বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


মুক্তির তারিখ: ০৩/০৫/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী
পরিচালনা: নীরেন লাহিড়ী
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: তাপস
‘পৃথিবী আমারে চায়’, উত্তম কুমারের ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর জনপ্রিয়তার নিরিখে যে মাপকাঠি স্পর্শ করেছিল তার মধ্যে একটি। আমরা এই সালের সালতামামি আলোচনা করে দেখতে পেয়েছি, প্রায় অধিকাংশ ছবি সফল থেকে সফলতম-র দিকে এগিয়ে গিয়েছে এবং সারা জীবনে উত্তম কুমারের যে রেট অফ সাকসেস, এই বছরের মতো আর কোনও বছরে তা দেখা দেয়নি। ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। পরিচালনায় সেই অপ্রতিরোধ্য নীরেন লাহিড়ী।উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের পশুরু থেকে এক ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের উদাহরণ রেখে গিয়েছেন। সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন সদ্য সংগীত পরিচালনায় সাফল্য পাওয়া নচিকেতা ঘোষ।
আমরা ফিল্মটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে সবার আগে লক্ষ্য করব, একজন গায়ক তাঁর জীবনের ওঠা-নামাকে কীভাবে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে স্থাপন করছেন। সমস্ত গায়কের তথা শিল্পীর জীবনে থাকে অনেক কিছু উত্থান পতন। আমরা এখানে শিল্পীকে দেখেছি তাঁর রক্তাক্ত চিত্রের মাধ্যমে নতুন ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করার একটা নেশা।

দর্শক মনের চাহিদায় এবং মানুষের মানসিক বৃত্তির অদেখা হাতছানিতে স্বভাবতই এসে পড়েছে নায়িকার উপস্থিতি। একটা সময়ের পর নায়ক-নায়িকা উভয়ে যখন সমমনষ্ক হয়ে চলার শপথ গ্রহণ করছেন সে সময়টাও কিন্তু বাঁধিয়ে রাখার মতো।

সবচেয়ে বড় গুণ উত্তম কুমার বাঁধা ধরা ইমেজ ভেঙে এসে নতুন ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। খুব সচেতনভাবে দেখাতে পারার সুযোগ পেয়েছেন শিল্পী হয়ে বেঁচে থাকার প্রথম দিকে তাঁকে কত হেনস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর আগে ‘শাপমোচন’ ছবিতে আমরা দেখেছি, গায়ক হিসাবে তার প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের নানা মানসিক দ্বন্দ্ব।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২২: এদিক ওদিক বেড়ায় তবু ভুলের পাড়া বেড়ায় না

এখানেও একই কাহিনি প্রায় আমরা অন্যরূপে দেখতে পাব। ঘরেতে অভাব, সেই অভাবের তাড়নায় আর কিছু করার না পেয়ে আমরা দেখব গায়ক সত্তাকে বেছে নিয়েছে একজন সুমনের মানুষ। এরও পরবর্তীকালে ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে আমরা দেখতে পাবো গান গাওয়া কেন্দ্র করে একটা শিল্পীর জীবনের কি ওঠানামা! উত্তম কুমারের সারা জীবনে যত ছবি করেছেন সেখানে যেন উনি শিল্পী হলেই নানা ধরনের অভিশাপ নেমে আসে। তার নিজের জীবনটা যেহেতু অনেক চড়াই উৎরাই-র সাক্ষী কে বহন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে তাই এই রোলে উত্তমবাবু ফুলে ফুলে ভরে উঠতেন।
যদি মাইলস্টোন ছবিগুলোকে একে একে সাজাই সবার আগে দেখবো ‘শাপমোচন’ পরের ধাপে ‘পৃথিবী আমারে চায়’ তার পরের ধাপে ‘দেয়া নেয়া’ তারও অনেক পরে ‘সোনার খাঁচা’। গায়ক উত্তম কুমারের যেন নতুন করে বেঁচে থাকার একটা রীতি মানব সমাজে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

বাস্তবের কঠিন মাটিতে একজন গায়কের জীবন কত দুর্বিষহ হতে পারে তার প্রতিটি অংশ, উত্তম বাবু ফুটিয়ে তুলেছেন এই ছবিতেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় তাঁর মুখের এক্সপ্রেশন। শিল্পী জীবনে তাঁর অভিনেতা হওয়ার প্রথম দিককার যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেগুলোই যেন এ ছবির চিত্রনাট্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

আমরা সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ দেখে উত্তমবাবুর জীবন আলেখ্য ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু ‘শাপমোচন’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘দেয়া নেয়া’ এবং ‘সোনার খাঁচা’ উত্তম কুমারের চারটি বয়সে চারটি ছবি। এই ছবিগুলো দিয়ে যদি একটা মালা গাঁথা যায় সেখানে একজন শিল্পীর জীবনের ওঠা নামা, জনপ্রিয়তা পাবার পর তার মানসিক স্বাস্থ্য আমরা লক্ষ্য করতে পারব।

‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবিটিতে উত্তমবাবু সবচেয়ে বেশি যে জায়গাটা প্রদর্শন করেছেন তা হল ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন। চিত্রনাট্যের দাবি অনুযায়ী হাত-পা ও আঙ্গিক অভিনয় ছাড়াও মুখের অভিব্যক্তি কত নিখুঁত করে তুললে একজন সার্থক অভিনেতা হওয়া যায় তা তুলসী চক্রবর্তীকে না দেখলে বাংলা ছবির জগত জানত না। কিন্তু এই ছবির মাধ্যমে জানান দিলেন উত্তমবাবু । ‘নায়ক’ জাতীয় ছবিগুলোর বহু আগে উত্তম বাবু এধরনের অভিনয় শুরু করেছিলেন একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে উনি প্রতিটি ছবিতেই নিজেকে নায়ক হিসাবে না চরিত্র অভিনেতা হিসাবে প্রকাশ করেছেন। যে কারণে তাঁর মুখে গান এত প্রাণ পেতো।
অন্যান্য নায়করা বা অভিনেতারা গানকে যেভাবে গাইতেন তখন তাঁদের নিজেদের ওস্তাদ বলে মনে হত। কিন্তু উত্তমবাবু গানটিকে একজন চরিত্র অভিনেতার মুখে কথা যেভাবে ফোটে সেভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। আজকের প্রযুক্তি নির্ভর চলচ্চিত্রে যেখানে কলাকুশলীদের অল্প পরিশ্রমকে মূলধন করে টেকনিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। উত্তম বাবু বেঁচে থাকলে বোধহয় এই প্রযুক্তি অনেকটা ধাক্কা খেতে। কারণ তিনি নিজেই শেষের দিকে হয়ে উঠেছিলেন একটি ইন্সটিটিউশন। তাঁকে মডেল করে ছবির আঙ্গিক নির্মিত হতো। যার শুরু এই “পৃথিবী আমারে চায়” ছবির মতো ছবিগুলো।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

আর একটা ব্যাপার মনে রাখার মত এ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এবং গীতা দত্তের কণ্ঠে যে স্বর্ণ মাধুরী মেশানো গান তা সারা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা অমূল্য সম্পদ। সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষের কপাল খুলে গিয়েছিল ছবিতে সংগীত পরিচালনা করার পর থেকে। এরপর যত মিউজিক্যাল হিট ছবি নচিকেতা ঘোষ উপহার দিয়েছেন কোন ছবির সঙ্গে পৃথিবী আমারে চায় ছবির গানের তুলনা হয়নি। এমনকি পরের বছর ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে যিনি মাস্টার ব্লাস্টার করবেন সেই ছবির গানও এই ছবিকে টেক্কা দিতে পারেনি। কালের বিচারে এই ছবি সে সময়তেই সর্বোত্তম উপাধি লাভ করেছিল।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content