রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

 

মুক্তির তারিখ: ১৪/০৪/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: নিউ এম্পায়ার, উত্তরা ও উজ্জ্বলা

পরিচালনা: দেবকীকুমার বসু

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: অক্ষয়

‘বউঠাকুরাণীর হাট’-র পর আবার রবীন্দ্রকাহিনি চিত্রায়নে উত্তম কুমারের অংশগ্রহণ। এ বারে পরিচালনার ভূমিকায় সেই যুগস্রষ্টা পরিচালক দেবকী কুমার বসু। উত্তম কুমারের ভাগ্যরেখা শুরুতে মসৃণ না হলেও আজকের দিনের বিচারে তিনি যেসব পরিচালকদের তাঁর কেরিয়ারের শুরুতে পেয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন কৃতবিদ্য মানুষ।

আগেই বলা হয়েছে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৭ বা ৫৮ পর্যন্ত উত্তম কুমারের জীবনে এমন কিছু পরিচালকের আনাগোনা শুরু হয়েছিল যাদের সংস্পর্শে উত্তমের সমস্ত ফিল্মি কেরিয়ার এক লহমায় অন্য মানে উঠে গিয়েছিল।
এদের মধ্যে ১৯৫৫ সালে এবং ১৯৫৬ সালে বিশেষত যে সমস্ত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পরিচালকদের সঙ্গে উত্তম কুমার কাজ করেছেন তাতে বাংলাদেশে খুব কম অভিনেতার ভাগ্যে এ ধরনের বহুমুখী কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

একই বছরে বারোটা ছবি মুক্তি পেলে বারোটাতেই নতুন নতুন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা পাশাপাশি অন্য কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর জীবনে হয়েছে কিনা আমাদের ভাবতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত।

অন্যদিকে আমার মনে হয় উত্তমকুমার শিল্পী হিসাবে, অভিনেতা হিসাব সুশীল সমাজের তরফ থেকে চূড়ান্ত অবহেলা এবং অবিচার পেয়েছেন। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত নায়ক (১৯৬৬) এবং চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) ছবিতে প্রচলিত অর্থে ভালো অভিনয় করেছিলেন বলে জাতে উঠেছেন — এরকম একটা ধারণা পরিকল্পনামাফিক সত্যিই প্রচলিত আছে। কিন্তু এর থেকে বড় ভুল আর কিছু হয় না।

উত্তমকুমার যখন ‘আবির্ভূত’ হন, আবির্ভূত বলছি এই কারণে, যে তাঁর প্রথম জনপ্রিয় ছবি নির্মল দে পরিচালিত ‘বসু পরিবার’; যে ছবিতে তিনি অনেকের মধ্যে একজন হয়ে অভিনয় করেছিলেন তা, মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। সে বছর আমাদের দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল, ভারতীয়রা প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেল। মানে রাষ্ট্রপতি আর আমজনতা, একইভাবে ভোট দিতে পারলেন, দুজনের ভোটের মূল্যই সমান হয়ে গেল। সে বছরই উত্তমের প্রথম সাফল্য। এই সাফল্য সিনেমাতেও এক ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ছায়া ফেলেছিল, যার ফসল উত্তমকুমার।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

পরবর্তী সাফল্যও পরের বছরে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে, যদিও সেখানেও তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনকে প্রায় পার্শ্বচরিত্র করে দিয়েছিলেন। এক বছর পরেই মুক্তি পেল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪), এবং অবশেষে ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫)।

আমি বলব ওই ছবিগুলোকে আমরা ঠিক করে উপলব্ধিই পারিনি। যেমন ‘শাপমোচন’-এর উদাহরণ দিয়ে বলব, ওটা আসলে আমাদের গণতন্ত্রের শাপমোচনের ইতিকথা। ওখান থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের পক্ষে হয়ত সত্যিই সামন্ততন্ত্র পেরিয়ে একটা স্বাধীন গণতন্ত্রে পা রাখা সম্ভব।

সে জিনিস পশ্চিম ভারতে ঘটিয়েছিলেন দিলীপকুমার, রাজ কপুর এবং দেব আনন্দ। আর পূর্ব ভারতে একা উত্তমকুমার — অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পশ্চিমবঙ্গে তিনি সত্যিকারের নায়কের মতো সংকটের পর সংকট পার হয়ে যাচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র, মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ

উত্তমকুমার তো বিধান রায় নন বা জ্যোতি বসুও নন। কিন্তু তাঁর ক্যারিশমায় একের পর এক দুর্যোগ পার হয়ে যাচ্ছিল। উপরন্তু পাঁচের দশকের শেষ ভাগ এবং ছয়ের দশকের সামাজিক দোলাচলের দিকে তাকালে মনে হয়, ছবির পর্দায় এমন এক শান্তিনিকেতন তিনি গড়তে পারছিলেন যেখানে স্থিতাবস্থাই সত্য। আসলে তিনি কিন্তু স্ট্যাটাস কো-র পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর ছবির বাস্তবতা শাসক শ্রেণির মতাদর্শের বিপ্রতীপে অবস্থান করত না বলেই তিনি এত দীর্ঘকাল রাজত্ব করতে পেরেছেন।

‘শাপমোচন’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘দেয়া নেয়া’ গানের বদলে প্রেমের আদর্শকেই তুলে ধরে। তাঁর গরীব চরিত্রগুলো নায়িকারা বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাথে পুনর্মিলিত হয়। চালু মতাদর্শ উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের উপস্থিতিতে কখনওই বিপন্ন বোধ করে না। ফলে যত তিনি বড় অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তত আর্ট সিনেমার উপেক্ষা বঞ্চনার সত্য হিসাবে জনসাধারণের হৃদয় মথিত করে। ফলে উত্তমকুমারের রাজ্যপাট নিরঙ্কুশ হয়।
কিন্তু পরিচালকের আসনে বসে যুগস্রষ্টা পরিচালক দেবকী কুমার বসু বুঝতে পেরেছিলেন উত্তম কুমারকে নায়ক হিসাবে আর ভার্সেটাইল অভিনেতা স্তরে পৌঁছে দেওয়া খুব একটা শক্ত কাজ নয়। দেবকী বাবু সাক্ষাতে অসাক্ষাতে সর্বত্রই বলতেন ছেলেটার কাজের প্রতি ডেডিকেশন তাকেও ভাবিয়ে তুলতো এবং উত্তম কুমার যে, আগামীদিনে খুব উঁচু জায়গায় থাকবেন সেটা তিনি ‘চিরকুমার সভা’ তৈরির সময় বুঝতে পেরেছিলেন, ‘নবজন্ম’-র সময় প্রত্যক্ষ করেছেন।

যার ফলস্বরূপ তিনি এই ১৯৫৬ সালের শেষের দিকেই নবজন্ম নামে আরেকটি ছবি তৈরি করে উত্তম কুমারের কালজয়ী হবার পথকে অনেক প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস কীভাবে যে তার কালের গতিকে নির্ণয় করে তা একমাত্র ইতিহাসের সিন্দুকেই বন্দি থাকে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

অজানার সন্ধানে: ‘বঙ্গীয় বিশ্বকোষ’ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র

মানুষ এর হদিস পায় না। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ এর ভূতনাথ চরিত্র উত্তম যে আন্ডার-অ্যাক্টিং করেছিলেন ‘চিরকুমার সভা’-র অক্ষয় ছিল তারই অনেকটা ছায়া অবলম্বনে তৈরি। বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস তৈরি করতে যতখানি মেধা বা মনন দরকার উত্তম কুমারের অক্ষয় না দেখলে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয় ব্যাপারটা কখনওই এমন ছিল না। যে দেবকী বসু নবাগত পরিচালক আর উত্তম কুমার এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
দেবকীবাবু প্রায় ১৮-১৯টা ছবি তৈরির পর ‘চিরকুমার সভা’-তে হাত দিয়েছেন। তৎকালীন বাংলা ছবির বাঘা বাঘা অভিনেতাদের তিনি এ ছবিতে মনোনয়ন করেছিলেন সেখানে উত্তম কুমার ছিলেন কালকের যোগীর মতো নবাগত। কিন্তু কাজের প্রতি ডেডিকেশন এবং চরিত্রের গভীরে নিজেকে স্থাপন করে ফিল্মোচিত অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে স্থায়ী আসন পাকা করে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা তাতে কোন কার্পণ্য উত্তমবাবু করেননি। যে কারণে আজও ‘চিরকুমার সভা’-র প্রতিটি ফ্রেম যতটা না রবীন্দ্রনাথের ততটাই দেবকী বসু এবং উত্তম কুমারের হয়ে গিয়েছে।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content