শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ : ২১/১০/১৯৫৫

প্রেক্ষাগৃহ : রাধা, পূর্ণ ও প্রাচী

পরিচালনা : কমল গঙ্গোপাধ্যায়

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম : জ্যোতি

১৯৫৫ সালের এই ছবিটার সঙ্গে উত্তম কুমারের জীবনের যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে তা যেমন স্মরণীয় তেমনই রোমাঞ্চকর। বিষয়টা হল এতদিন এক মাসের ব্যবধানে ছবি রিলিজ চলছিল। কিন্তু এই প্রথম একই দিনে দুটি হলের রিলিজ চেইনে দুটি ছবি মুক্তি পেল। যে উত্তম কুমারকে সামান্য একটা সুযোগের জন্য মাসের পর মাস, বছরের পর বছর প্রযোজক পরিচালকদের দরজায় হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। আজ তাঁর নায়কজীবনের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে, দুটি ছবি একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে। কেউ ভেবেছে কোনওদিন!

এত গেল ছবিকেন্দ্রিক ইতিহাসের কিছু সালতামামি। আমি কিন্তু ছবির অন্দরমহলে যে পরিচর্যা, উত্তম কুমারের ব্যক্তিজীবনকে অনেক অংশে নির্মাণ করেছিল তার বুনন বুঝতে বেশি আগ্রহী। কর্তব্য সচেতন, পারিবারিক দায়িত্ববোধে আপাদমস্তক ডুবে যাওয়া এক মানুষের সঙ্গে কর্পোরেট জগতের মূল্যবোধ হ্রাস পাওয়া আর একজন মানুষের মৌলিক লড়াই ছিল—এ ছবির বিষয়বস্তু।
এ প্রজন্মের দর্শকরা যাঁরা এখনও এ ছবিটি দেখার সুযোগ পাননি বা নামই শোনেননি। তাঁদের কাছে অনুরোধ ইউতটিউবে ছবিটি আছে। পারলে একবার দেখে নেবেন। নিজের পারিবারিক শিকড়ের সন্ধান এ ছবির পরতে পরতে যেন বাঁধা আছে। কাহিনিকার প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর আটপৌরে গৃহস্থ মানসিকতা কি সুন্দর বুননে বেঁধেছেন চিত্রনাট্যকার মণি বর্মা মহাশয়।

বাংলার পারিবারিকভাবে বেঁচে থাকার রীতিটা কেমন ছন্দোময় ছিল তার সঠিক দিকদর্শন এ ছবির চিত্রনাট্য। তথাকথিত বাজার চলতি হিট ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’- র পর যদি কেউ উত্তম কুমার অভিনীত একটি গঠনমূলক ছবি দেখতে চান তাহলে অবশ্যই ‘ব্রতচারিণী’ তার প্রথম দিকে থাকবে।

বিপরীতধর্মী দু-ধরনের মানসিকতার দ্বান্দ্বিক উপস্থিতি, এ ছবির প্রাণকেন্দ্র। কাজেই ঘটনার ঘনঘটা আর চরিত্রের বস্তুবাদী উত্থান পতন থাকবে তা বলাই বাহুল্য। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শেষ বেলায় যখন জমিদারি প্রথা প্রায় বিলোপের মুখে, পাশাপাশি গণতান্ত্রিক তথা সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ে ওঠার নতুন স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশবাসী সেখানে একজন আদর্শবাদী, মার্জিত যুবকের নতুন ভাবে বাঁচার দিকদর্শন ছবি টিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র: পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫: অল্প ক্ষতি স্বীকার করে হলেও ভবিষ্যতে বড় লাভের কথা চিন্তা করা দরকার

ভবিষ্যবাণী: আপনার নামের প্রথম অক্ষর কি ‘এ’? তাহলে জ্যোতিষশাস্ত্র মতে আপনি কিন্তু এই সব গুণের অধিকারী

দশভুজা: তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা

উত্তম কুমারের ভাগ্য এতটাই ভালো যে এ ছবিতে একাধারে তিনি বাঘা বাঘা সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কো- আর্টিস্ট হিসাবে সঙ্গে পেয়েছেন। উত্তম কুমারের ব্যক্তি জীবন যেমন একটি যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে আরেকটি যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল এ ছবির আবেদনও ছিল সে রকম। ছবি বিশ্বাসের মুখে যখন পরিচালক তথা চিত্রনাট্যকার বসালেন সেই কালজয়ী ডায়ালগ ‘চাঁদের যত কিরণই থাকুক না কেন তা সবই কিন্তু সূর্যের থেকে ধার করা’—হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। এ যেন প্রাক্তনের প্রতি নূতনের চির সবুজ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

মানুষের মনন যেমন আগামীর স্বপ্নে বিভোর থাকে তেমনই তার শিকড়টা পোতা থাকে প্রাচীন ঐতিহ্যের গভীরে। এ তো গেল ছবিকে কেন্দ্র করে ইজম তথা বাদের একটি দাখিল পর্ব। কিন্তু যে অংশটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। তা হল প্লেয়ার কাস্টিং।
পরিচালক কমল গঙ্গোপাধ্যায়, ঠাকুর দার চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী-র মনোনয়ন সমস্ত ছবিটার অন্তরাত্মা নির্মাণ করেছিল। তার সাথে সন্তোষ সিংহ, ছবি বিশ্বাস, অসিত বরণ মহিলাদের মধ্যে মলিনা দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, ছায়া দেবী এবং শ্যামলী চক্রবর্তী প্রমুখর অভিনয়, নতুন প্রজন্মের উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অসিত বরণ শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় অনুভা গুপ্তা সন্ধ্যারানি এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়দের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

আমার সঙ্গে অধিকাংশ পাঠকই একমত হবেন যে উত্তম কুমার প্রথম দশ বছরে যদি এ ধরনের সিনিয়র আটিস্টদের গাইডলাইন না পেতেন তাহলে লাগাতার হিট দেওয়া তার পক্ষেও সম্ভব হতো না। প্রতিটা ফ্রেমে যেখানে অহীন্দ্র চৌধুরী এবং মলিনা দেবী, মুখোমুখি হচ্ছেন সে অংশগুলো ভরে যাচ্ছে নাটকীয় মেদুরতায়। ছবির মূল নায়িকা সন্ধ্যারানির সঙ্গে নায়ক উত্তম কুমারের সাক্ষাৎ খুবই কম।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

সকলের প্রত্যাশা মতো তৎকালীন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছবিটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রায় সমস্ত ছবিতে উল্টো দিকে উত্তম কুমার থাকলেই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়-র একটি পরিচিত মূর্তিতেই তাঁকে চিনতো, আর সকলের যেটা এর ভালো লাগতো তা হল ত্যাগের মূর্তি। বম্বের ট্র্যাজিক কিং দিলীপ কুমারের মতো।

প্রথামাফিক মিলন ছাড়াও চোখের দৃষ্টিতে ত্যাগের কি রূপ ফুটিয়ে তোলা যায়। সে আত্মিক আবেদন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দেখাতে পেরেছিলেন। কিন্তু আদর্শ-নির্ভর ছবিতে পরিচালক কমল গাঙ্গুলি যে সময়ে উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক যুগের সূচনা ঘটেছে, সেখানে সন্ধ্যারানির মতো একজন ধ্রুপদী মাধুর্যে ভরা রূপবতীকে, দেবীত্বে উত্তীর্ণ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন।
কাহিনির রথের গতিতে সন্ধ্যারানি, ভারতীয় নারীর ‘অধিকারহীন কর্তব্য’-র যে প্রতিমা নির্মাণ করেছেন দর্শক তাঁকে চোখের জল দিয়ে প্রাপ্য অর্ঘ্যদান করেছিলেন। অন্যদিকে নিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, ‘কর্তব্যহীন অধিকার’ পালনের মূর্তি হিসাবে অনুভা গুপ্তের চারিত্রিক রূপায়ণ, যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রেখেছিল।

আরেকটি অংশ না বললে বিষয়টা আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসভিত্তিক অপূর্ণতা থেকে থাকবে। তা হল উত্তম কুমার এবং অসিত বরণ দুই দশকের দুজন নায়কের অব্যক্ত বিনিময়। যা সর্বক্ষণ মনে করিয়ে দিচ্ছিল ‘তোমার হল শুরু আমার হলো সারা’।

আগেকার দিনের ছবিতে অসিত বরণ যে ঘরানার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন উত্তম কুমার তার নিজস্ব ঘরানা দিয়ে পুরানোকে বিদায় দেবার যে সম্মানজনক রীতি প্রচলন করেছিলেন তার প্রচ্ছন্ন ছাপ ছিল উক্ত দুই অভিনেতার মুখোমুখি উপস্থিতিতে।

একই ঘটনা ঘটতো সে সময় যখন কোনও ছবিতে উত্তম কুমার এবং বিকাশ রায় পরস্পর মুখোমুখি হতেন। বর্তমান যেন সম্মান দিয়ে অতীতের থেকে উত্তরাধিকার ছিনিয়ে নিতেন।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: চুল পড়ার কারণগুলো জানলেই তা রুখে দেওয়া যায়, রইল ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: আমে কী কী পুষ্টিগুণ আছে? ফলের রাজা শরীরের লাভ না ক্ষতির কারণ? কী বলছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র?

ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ

‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে জমিদারের যে রূপ দরকার ছিল অসিত বরণের মধ্যে বা বসন্ত চৌধুরীর মধ্যে তার ষোলআনা ছিল। কিন্তু সেখানে মনোনয়ন পেয়েছিলেন শুধুই উত্তম কুমার। একই কথা প্রযোজ্য ‘লাল পাথর’ বা ‘স্ত্রী’ ছবির ক্ষেত্রেও।

যদি বাহ্যিক উপস্থিতি দিয়ে বাজিমাত করা যেত। তাহলে জমিদারের রোল করতে অসিতবরণ বা বসন্ত চৌধুরীর বিকল্প ছিল না ছবি বিশ্বাসের পরে। কিন্তু উত্তম কুমারের সেই জাদু, ক্যামেরার সঙ্গে বনিবনা সবকিছু থেকে এগিয়ে দিয়েছিল ওঁকে যার সূত্রপাত ঘটেছিল এই ‘ব্রতচারিণী’ ছবি থেকে।
কাকতালীয়ভাবে কিনা জানি না, এই ছবির সংগীত পরিচালকের নাম কমল দাশগুপ্ত। সম্ভবত উত্তম কুমার অভিনীত এই একটি ছবিতেই কমল দাশগুপ্ত সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালে একচেটিয়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায় তারও পরে নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র প্রমুখ উত্তমকে মহানায়ক বানিয়ে ছিলেন।

কাজেই এ ছবি-র পরতে পরতে ইতিহাসের যে সমাপতন তা উত্তম কুমার নামক একজন নবাগত অভিনেতাকে তথা ফিল্ম-অ্যাক্টরকে আগামীর জন্য অনেকটা প্রস্তুত করে দিয়েছিল।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content