রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

 

মুক্তির তারিখ : ০৫/১০/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর

পরিচালনা: চিত্ত বসু

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: দিলীপ

একই বছরে ‘একটি রাত’ ছবির চূড়ান্ত সাফল্যের পর আবার চিত্ত বসুর ‘পুত্রবধূ’ মুক্তি পেল। এবার নায়িকার চরিত্রে মালা সিনহা। সম্ভবত ‘ঢুলি’ ছবির পর মালা সিনহার আবার বাংলা ছবিতে নতুন করে পদার্পণ এবং বিপরীতে নায়ক উত্তমকুমার।

অবাক হয়ে দেখার মতো একটা পরিসংখ্যান এই ১৯৫৬ সালেই উত্তমকুমারের জীবনে ঘটেছিল যা, পরবর্তী বছরগুলিতে প্রায় নেই বললেই চলে। সেটা হল একই পরিচালকের একই বছরে পরপর দুটি সুপারহিট ছবির নায়ক রূপে মনোনয়ন পেয়েছিলেন উত্তমকুমার। প্রশ্ন হল ছবিগুলো কি প্রথম থেকে সুপার হিট হবে এরকম সম্ভাবনা ছিল না। উত্তম কুমারের অভিনয়গুণে ছবিগুলো সাফল্যের চূড়ান্ত মাত্রা স্পর্শ করেছে।
দ্বিতীয় বিকল্পটাই আমাদের কানের পক্ষে স্বাস্থ্যকর যে উত্তমকুমার ছিল বলে ছবি হিট হয়েছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, দুটো জিনিসই ফিফটি ফিফটি। ভালো পরিচালক ও ভালো নায়ক। এই শর্তটা ফিল্মের পক্ষে খুব জরুরি। ভালো পরিচালক, খারাপ নায়ক কাজ সম্পূর্ণ করতে বা সাফল্যের রেট অনেক কম হয়। সে সত্যজিৎবাবুকে ভেবে সবাই তো ছবি করেন না। অনেক পরিচালকের আবার দম নেই, নায়কের এলেমে কোন ভাবে ছবি উতরেছে।

কিন্তু যদি সালতামামি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে, ১৯৫৬ সালে ‘অগ্রদূত’ থেকে বেশ কিছু চোখা চোখা সদস্য আলাদা হয়ে ‘অগ্রগামী’ সংস্থা খুলেছিলেন। এ বছরই তাদের দুটি সুপার-ডুপার ছবি মুক্তি পেয়েছিল। এক বছরের শুরুতে ‘সাগরিকা’ দুই বছরের শেষে ‘শিল্পী’। অন্যদিকে দেবকীকুমার বসু যিনি সারা জীবনে উত্তমকুমারকে নিয়ে মাত্র দুটি ছবি তৈরি করেছিলেন এবং সেটা এই বছরেই ‘চিরকুমার সভা’ এবং ‘নবজন্ম’ দুটো ছবিতেই উত্তমকুমার নিজেকে শতকরা ২০০ ভাগ মেলে ধরেছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

ঠিক তারপরেই ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন, এই চিত্ত বসু যিনি প্রথমে সুচিত্রা সেন-কে নিয়ে ‘একটি রাত’ তারপর মালা সিনহা-কে নায়িকা করে ‘পুত্রবধূ’। মনে রাখতে হবে সুচিত্রা এবং মালা সিনহা দু’জনেই এর আগে মাত্র একটি ছবিতেই একসাথে কাজ করেছিলেন। তার নাম ‘ঢুলি’। পরিচালক ছিলেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়।

উত্তমকুমারের সারাজীবনে একই পরিচালক একই বছরে দুটি ছবিতে হিরো করেছেন সেটা খুবই কম হয়েছে। আসলে ১৯৫৬ সাল তার কেরিয়ারে এমন একটি বছর ছিল যে সময় উত্তমকুমার ডে-নাইট শিফটে শুটিং করে আর কোন কাজে মন দিতে পারতেন না। শুধু ছবি আর ছবি। যে কাজ ছিল তার সাধনা সেই কাজেরই জগতে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলেন মানুষ উত্তমকুমার।

ছবি: সংগৃহীত।

যাইহোক ‘পুত্রবধূ’-র কাজ একসময় শেষ হল এবং পরিচালক মিনার-বিজলী-ছবি ঘর-এ এর মুক্তির ব্যবস্থা করলেন। সবাই ভেবেছিল মালা সিনহার সঙ্গে উত্তম কুমারের ছবি আসার পর সুচিত্রা সেনের একটা ব্রেক হবে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বম্বে থেকে মালা সিনহা যতই জাতীয় মুকুট মাথায় দিয়ে টলিউডের উত্তমকুমারের নায়িকা হোন না কেন, সুচিত্রা সেনের জায়গা আগের মতোই একই থাকবে। কারণ তারা ছিলেন যুগস্রষ্টা। ১৯৫৭ সাল ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

যত মত, তত পথ, পর্ব-২: গুরুমশায় শ্রীরামকৃষ্ণ

উত্তমবাবুর যে হারে সাফল্য পাচ্ছিলেন, তা সারা জীবনে আর কখনও হয়নি। সুচিত্রা সেনের জায়গা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। পরবর্তী ১৯৫৭ সালে যাইহোক আমরা পুত্রবধূ ছবির প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করব। ছবিটির মূল কাহিনি অত্যন্ত সাদামাটা। শহরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চল দুটোর আধুনিক এবং সেকেলে মানসিকতার উত্তরণ এই ছবির মূল বিষয়বস্তু। আধুনিকতার মূল শিকড় ঐতিহ্যের হাতে অনেকটা থাকে, এ ছবির কাহিনিপটে যেন বারবার সে কথাই বলে উঠেছে। ধনতন্ত্রের নির্মম পেষণে মানুষের মানসিক গঠন কোন পর্যায়ে যেতে পারে আবার ঠিক তার বিপরীত মেরুতে থেকে মানুষ কতটা আত্মপ্রস্তুতি নিতে পারে, তার সাক্ষাৎ দলিল এ ছবির প্রতিটি ফ্রেম।

ছবি: সংগৃহীত।

নায়ক দিলীপ বর্ধিষ্ণু সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হয়ে কীভাবে মাটির মানুষের কাছাকাছি বাঁচার চেষ্টা করতে পেরেছেন, আবার নায়িকা সেও প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে কীভাবে ত্যাগ- তিতিক্ষা-ধৈর্য ও সংযমের মিলিত ফলে আদর্শ ভারতীয় নারী হয়ে উঠেছে তারও প্রমাণ আমরা পরতে পরতে পাই।

ছবিটির রূপায়নে পরিচালকের সবচেয়ে বড় মুন্সিয়ানা নায়ক-নায়িকার পারস্পরিক দ্বৈরথ। যে সময় উত্তম সুচিত্রার ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিনিময়, ছবির মূল প্রাণকেন্দ্র ছিল, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার যে রীতি, তাঁরা দুজন চালু করেছিলেন এ ছবি তার ব্যতিক্রম ছিল না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যদুকুল ও চপস্টিকস

অর্থাৎ নায়কের বিপরীতে নায়িকা প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখাবে বা নায়িকার প্রতি নায়কের নিঃশর্ত সমর্পণ থাকবে, এ ধরনের কোন অংশই তৎকালীন দর্শকের হজম হতো না। পরিচালক এই ইজমটাকে ডেভেলপ করে ছবির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার হোতা ছিলেন উত্তম সুচিত্রা দু’ জনে।

এরপর আসি সহশিল্পীদের অংশগ্রহণ বা অবদান। স্বাভাবিক নিয়মে রাশভারী ধনাঢ্য ব্যাক্তি রূপে অতুলনীয় ছবি বিশ্বাস থাকবেনই। সংস্কার আচ্ছন্ন বনেদিয়ানা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়ে চন্দ্রাবতী দেবী থাকবেন। পরবর্তীকালে যে অংশটাকে বাংলা ছায়াছবিতে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন ছায়া দেবী একা হাতে। তাছাড়া অন্যান্য সহশিল্পীদের বলিষ্ঠ অভিনয় ছবিটিতে অনেক আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করেছিল।
সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন যুগের এলিট ক্লাস মিউজিক ডিরেক্টর রাজেন সরকার মহাশয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি গান ‘শাপমোচন’, ‘মণিহার’ প্রভৃতির মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও ছবির প্রতিটি ফ্রেমকে নিটোল বুননে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে পেরেছিলেন সুরকারের মুন্সিয়ানা। তারপর ‘ওয়ে অফ স্টোরি টেলিং’ ছবিটিকে টানা হাউস ফুল ঘটিয়েছিল দর্শক সমাজে।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content