শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

 

মুক্তির তারিখ: ৩০/১১/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর

পরিচালনা: অগ্রগামী

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: ধীমান

উত্তম এবং সুচিত্রা আরও একধাপ প্রণয়ের পথে। এ ছবি দেখার পর আমজনতার বিশ্বাস করতে বাকি রইল না বা সিনেমা কোম্পানিকেও আর বিজ্ঞাপন দিয়ে জাহির করতে হল না, তাঁরা দু’জন দু’জনের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন। পর্দার বুকে এ ধরনের হৃতকম্প ধরানো একটা চারিত্রিক বুনন খুব একটা সহজ কাজ ছিল বলে মনে হয় না।

পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির জাল, ছিল আছে এবং থাকবে। কিন্তু তার সমাপ্তি রেখায় একটাই কথা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে; সাধনা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা।
এ ছবির গঠন নিয়ে পথ চলতি যে গল্প আমরা সবাই জানি, ছবি শেষের দিকে অসুস্থ ধীমান একবার সটান দাঁড়িয়ে পড়ে যাবেন। ছবির সেই অংশের শুটিংয়ে নাকি উত্তম কুমার সরাসরি এ দৃশ্যের টেক করিয়েছিলেন, কোনও ডামি বা দুটি দৃশ্যের মেলন ব্যবহার করেননি। স্বাভাবিকভাবেই পেশার প্রতি শতকরা একশোভাগ নিষ্ঠা না থাকলে এ ধরনের চিন্তাভাবনা বা কাজের আউটপুট পাওয়া যায় না।

এছাড়া যে অংশটা সকলের মনে রাখা প্রয়োজন বলে যুগের দাবি তা হল, উত্তম-সুচিত্রা একই ছবিতে অংশগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ছবিতেও তারা স্বাভাবিক অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীকালে যেটা একক উত্তমকুমার বা একক সুচিত্রা সেনের আলাদা সত্তা প্রকাশে সহযোগী হবে।

ছবি: সংগৃহীত।

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ‘সুচিত্রা সেনের উত্তম ছাড়া ছবি এ ধরনের যদি বিভাজন বা বর্গীকরণ সম্ভব হয় তাহলে দর্শক মনে স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ফরিয়াদ’ প্রভৃতি ছবির কথা আসবে। কিন্তু আমরা যদি কোনও ছবিভিত্তিক আলোচনা করি যে, ‘শিল্পী’, ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’, ‘সপ্তপদী’ এ ছবিগুলোর মান কেমন তখন কিন্তু শুধু সুচিত্রা সেনের মুখ আমাদের মাথায় আসবে না, পাশাপাশি শুধু উত্তম কুমারের মুখও আসবে না। আসবে যুগলের মুখ।

এ হেন শৈল্পিক অনুরণন, দু’জনের যুগ্ম কৃতিত্বেই রচিত হয়েছে আর কয়েক বছর পর যেখানে আমরা সরাসরি দেখতে পাবো উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা সেনের ছবি হিট আর উত্তম কুমার তো বহুদিন আগে থেকেই সুচিত্রা ছাড়া ছবি হিট দিয়েছেন সেটা হয়তো সুচিত্রার ছবির মতো হয়নি, কিন্তু উত্তম ছাড়া সুচিত্রা ছবি হিট করছে এটা সে সময়কার একটা বাণিজ্যিক সিনেমা জগতের আলোড়ন ফেলা চিন্তাভাবনা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

সাধারণভাবে বাঙালি সমাজ যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সিনেমা হলে যেত তার প্রধান অবলম্বন ছিল স্ত্রীর সম্মান রক্ষায় বা নায়িকার সম্মান রক্ষায় নায়কের অবদান। সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা জয়গান থাকতো এবং আমরা দর্শকরা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চওড়া হাসি হাসতাম যখন দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টির পালন জন্ম নিত। আগামীর কল্পনায় সবসময় নারীবিহীন পুরুষের জয়, সমাজ স্বীকৃত।

উল্টোদিকে পুরুষ-বিহীন নারীর জয়, সমাজ স্বীকৃত হতে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরোতে হতো। এ ধরনের একটা প্রেক্ষিত পরবর্তীকালে তৈরি হবে কি হবে না তার কোনও আশা না রেখে এমন একটা গল্পের বুনন ছবির কর্তৃপক্ষ উপস্থাপন করেছিলেন যেখানে নারীর প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং নিষ্কাম নিবেদন প্রতিফলিত হয়েছে। যুগে যুগে সেটাই বিপরীত দিকের পুরুষের অলংকার রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭০: খলশে মাছ চাষে আয়ের সঙ্গে কমবে মশার উপদ্রবও, আবার অবলুপ্তিও আটকানো সম্ভব

আমাদের আলোচ্য ‘শিল্পী’ ছবির সাফল্যের সোনালি রেখা, শহরাঞ্চলে প্রথমে দেখা না গেলেও গ্রামাঞ্চলে ছিল বাম্পার হিট। গ্রামভিত্তিক নায়ক নায়িকার উত্তরণ, অন্যান্য ছবিতে সফলতা পেলেও ‘শিল্পী’ ছবিতে পেতে বেশ কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। কারণগুলি আমরা পরপর এভাবে সাজাতে পারি।

প্রথমত ছবির নাম ‘শিল্পী’ না হলেও কিছু এসে যেত না কারণ শিল্পী ধীমান এর চেয়ে প্রেমিক ধীমানের ব্যর্থতার করুন চিত্র, এ ছবির পরতে পরতে। ধীমান শিল্পী না হয়ে অন্য কিছু হলেও গল্পের চেহারা পাল্টাতো না।

দ্বিতীয়ত, শিল্পীর জীবনের বিশেষ আনন্দ-বেদনার কথা এতে নেই, আছে একটি প্রেমিকের জীবনের কথা। শুধু জাতে আর আয়ে নিচু বলেই সে তার প্রেমিকাকে লাভ করতে পারল না।

তৃতীয়ত, নিতান্ত সাদাসিদে একটি গ্রামের ছোট্ট প্রেমের গল্প, ছবির দৈর্ঘ্য গল্পের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

ছবি: সংগৃহীত।

চতুর্থত, একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনার জোট বাধার ব্যাপারে অনেক অস্বস্তির চিহ্ন রয়েছে। নায়ক যাতে নায়িকাকে ভুল বোঝে তার জন্য যেসব ঘটনার, যেসব সংলাপের সরবরাহ হয়েছে তা বড়ই কৃত্রিম।

পঞ্চমত, ধীমান ও অঞ্জনার প্রেমের দৃশ্যগুলো অনেক ছোট করা যেত সময় এবং সংখ্যায়।

ষষ্ঠত, ধীমানকে খুঁজে বের করার জন্য অনাবশ্যক হই হই করা হয়েছে দশরথ নামক কাজের লোককে জিজ্ঞাসা করলেই অনায়াসে তার হদিস পাওয়া যেত বলে মনে হয়।

সপ্তমত, যে ধীমান তার দরিদ্র কাকাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারল না বলে দারিদ্র্যের করুণ ছবি আঁকতে শুরু করল সেই ধীমান এর আগে কাকাকে অর্থ সাহায্য করেছিল কিনা তা নিয়ে দর্শক মনে প্রশ্ন উঠতে থাকে। যতদিন শহরে বসে সে প্রেমে সফল ছিল ততদিন কাকার খোঁজ করেনি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

কাজেই কাকার মৃত্যুজনিত তার হৃদয়ের হাহাকারটা নিতান্তই কৃত্রিম বলে মনে হয়েছে। আর একেবারে শেষ দৃশ্যে অঞ্জনার মূর্তি গড়ে সেই মূর্তি জড়িয়ে ধরে ধীমানের প্রাণ ত্যাগ করাটাও বড় কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট বলে মনে হয়।

যাইহোক এই ছবিতে ‘অগ্রগামী’ পরিচালক গোষ্ঠী একেবারে না হলেও অনেকটা সংযত প্রেমের দৃশ্য রূপায়ণে সফল হয়েছেন। প্রেমের দৃশ্যগুলোকেই মূলধন করা হয়েছে যদিও এ ছবিতে তবুও তার রূপটা আগেকার মতো উগ্র নেই। পরিচালনাভঙ্গি স্থানে স্থানে বেশ ভালো।
কলাকৌশলের দিক, আগাগোড়াই বেশ প্রশংসনীয়। বিশেষত, আলোকচিত্র গ্রহণের কাজ‌। প্রধানত এই কলা কৌশলের দিকটাই এ ছবিকে অনেকখানি উপরে উঠতে সাহায্য করেছে।
রবীন চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে আবহসংগীত যথেষ্ট ভালো। গানের সুরে অবশ্য নতুন কিছু নেই। তবে সমুদ্র সৈকতে জেলের মুখে গানটি বেশ মনে ধরার মতো। ওখানে হঠাৎ করে এমন হাস্য রসাত্মক কেন যে জাল-বোনার দৃশ্য দেখানো হয়েছে তা ব্যাখ্যার অতীত। শব্দ গ্রহণের কাজও বেশ ভালো। শিল্পনির্দেশনার কাজেও সুবিবেচনার পরিচয় মিলেছে, দীঘার সমুদ্র তীরের ছবি বেশ ভালোলাগার মতো।

অভিনয়ে নিরাশ করেননি কেউই উত্তম সুচিত্রার পাশাপাশি অসিত বরনকে বেশ ভালো লেগেছে। ভালো অভিনয় তিনি করেছেন। কমল মিত্রের অভিনয় চরিত্র উপযোগী হয়েছে। সুচিত্রা সেনের ছোটবেলা শিখারানী বাগ এবং উত্তম কুমারের ছোটবেলায় সমর কুমার ছবিটাকে অনেকটা সম্ভাবনাময় করে তুলেছিলেন।

সব মিলিয়ে দর্শক সাধারণকে খুশি করবার সমস্ত রকম উপাদানই ছবিটিতে আছে। আর তাই এই ছবিটিকে দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content