শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১৩/০৪/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

পরিচালনা: কার্তিক চিত্তরঞ্জন মিত্র

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: সুভদ্র

পঞ্চাশের দশক ভারতীয় সিনেমা এবং বাংলা সিনেমার এমন একটা সন্ধিক্ষণ ছিল যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুধু শেষ কথা নয়, সূত্রপাত ঘটেছিল সাংস্কৃতিক বিনিময়েরও। বেশ কয়েক দশক সফলতার সঙ্গে সিনেমা শিল্প বঙ্গভূমিতে রাজত্ব করার পর নতুন রাজকুমারকে ঘিরে তার উন্মাদনা কম ছিল না।

অন্যদিকে উত্তম কুমারকেও নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে লড়াইটা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে করতে হয়েছিল ‘লক্ষহীরা’ ছবিতে সে অংশ যেন আবার পুনরাবৃত্ত হল।
ছবিতে প্রথম দিক থেকেই পার্শ্ব চরিত্র হিসাবে দাপুটে অভিনেতাদের একনায়কতন্ত্র। সেখানে উত্তম কুমার পেয়েছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ বটে কিন্তু তাকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে অনেক পরে যখন তাকে ঘিরে কাহিনির আবর্তন প্রয়োজন পড়ছে।
সে সময় এ ধরনের একটা ছবির সাংগঠনিক ভিত্তি সত্যিই খুব চোখে পড়ার মতো ছিল। যে উত্তম কুমার ধারাবাহিকভাবে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’ এবং ‘সাগরিকা” এ ধরনের ছবি দিয়ে বাংলার বাণিজ্যিক ছবির ইতিহাসকে অন্য মানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার ঝুলিতে ‘লক্ষহীরা’র মতো ছবি গড়পড়তা বাংলা ছবির যে মর্যাদা তার থেকে বেশি কিছু ছিল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: জাতির কল্যাণে ‘জাতীয় বৃক্ষ’

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

কিন্তু যে অংশটি ভীষণভাবে আলোচ্য, যে উত্তম বাবু সাফল্য পাওয়ার পর শুধু কি সুপারহিট ছবির জন্ম দেবেন?
কোনও পরীক্ষানিরীক্ষামূলক বা সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা ছবির সঙ্গে জড়িত হবে না এ ধরনের বিতর্কিত একটা অধ্যায় এ বছর শুরু হয়ে গিয়েছিল।

ঠিক এর আগের ছবি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ পর্বে ভূতনাথ চরিত্রে অভিনয় করে উনি ক্লাসিক সাহিত্যকে কোনও পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যায় তার একটা মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন।
সেখান থেকে দাঁড়িয়ে আম জনতার মুখে কিন্তু একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল এ ভদ্রলোক যে ভূমিকাতেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান না কেন সেটাকে উনি নিজের মতো করে নেবেন। এবং সে অভিনয়ে কারও ম্যানারিজম ঢুকতে দেবেন না।

দ্বিতীয়ত, ওঁর অভিনয় অংশ দেখার পর দর্শকের মনে সেই চিন্তার উদয় হতে দেবেন না যে এ চরিত্রটা অন্য কাউকে করতে দিলে কেমন হতো!

চারিত্রিক এই বলিষ্ঠতা উত্তমবাবুর ছবির ফ্রেমে ফ্রেমে। আমরা দেখেছি ওনার যে ছবিটি হিট করেনি পরবর্তীকালে যখন উনি মহানায়ক তকমা পেয়ে গিয়েছেন তখনও বাঙালি দর্শক ভাবতে পারেননি যে এই ভূমিকায় উনি ছাড়া আর কে অভিনয় করলে ছবিটা হিট করত।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

আমার এ ধরনের নিদান মনে হয় পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বছরগুলি থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল কারণ উনি যখন “নায়ক” করে ফেলেছেন তখনও উনার অভিনয়ের মান নিয়ে খুব একটা বেশি প্রশ্ন তোলার হিম্মত অনেকের ছিল না। কিন্তু গড়পড়তা দর্শকের চোখে অনেক ছবি ফ্লপ করেছে। এখান থেকে বোঝা যায় উনি অভিনয় করেছেন বলেই ছবি ফ্লপ করেছে তা নয়, খুঁজে দেখো যে ছবিতে অন্যান্য কি প্রযুক্তিগত দুর্বলতা আছে।

এখনো মনে হয় অসিতবরণ বসন্ত চৌধুরীর যে অভিজাত দর্শন ছিল সে দৃষ্টিতে ‘স্ত্রী’, ‘সন্ন্যাসীরাজা’, ‘লালপাথর’ প্রভৃতি চরিত্রে চোখ বুজিয়ে মনোনয়ন করা যেত কিন্তু বাঙালি চলচ্চিত্রবোদ্ধা বা সমালোচকগণ কখনও বুক ঠুকে বলতে পারবেন না শুধু দর্শন দিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে হবে না, উত্তম বাবু যে মানে অভিনয় করেছেন ওই ছবিগুলিতে ওই মানের অভিনয় দু’জনে কতটা করতে পারবেন সেটা কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৯: কেস জন্ডিস

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-১৮: বাস্তু মতে আপনার বাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার কোন দিকে হওয়া উচিত?

কাজেই ‘অগ্নীশ্বর’, ‘বাগবন্দী খেলা’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ এই ধরনের ছবিগুলোতে যদি আমরা উৎপল দত্তের মতো একজন বলিষ্ঠ অভিনেতাকে নির্বাচন করতাম কেমন হতো সে ছবিগুলো! প্রশ্ন একটা, উত্তরও একটা। ভিলেন চরিত্রে উৎপল দত্ত অনেক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ‘বাঘবন্দী খেলা’তে উত্তম বাবু যে মানের পজিটিভলি নেগেটিভ রোল করেছেন তা ভারতবর্ষের যে কোনও অভিনেতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।

‘অগ্নীশ্বর’ এ ডাক্তারের ভূমিকা, ৩-৪টি পর্বে উত্তমবাবুর যে ডায়নমিক অ্যাটিটিউড সেটা হলিউডের অনেক তাবড় তাবড় অভিনেতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেবেন। এভাবে আমরা যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করি তাহলে এক একটা ছবির ছন্দকে উনি যেভাবে আত্মস্থ করে ক্যামেরার সামনে উপহার দিয়েছেন তা শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব।
‘লক্ষহীরা’ ছবিতে যিনি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই চিত্তরঞ্জন মিত্রকে আর কোন বাংলা ছবির পরিচালক হিসাবে কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়নি। সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কালীপদ সেন এবং সহকারী যেসব চরিত্র ছিল সেখানে বাঘা বাঘা অভিনেতারা নিজেদের সেরা উপহার দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছবির কাহিনি যখন উত্তম
বাবুকে উপস্থিত করল তখন আগে উপস্থিত হওয়া সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রীদের আকর্ষণ যেন একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে তার দিকে চলে গেল।

এই উত্তম ম্যাজিক শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। ১৯৫৬ সালের মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো থেকে আগামী দিনে আমরা অনেক স্মরণীয় ছবি দেখতে পাবো বহু নামী পরিচালকের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এমন একটি উপস্থাপন তিনি নিজেকে করবেন যা বাকি কলা কুশলীদের কয়েক আলোকবর্ষ দূরে ফেলে তিনি এগিয়ে যাবেন।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content