হতে পারে!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

ছবিটার আলোচনা শুরু করব সেই প্রেক্ষিতে যেখানে স্বয়ং অভিনেতা পাশাপাশি প্রযোজনায় নেমেছেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই সেই ব্লকবাস্টার ‘হারানো সুর’ ছবি মুক্তি পাবে; সেই মুহূর্তে উত্তমবাবু চরম ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ‘তাসের ঘর’ ছবির নির্মাণ পর্বে। ছবির পরতে পরতে ইতিহাসের হাতছানি।
প্রথমত: এই প্রথম দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করা।
দ্বিতীয়ত: পরিচালক একেবারে নতুন।
তৃতীয়ত: দ্বৈত ভূমিকার সুবাদে অপরিচিত নায়িকার আগমন।

এত কিছুর মেলবন্ধনে ছবিটির আপাদমস্তক ঘটনায় ভরা। উত্তমবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সেই প্রথম আমি দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করার কৌশল রপ্ত করি। মঙ্গল চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে খুব ভালোভাবে বিষয়টা বোঝাতে পেরেছিলেন।’
আমরা ঘুরেফিরে যে সমস্ত তথাকথিত পরিচালকদের নমস্য করে মাথায় রেখে একজন জাত অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সম্মান রক্ষা করি মঙ্গল চক্রবর্তী তাঁদেরই একজন ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ভদ্রলোক যথাসময়ে যথা স্বীকৃতি পাননি। তাঁর পরিচালনার যদি সাল তারিখ ধরে ইতিহাস আলোচনা করি সেখানে দেখা যাবে মেন স্ট্রিম বাংলা ছবির সেরা পরিচালকের তকমা পাওয়া তার কাছে কোন ব্যাপার ছিল না। অন্তত নির্মাণ কৌশল দেখে।

বাংলা ছবির জগতে সত্যজিৎ রায়ের আগমনের পর সারস্বত সম্পদ দু’ ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একটা ছিল ‘আর্ট’ আর একটা ছিল ‘ইন্ডাস্ট্রি’। সত্যজিৎ বাবুকে ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবতে হয়নি। আবার অঞ্জন চৌধুরী জাতীয় পরিচালকদের আর্ট-র কথা ভাবতে হয়নি। উত্তম কুমার এমন একজন অভিনেতা ছিলেন যিনি আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রির একজন সার্থক সেতু হতে পেরেছিলেন। তাই দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব তাঁর কাছে কখনওই অতিরিক্ত বলে মনে হয়নি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

ছবিটির কাহিনি অনুযায়ী চিত্রনাট্য এমন সুন্দর করে বোনা হয়েছিল যে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, তাঁরা সবাই ছবিটিতে আকর্ষণ বোধ করেছিল। দুটি বিপরীত মেরুর লোকের মানসিক অবস্থান দু’জনকে কিভাবে ক্লান্ত করে তুলেছিল এবং সেই ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাবার উপায় স্বরূপ একটা নতুন চিন্তা কীভাবে মানুষকে চালিত করতে পারে তা’ই ছিল, এ ছবির মূল বিষয়বস্তু।

এর আগে আমরা ধনীর উন্মাদ অবস্থা এবং তার পরিণতিস্বরূপ কি হতে পারে বিভিন্ন ছবিতে তা দেখেছি। পাশাপাশি দেখেছি দরিদ্রের লড়াই করে সংগ্রাম করে উপর তলায় আসার চেষ্টা। নিজের মেধার যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা। সেখানে গতানুগতিক ধারায় চিরকাল আশীর্বাদ হয়ে নেমে এসেছে নারীর কল্যাণময়ী মূর্তি।
ধনাঢ্যের অহংকারে বিপথগামী স্বামীকে সুপথগামী করতে ত্যাগ- তিতিক্ষা-ধৈর্য ও সংযমের স্পর্শ দিয়ে সমগ্র সমাপ্তিকে কল্যাণে স্পর্শে ভরিয়ে দিয়েছে নায়িকার ত্যাগের সৌন্দর্য। অন্যদিকে হতদরিদ্র শতচ্ছিন্ন পরিবার থেকে যোগ্যতা নিয়ে উঠে আসা নায়ককে প্রতিষ্ঠা করতেও নায়িকার ত্যাগ-তিতিক্ষা-ধৈর্য-সংযমকে মূলধন করে ছবির সমাপ্তিকে কল্যাণময় করে তুলেছে নারী হৃদয়।

কিন্তু দেশভাগ অনন্তর মানুষের সমস্যাকে উত্তরণের চেষ্টা স্বরূপ পারস্পরিক চিন্তা বিনিময় বোধহয় বাংলা ছবিতে প্রথম দেখা গেল। তাই ছবিটি কাহিনির ঘনঘটায় অনেক এগিয়েছিল সমকালীন অন্যান্য ছবি থেকে।
আমরা ১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার ছাড়াও যেসব ছবি মুক্তি পেয়েছে সেগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাবো, এ ধরনের চিন্তাভাবনা সমৃদ্ধ ছবি, সেসময় সত্যজিৎবাবুর মতো মৃণাল সেনের মতো পরিচালকরাও করতে সাহস পাননি যা পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী করিয়েছিলেন।

আসলে মঙ্গল চক্রবর্তী চিরকালই একটু সাহসী পরিচালক। তাঁর ছবির লেখচিত্র যদি আমরা লক্ষ্য রাখি, সেখানে দেখব,উত্তমবাবুর ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ‘আমি সে ও সখা’ নামক যে ছবিটি রিলিজ করেছিল সেখানে কত সাহসী চিন্তাভাবনার পরিচয় পরিচালক রেখেছিলেন তা ভাবলে আজকের দিনে শিউরে উঠতে হয়। ‘আমি সে ও সখা’-র মতো আধুনিকমনস্ক ছবি বাংলা ছবিতে মায় ভারতীয় ছবিতে খুব কমই হয়েছে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

মার্জিত রুচিশীল একটা ভদ্র-সভ্য ছবির আন্তরিক গভীর আবেদনময় সাড়া নিয়ে ছবিটিতে বিরাজ করা, কোন চিন্তাভাবনার উৎসকে পরিপূর্ণ করার একটা ভাবনা সেটা পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী দেখাতে পারতেন। কয়েক বছর পর ‘সোনার হরিণ’ বলে একটি ছবি উত্তম বাবুকে নিয়ে উনি করবেন সেখানেও কাহিনীগত সাহসী চিন্তাভাবনার ফসল উনি দেখাবেন।

যাই হোক, আমাদের আলোচ্য আজকের ‘তাসের ঘর’ ছবিটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় গানের দিক দিয়ে খুব এগিয়ে ছিল। বিশেষত ‘শূন্যে ডানা মেলে, পাখিরা উড়ে গেলে’ গানটি বাংলার মুখে মুখে ফিরত। ‘শাপমোচন’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘বন্ধু’ এ ধরনের সংগীত বহুল ছবির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ছবির মূলধারায় ‘তাসের ঘর’ ছবির গান মানুষকে সেসময় অনেক বেশি প্রভাবিত করেছিল সে কথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের জবানবন্দিতে অনেকবারই বলেছেন।
ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে যে সমস্ত কলাকুশলীরা অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে চন্দ্রাবতী দেবীর অভিনয় মানুষের অনেক মন কেড়েছিল নায়িকার চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের তো কোন তুলনা ছিল না। কিন্তু নতুন নায়িকা হিসেবে দেবযানীর আগমন, ছবিটাকে অন্য মানে পৌঁছে দিয়েছি যার সারস্বত প্রভাব আজও বাংলার অন্যান্য ছবিতে বর্তমান।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content