শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


 

মুক্তির তারিখ: ০১/০৬/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর

পরিচালনা: নীরেন লাহিড়ী

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: গৌতম

আবার একটি গতানুগতিক ধারার বাণিজ্যিক ছবি। যে সময় মুক্তি পেয়েছিল এ ছবিটি সেসময়ের বঙ্গবাসী সাধারণভাবে উত্তমকুমার-কে দেখার জন্য মাথায় তুলে নিয়েছিলেন এই ছবির প্রতিটি অংশ। কিন্তু কালের বিচারে উত্তমবাবুর ‘নায়ক’, ‘বাঘবন্দী খেলা’, ‘নগর দর্পণ’-এ মানুষ যখন দেখে ফেলেছেন তখন কিঞ্চিত অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয়েছে এ ধরনের ছবিগুলোকে।

আসলে মানুষ পায়েস খাবার পর কখনোই আর শুক্ত খেতে চান না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনও ভালো জিনিসের শুরুতেই কতকগুলো এলোমেলো, অবিচ্ছিন্ন, অবিন্যস্ত পরিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে আমাদের হেঁটে যেতে হয়। উত্তমকুমার অভিনীত ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাংক’ এ ধরনের একটি বহু সমালোচিত ছবি।
ছবির কাহিনিতে গতানুগতিকভাবেই গড়পড়তা মানুষের যে চাপান-উতোর সে অংশগুলোই বেশি করে প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন একবিংশ শতাব্দীতে যে ধারার ছবি তৈরি শুরু হয়েছে বাংলা ফিল্ম জগতে তাতে অনেক ছবির ভবিষ্যৎ আগামী দিনে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা আজকে বসে যখন কলাকুশলীদের অমানবিক পরিশ্রম-সমৃদ্ধ ভালো কাহিনির রূপায়ণ দেখি তখন কিন্তু মুহূর্তের জন্য এর ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব আমরা মাথায় রাখি না।

আমি বহু উত্তমপ্রেমীদের মুখে শুনেছি ‘এই উত্তম কুমার একটা স্টুপিড। তাঁর নিজের অভিনয় প্রতিভা সম্বন্ধে নিজে জানতেন না। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, ‘অভিযান’ রিফিউজ করেছেন আর তার জায়গায় দেখো কি ধরনের একটা ননসেন্স ছবি ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাংক’!
আরে তোর এলেমের ধারে কাছ এ সব ছবি! তুই কোথায় বাছাই করে ছবি করবি যাতে পরবর্তীকালে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে নিজেকে উজ্জ্বল করবি। তা নয়…।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪১: কান্না হাসির দোল দোলানো ‘একটি রাত’

বিচিত্রের বৈচিত্র: শিলাইদহে ‘নতুন বাবুমশাই’-এর কড়া নির্দেশ, এই নিয়মের বদল না হলে আজ পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হবেই না

এ ধরনের মন্তব্য মানুষকে সাময়িক উত্তেজিত করলেও দীর্ঘমেয়াদি সমালোচনা স্তম্ভে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কারণ মূল ধারার ছবি থেকে বেরিয়ে যাঁরা তথাকথিত উন্নত মানের শিল্পসম্মত ছবিতে অভিনয় করেছেন, নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাঁদের আমজনতার দরবারে গ্রহণযোগ্যতা খুব একটা ছিল না। যে কারণে স্বর্গের দেবতাদেরও মাঝে মাঝে মর্ত্যের মানুষের স্তব স্তুতি প্রয়োজন হতো বা হয়। তারকারও বেঁচে থাকার কারণে আমজনতার গ্রহণযোগ্যতা গুরুত্ব পায়। ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাংক’ ছবির টাইটেল কার্ডটা শুনলেই একটু চিন্তাশীল মানুষের মনে প্রথমেই রেখাপাত করবে যে পরিচালক বোধ হয় ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের দুটি ধারা শৈব এবং বৈষ্ণব এদের মিলিয়ে কিছু বলতে চাইছেন।
কিন্তু বিষয়টা তা ছিল না। একটি পথ চলতি কাহিনীকে অবলম্বন করে নিতাই ভট্টাচার্য তার হাতের জাদুতে নির্মাণ করেছিলেন নায়ক-নায়িকার পারস্পরিক বিনিময়। এ ধরনের দড়ি টানাটানির খেলা চল্লিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত গোটা কুড়ি বছর খুব সাফল্যের সঙ্গে চলেছে।

যে সময়ে মূল ধারার ছবিগুলো সাহিত্য নির্ভর হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করছে আজকের দৃষ্টিতে সেগুলো এক একটা মহান শিল্পসৃষ্টি। উত্তম কুমারের উত্থান পর্বে এ ধরনের ‘আন্ডার রেটেড’ বাংলা ছবি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। কোথাও কোনও দেশে একসঙ্গে কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, দেবকী বসু, নীতিন বসু-র মত পরিচালকরা ছবি করেননি। তাঁদেরও তখন পড়তি অবস্থা চলছে। বরং সেদিক দিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি মান পরিচালক বা পরিচালক-গোষ্ঠী বাংলা ছবির হাল ধরেছিলেন নীরেন লাহিড়ী সে ধরনেরই একজন প্রতিশ্রুতি মান পরিচালক; যিনি তাঁর কেরিয়ারে মোট সাতাশটি ছবি নির্মাণ করেছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাংক’ ছিল সে সাতাশটি ছবির কুড়ি নম্বর। অর্থাৎ পরিচালক জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এসে অনেক অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে এ ধরনের একটি ছবির নির্মাণে তিনি যত্ন নিতে পেরেছিলেন। কাজেই একদম আনকোরা পরিচালকের ছবিতে উত্তম বাবু নিজেকে শেষ করে ফেলেছেন এ ধরনের উক্তি যাঁরা করেন তাঁরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা বোধের থেকে অনেকটা দূরে থাকেন।

উত্তম কুমারের ঝুলিতে এ ধরনের ছবির আধিক্য না থাকলে সত্যজিৎবাবু কখনওই ‘নায়ক’ ছবিতে তাঁকে মনোনয়ন করতেন না। ‘নায়ক’ ছবিটি একটি ক্লাসিক ছবির তকমা পেলেও তার কাহিনিতে যে রিয়েল হিরোর ইমেজ প্রদর্শিত হয়েছে সেখানে কিন্তু একজন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা বাণিজ্যিক ছবির নায়কের জীবন বেদই ব্যক্ত হয়েছে।
সত্যজিৎবাবুর নায়ক ছবির হিরো কোনও বড় পরিচালকের ছাঁচে ঢালা পুতুলের মতো হাত-পা নাড়া সর্বস্ব হিরো নন। তিনি আম জনতার শাঁসে-জলে পুষ্ট একজন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মাঝারি মানের ডিগ্রিধারী প্রতিভাধর অভিনেতা। কাজেই এ ধরনের ছবিতে মুখ দেখানো কোনও নায়কের পক্ষে নিজেকে শেষ করার যে পন্থা সেটা খুব জোরালো যুক্তি নয়। তাহলে প্রতি প্রশ্ন উঠবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটক এনাদের মত পরিচালকরা কেন করিয়ারের শুরুতে ‘নায়ক’ ছবি করেননি? কেন ‘পথের পাঁচালী’-র মত দৃশ্যসর্বস্ব কাহিনিকে ছবির আঙ্গিক করেছিলেন? কারণ গোটা পথের পাঁচালী ছবিটিতে ম্যানারিজম-সর্বস্ব অভিনয়কে বর্জন করা আর ক্যামেরার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দৃশ্যকে শিল্পিত উপায়ে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া এটাই ছিল ছবিটির মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: একাধিক সমস্যার অব্যর্থ দাওয়াই, বাজিমাত হবে এই ‘অমৃত’ ফলে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২২: কেস কালাদেও: ফাইল নম্বর ১

উত্তমকুমার কেরিয়ারের শুরুতে যাঁদের পরিচালক হিসাবে ক্যামেরার পিছনে পেয়েছিলেন তাঁরা কেউ এই মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন না। তাদের সবার আগে মনে রাখতে হতো, প্রযোজকের পয়সা ঘরে ফেরাতে হবে আর একটা নিটোল গল্পকে সংগীত পরিচালনার মান দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

সে সময়ের কোন একটা সুপারফ্লপ ছবিকে নিয়ে যদি আলোচনা করি সেখানেও দেখবো একটা নিটোল স্টোরি টেলিং বা গল্প বলা আছে। এই গল্প বলার উপায়টা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের কাছে একটা মেসেজ দেওয়ার রীতি খুব বেশি পঞ্চাশের দশকে প্রচলিত ছিল না।

উত্তমবাবুরও সাহস হয়নি, এ ধরনের ছবিকে ফিরিয়ে দিয়ে আগামী দিনে নিজের পছন্দ মতো ছবি তৈরিতে মন দেওয়া। কারণ ১৯৫৫ সাল ১৯৫৬ সাল এই দু’ বছরের লাগাতার হিট দিয়েই তাকে ১৯৫৭ সালে পৌঁছতে হবে। এবং ৫৭ সালেই সমস্ত ছবি মুক্তি পেয়ে গেলে তাকে ছুটি নিলে হবে না। খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। সে কারণে যে সমস্ত পরিচালকরা খারাপ সময়ে তাঁর উপর আস্থা রেখেছিলেন কোনওদিনই তাঁদেরকে উত্তমবাবু ফিরিয়ে দেননি।
কয়েরিয়ারের একদম শেষ দিকে, ‘সূর্যসাক্ষী’ নামে একটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন যেটা ছিল তার বয়স এবং ভাবমূর্তির একেবারে বিপরীত মেরুতে। কিন্তু ছবিটি যেহেতু ‘অগ্রদূত’-র পরিচালনায় তাই সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন কৃতজ্ঞতা বশত।

আমরা ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাংক’ ছবিটিতে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেখব উত্তমকুমারকে নয়, সহ-অভিনেতা, পরিণত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে। কোনও মানে অভিনয় করলে আগামী দিনের নায়ককে সাফল্যের দরজায় পৌঁছে দেওয়া যাবে, ছবি বিশ্বাস তা জানতেন হাড়ে হাড়ে। তাই ছবিটিতে তাঁকে জোরালো ভূমিকায় আমরা খালি চোখে দেখতে পাই।

ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অনুপম ঘটক। যিনি একদা পঞ্চাশের দশকের মানুষের খুব কাছের ছিলেন। যাঁর সংগীত পরিচালনায় সে সময় অনেক তরুণ শিল্পী নিজেদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করেছেন। তার অমূল্য সংযোজনায় ছবির প্রতিটি অংশ আগামীর কাছে ঋণী হয়ে আছে।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content