শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মুক্তির তারিখ: ২৩/০১/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ: রাধা, পূর্ণ ও প্রাচী
পরিচালনা: অজয় কর
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: সুরেন
এই সেই ছবি যা ১৯৫৭ সালের প্রেক্ষিতে সুপার ফ্লপ হয়েছিল। আসলে মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। ৫৭ সালের সমগ্র ফিল্মি কেরিয়ার বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাব, একটি ছবি উত্তমকুমার আশাহত করেছিল তার মধ্যে ‘বড়দিদি’ অন্যতম। নির্মাণকারী পরিচালক ছিলেন অজয় কর। কেন জানি না শরৎ কাহিনি নিয়ে ওঁর এই প্রথম এবং শেষ ছবি। অথচ একই বছরে ‘হারানো সুর’ তৈরি করে উনি সাফল্যের যে মান স্পর্শ করেছিলেন আজও তা, অমলিন। এর আগে দু-চারটি ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা ম্যাজিক, অজয়বাবু ঠিকঠাক রূপায়ন করতে পারলেও ‘বড়দিদি’-তে এসে সুরেনের ভূমিকায় উত্তমকুমারকে নিয়ে সে ধরনের কোনও সাড়া ফেলতে পারেননি। আবার পাশাপাশি এ বছরেই কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের মতো রক্ষণশীল ও গোঁড়া পরিচালক, উত্তম-সুচিত্রাকে কেন্দ্র করে ‘চন্দ্রনাথ’-র মতো বিগ হিট দেবেন। একই বছরে দুটি শরৎ কাহিনির দু-ধরনের মূল্যায়ন বা দর্শক সমাজের গ্রহণযোগ্যতা, ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে।

আমরা ধীরে ধীরে ‘বড়দিদি’-র ছবির যদি অন্দরমহলে প্রবেশ করি সেখানে দেখতে পাবো ছবিটির নির্মাণে পরিচালকের সে ধরনের কোনও খামতি ছিল না। তাহলে বাণিজ্যিকভাবে ছবিটা কেন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল না যেখানে বাণিজ্যিক ছবির সাফল্য সেসময় দাঁড়িয়ে এক একজন কলাকুশলীর সাফল্যের হারকে অনেকটা নির্ণয় করত। আমরা ধীরে ধীরে সেই আলোচনায় অগ্রসর হব।
প্রথমত, চিত্রনাট্য যা, উত্তমকুমারের ছবির মূল প্রাণকেন্দ্র ছিল সে সময়ে। ভালো চিত্রনাট্যের যোগান বিধায়ক ভট্টাচার্য, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এবং হীরেন নাগ। ওনারা ছবির চিত্রনাট্যের সে ধরনের কোনও উন্নতি করতে পারেননি, অথচ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় যখন একক ভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন দর্শক মাথায় তুলে নিয়েছে সে অংশ পাশাপাশি বিধায়ক ভট্টাচার্য যখন এককভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন দর্শক হাততালিতে ভরিয়ে দিয়েছেন। হীরের নাগের ক্ষেত্রেও কম বেশি সে সাফল্য দেখা দিলেও নৃপেনবাবুর কথা বেশি করে বলতে হয়।আমার মনে হয় অতি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে তিনজনের ছন্দপতন ঘটে গিয়েছিল। ছবিতে উত্তমকুমার আছেন মানেই ছবি হিট হবে এ ধরনের একটা অতি বাড়াবাড়ি মূলক চিন্তা তাদের জাঁকিয়ে বসেছিল। যার ফলে ছবির মূল সুর, তার নিজস্ব গতি হারায়।

দ্বিতীয়ত, সম্পাদনা। কমল গঙ্গোপাধ্যায় যিনি, এর আগে ‘ব্রতচারিনী’ ছবি পরিচালনা করে সমীহ কুড়িয়ে নিয়েছেন এ ছবির সম্পাদনায় তিনি খুব একটা পরিণত ভাবের লক্ষণ দেখতে পারেননি। পরের ধাপে অনেক অংশে কমলবাবুর কুশলী চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া গেলেও এ ছবির ক্ষেত্রে কাঁচা দিকটাই বেশি করে ফুটে উঠেছে।

তৃতীয়ত, ছবির সুর সংযোজন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সংগীত পরিচালনায় ব্যবহার না করার মাশুল হাড়ে হাড়ে দিতে হয়েছে প্রযোজককে। যে ছবিতে অজয় কর পরিচালনা করবেন বা তরুণ মজুমদার পরিচালনা করবেন মা সরস্বতী যেন অদৃশ্য ভাবেই সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-কে সুর সংযোজনার কাজে লাগাতেন। কিন্তু সেখানে অনিল বাগচীর মতো অত্যন্ত চড়াগ্রামের ধ্রুপদী সুরকার ছবির মূল অংশ থেকে বোধহয় অনেকটা সরে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

আরেকটি অন্য কারণ দর্শকদেরকে ভাবিয়ে তুলেছিল ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত ও অমর মল্লিক পরিচালিত ‘বড়দিদি’ মুক্তি লাভ করে। ১৮ বছর পর আবার শরৎ কাহিনি বাণী চিত্তের প্রযোজনায় এবং অজয় করের পরিচালনায় রিলিজ করে।

অজয় কর পরিচালিত ‘বড়দিদি’ সমালোচনা প্রসঙ্গে অমর মল্লিক পরিচালিত ‘বড়দিদি’-র কথা স্বভাবতই এসে পড়বে। দু’ যুগের দুই ছবি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সহজেই এদের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারবেন। অমর মল্লিকের পরিচালনা নৈপুণ্যে এবং পাহাড়ি সান্যাল ও মলিনা দেবীর অভিনয় দক্ষতায় সে যুগের ‘বড়দিদি’ যে এ যুগের ‘বড়দিদি’-কে ম্লান করে রাখবে এ কথা দর্শক মাত্রই স্বীকার করেন।
এক কথায় বলতে পারি ১৯৩৯ সালে তোলা ‘বড়দিদি’ চিরস্মরণীয় আর ১৯৫৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বড়দিদি’ ক্ষণস্মরণীয়। ছবি হিসাবে নিন্দনীয় না হলেও দর্শকমনে অনুভূতি বিস্তারে সে তার অক্ষমতাপ্রকাশ করেছে। গোটা গল্পে সুরেন্দ্রনাথ ও মাধবী এ দুটি চরিত্রের মনের যে বিচিত্র গতি ও ভালোবাসার রূপটি ফুটে উঠেছে আলোচ্য ছবিতে সে রূপটি যথাযথভাবে ফুটে ওঠেনি বলেই ছবিখানি দর্শকমনে তেমন করে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়নি।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৯: যত সুর সবই তোমার…

যত মত, তত পথ, পর্ব-৭: ঈশ্বরে মনে রেখে সংসার ধর্ম—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

সুরেন্দ্রনাথকে এখানে বড় বেশি জরদগব দেখানো হয়েছে। এমএ পাশ করা তরুণ ঠিক অতখানি নিরেট অপদার্থ হয় না। সুরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে শরৎচন্দ্র নিজেই লিখেছেন, ‘সুরেন্দ্রনাথের বল বুদ্ধি ভরসা সব আছে তবু সে কোনও কাজ সম্পন্ন করিতে পারে না। খানিকটা কাজ যেমন সে উৎসাহের সঙ্গে করতে পারে বাকিটুকু তেমনি সে নীরব আলস্যভাবে ছাড়িয়ে দিয়ে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে।’ অজয় বাবুর ছবিতে সুরেন্দ্রনাথ-র প্রকৃতি ফুটে ওঠেনি। এ বিষয়ে অমর মল্লিক তাঁর ছবিতে অনেক বেশি কৃতকার্য হয়েছিলেন। বিন্যাস দোষেই অজয় বাবুর আন্তরিক চেষ্টা নতুন ‘বড়দিদি’ দর্শকমনে আবেগ সঞ্চার করতে পারল না। মাধবী-সুরেন্দ্রনাথ এর মধ্যে যে হৃদয়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় ও অসংলগ্নতা তা স্পষ্ট হয়নি।
আরও পড়ুন:

দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

সেই দৃশ্যে যেখানে নৌকায় মাধবীর কোলে মাথা রেখে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু যেমন গল্প ছাড়া তেমনি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ‘তারে পাইলাম তবু কপাল দোষে পাওয়া সইল না’-এ গান ছবির রস-সঞ্চারকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করেছে।

ছবির শুরুতেই ভূমিকালিপির সঙ্গে বলা হয়েছে এ ছবির কাহিনি, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের অথচ বহু ক্ষেত্রে দেখা গেল সে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা হয়নি। এলাহাবাদের বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো, কলকাতা রাস্তায় মোটর গাড়ির ভিড় ইত্যাদি বিংশ শতকের গোড়ার দিকে প্রচলিত ছিল বললে সত্যের অপমান করা হবে। মূল কাহিনিতে আছে সুরেন্দ্রনাথ ঘোড়ার গাড়ি চাপা পড়ে যা, ছবিতে সঠিকভাবে দেখানো না হলেও সুরেন্দ্রনাথ যে মোটর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তা, দর্শক সহজেই বুঝতে পেরেছে।

মূল গল্পে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল তার নিজের বাড়িতে। তার একপাশে ছিল মাধবী অন্যপাশে স্ত্রী শান্তি। এখানে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু অন্যরূপ। ত্রুটি বিচ্যুতি সহ অজয় বাবুর ‘বড়দিদি’ শৈল্পিক গুণসমৃদ্ধ। ছবির চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ যেমন প্রথম শ্রেণির তেমনি কয়েকটি দৃশ্যে পরিচালন নৈপুন্যের ছাপ রয়েছে। যেমন দাদার কাছ থেকে মাধবীর বিদায় নেবার মুহূর্তটি, সুরেন্দ্রনাথকে ঘোড়া ছোটাবার দৃশ্য, সুরেন্দ্রনাথের দুর্ঘটনার প্রাক মুহুর্ত প্রভৃতি।
আলোচ্য ছবিতে উত্তম কুমার সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলবার জন্য চেষ্টার যে ত্রুটি করেননি তা তাঁর কয়েকটি দৃশ্যের ভাবকল্পেই বোঝা যায়। কিন্তু বিন্যাসদোষে তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।

পারস্পরিক বিনিময়ের ফলে এবং নায়কের অভিনয় প্রভাব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে শুরু থেকেই উত্তম কুমার সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতেন। সন্ধ্যারানি সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। যাঁরা মলিনা দেবীর ‘বড়দিদি’ দেখেছেন তাঁরা সন্ধ্যা রানি অভিনীত দেখে পরিচিত হবেন না একথা যেমন সত্য, তেমনি আবার একথাও সত্য যে, বড় দিদির মানসিক দ্বন্দ্বকে সন্ধ্যারানি অনেক ক্ষেত্রে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। শান্তির ভূমিকায় এককালে চন্দ্রাবতী যে অভিনয় দীপ্তি প্রকাশ করেছিলেন আলোচ্য ছবিতে দীপ্তি রায় সে তুলনায় একেবারেই নিষ্প্রভ। অথচ তাঁকে মানিয়েছে বেশ।

অমর মল্লিক পরিচালিত বড়দিদি ছবিতে ভৃত্যের ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বর্গগত নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়। অজয়বাবুর ছবিতে সে চরিত্রটি এমনই উপেক্ষিত যে চেষ্টা সত্ত্বেও সত্য পঞ্চানন ভট্টাচার্য দর্শকমনে দাগ কাটতে পারেননি। অপ্রধান চরিত্রগুলো কিন্তু এই ছবিতে অভিনয় গুণে বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন নায়েবের চরিত্রে ধীরাজ ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণের চরিত্রে তুলসী লাহিড়ী।

পাহাড়ি সন্যাল সুরেন্দ্রনাথের পিতার ভূমিকা অভিনয় করেছেন।সাথে সাথে ছবি বিশ্বাস অভিনয় করেছেন মাধবীর পিতার ভূমিকায়। মাধবীর দাদার ভূমিকায় প্রশান্তকুমার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মেনকা দেবী তপতী ঘোষ অভিনয় করেছেন যথাক্রমে মাধবীর সখি। মাধবীর ঝি মাধবীর বৌদি ও মাধবীর স্বামীর উপর থেকে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোটামুটি মন্দ নয় তবে শেষ দৃশ্যের গানটি বড়ই সিনেমাসুলভ ও কৃত্রিম মা ছবিটির জন্য নয় ব্যর্থতার জন্য দায়ী।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content