রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১২/০৮/১৯৫৫

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী,অরুণা ও ভারতী

পরিচালনা: চিত্ত বসু

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: প্রবীর

‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ উত্তম কুমারের ফিল্মি কেরিয়ারে ‘শাপমোচন’ উত্তর এবং ‘সবার উপরে’-র আগে একটি স্মরণীয় ছবি যেখানে বাণিজ্যিকভাবে উত্তম কুমার নামক ফিল্মস্টারের ভাগ্য অনেকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।
আমরা আগেই জেনে ফেলেছি ১৯৫৫ সাল একজন অভিনেতাকে আগামীদিনের নির্মাণ কোন পথে এগোচ্ছে সে ব্যাপারটা অনেকটা খোলতাই করে দিয়েছিল কারণ এ বছরের পরবর্তী যতগুলো ছবিতে উত্তম কুমার অভিনয় করেছেন সেখানে সবার আগে ফুটে উঠেছে আগামীর প্রতিশ্রুতি।

আমরা দুটি বিশেষ বিষয় এ ছবির মাধ্যমে খেয়াল করব যা, ‘শাপমোচন’ ছবিতেও উনি ব্যবহার করেননি। সেটা হল উত্তম কুমারের সেই ভুবন ভুলানো, মিলিয়ন ডলার হাসি।
একই বছরে খাঁটি বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি যখন মনে রাখার মতো শিল্পিত ছবিতে উনি অভিনয় করছেন সেই বিষয়টা খুব একটা ফেলে দেওয়ার নয় যে, নিজেকে কতটা ভাঙাচোরা করলে সমস্ত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা যায় এবং চরিত্রের সঙ্গে পূর্ণভাবে একাত্ম হওয়া
যায়। ব্যাপারটা নির্ভর করছে অভিনেতার ডেডিকেশনের উপর।

আমরা সবাই জানি একজন পূর্ণ মনস্ক অভিনেতার শুরুর দিকের প্রকাশ আর কেরিয়ারের শেষের দিকের প্রকাশ কখনওই এক হয় না। কিন্তু একজন অভিনেতা যদি যুগপ্রবর্তক হয়ে থাকেন। তাহলে তাঁকে কতকগুলো বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার মধ্যে একটা নিজের শারীরিক প্রতিফলন চরিত্র উপযোগী করে রাখা। উত্তম কুমারের মুখের হাসি সেরকম একটা আকর্ষনীয় সংরক্ষণ যা পরিচালকের অজ্ঞাতে শিল্পের মান বৃদ্ধির সহায়ক হতো। ক্রমে বিষয়টা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে, পরিচালক ছবিতে ফ্রেমের পর ফ্রেম ক্লোজ-আপ শট নেবেন উত্তম কুমারের হাসির।
আমরা আমাদের দেশের অনেক তাবড় অভিনেতাদের দেখব যাঁরা চরিত্রোপযোগী চেহারা উপস্থাপন করতে বারে বারে ব্যর্থ হয়েছেন। সেখানে পরিচালক, মেকআপ ম্যান অনেক অংশে মেরামতি করলেও নিজের প্রাথমিক চেহারাটা ঠিকঠাক না রাখতে পারায় বহু ছবির সারস্বত সম্পদ মার খেয়েছে। যে কারণে ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির নির্মাণকালে উত্তমবাবুর তৎকালীন চেহারাকে আড়াল করার জন্য পরিচালককে তাড়াতাড়ি প্রথম পর্বের ইতি টানতে হয়েছে।
সেখানে প্রথম পর্বের চারিত্রিক তথা ঘটনার টানাপোড়েন এত উচ্চমানের ছিল যেখানে বেশি কারিকুরি দেখাতে গেলে নায়কোচিত একরোখা চেহারার একটা যোগান প্রয়োজন ছিল।

পরিচালক শক্তি সামন্ত সবদিক বিবেচনা করে বিশেষ করে দ্বিতীয় অর্ধের উত্তমকে বেশি করে হাইলাইট করার জন্য প্রথম পর্বটি অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন। আমরা দর্শকরা ছবি দেখার সময় বুঝতে পারছিলাম যুবক ডাক্তারের রোলে পূর্ববর্তী যত ছবিতে উত্তমবাবু নিজেকে উপস্থাপন করেছেন তার থেকে এখানে শারীরিক দিক দিয়ে অনেক অংশে তিনি পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ অভিনেতার শৈল্পিক চাতুরিতে সেগুলি আমজনতার কাছে মোহময় মনে হয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

দশভুজা, আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ

মূল কথায় ফেরা যাক । “কঙ্কাবতীর ঘাট” ছবিটির কাহিনী এবং চিত্রনাট্য অনুযায়ী একজন ছিপছিপে গড়নের তলোয়ারের মতো পেটানো চেহারার যুবক প্রয়োজন ছিল। উত্তমবাবুর উপস্থাপনার গুণে অনেক অংশে তা, পূর্ণ হয়েছে।

মনে রাখতে হবে যে, সন্ধ্যারানিকে ছবির নায়িকার চরিত্রে মনোনয়ন করা হয়েছে। তিনি কিন্তু উত্তমবাবুর মতো উঁচু ঘরানার ভার্সেটাইল অভিনেতার সঙ্গে খুব কম ধরনের ছবি করেছেন। আমার বক্তব্যের সারকথা হল একজন নায়ক কতটা ছবির প্রতি সাক্ষর থাকলে তার পাশাপাশি চরিত্রগুলিকে সেভাবে পরিচালক, মনোনয়ন বা নির্মাণ করতে পারেন।

এ ছবিতেই আমরা দেখব উত্তম কুমারের প্রতিযোগী হিসাবে বিকাশ রায় বা অসিতবরণের মতো তথাকথিত যুবক নায়ক অংশগ্রহণ করেননি। পরিবর্তে সুযোগ পেয়েছেন শ্যাম লাহার মতো কমেডিয়ান।
কাজেই চরিত্রের প্লেয়ার কাস্টিংয়ে অনেকটা উত্তমবাবুকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। পরিচালক অনেক বাড়তি দায়িত্ব নায়কের কাঁধে দিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময়ের সুপার ডুপার হিট ‘শাপমোচন’-র মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি একটা ছবির সাফল্যের পিছনে বাঘা বাঘা অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী দায়িত্ব পালন করছেন কিন্তু চিত্ত বসু ছবির শুরু থেকেই যেন উত্তম নির্ভর হতে চাইছেন।

নায়িকার রোলে তিনি সুচিত্রা সেন বা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে মনোনয়ন করলে উত্তম কুমারের ঘাড় থেকে ছবি হিট করানোর দায়িত্ব অনেক কমে যেত। কিন্তু কাহিনির দাবি অনুযায়ী একজন দায়িত্বশীল যুবকের চোখে মুখে যে অভিব্যক্তি ফুটে থাকা সম্ভব বাস্তবে সেটাই যেন দাবি করছিলেন পরিচালক মহাশয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

শিল্পনিপুন, চলচ্চিত্র-সাক্ষর, ক্যামেরা-সচেতন উত্তম কুমারও সে চ্যালেঞ্জ মাথা পেতে নিয়েছিলেন। ক্যামেরাতে নিজেকে উপস্থাপন কতটা মার্জিত করলে এবং তার সঙ্গে চেহারার কোন অংশের মিছিল দিলে ছবির দৃশ্যমান বেড়ে ওঠে এ গবেষণা উত্তমবাবু প্রতি ক্ষণে ক্ষণে করতেন।

অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টিনন্দন হাসিটাকে মিলিয়ে দেওয়া এবং সুযোগ বুঝে সেটাকে দর্শকের মধ্যে জিইয়ে রাখা উত্তমবাবুকে অনেক অংশে অন্যদের থেকে এগিয়ে রেখেছিল।

কাজেই তাকে একজন হিট দেওয়া নায়ক হিসাবে, বাণিজ্যিক ছবির আইকন হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন চলচ্চিত্র গবেষক। একটা গোটা বছরে প্রতিটা ছবিতেই প্রায় নতুন নতুন নায়িকার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিজের একটা গড়পড়তা ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিশ্রুতিমান হওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না।
‘হ্রদ’ ছবির পুরস্কারপ্রাপ্তি, যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে বার বার। এবছর থেকেই উত্তমবাবু একটা দর্শকদের বর্গীকরণ শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর নিজের ছবির একটা নির্দিষ্ট ঘরানার দর্শককুল তৈরি।

১৯৫৫ সালের তামাম পরিচালকরা, পরোক্ষভাবে উত্তমবাবুকে সেই দর্শককুল নির্মাণে প্রচুর সহযোগিতা করেছেন। যার পূর্ণবিকাশ হবে ১৯৫৭ সালে গিয়ে। আমরা পরপর যদি উত্তম বাবুর ছবিগুলি নিয়ে আলোচনা প্রতি আলোচনা শুরু করি সেখানে দেখব ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ ছবিটির মুক্তি পরবর্তী এমন কিছু স্মরণীয় বাণিজ্যিক ছবি তাঁর কাছে এসেছে যেগুলো পুনর্মুক্তির দরবারে অনেক এগিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

উৎসবের উষ্ণতায় শারুল-শিমুল,

ছবিটির কাহিনি একজন গড়পড়তা বাঙালির অনেকটা স্বপ্নের নায়কের মতো। চিত্রনাট্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। সুর সংযোজনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কালিপদ সেন। আর সম্পাদনায় এক এবং অদ্বিতীয় বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়। পরিচালক চিত্ত বসু কোনও অংশে ছবিটির নির্মাণপর্বে খামতি রাখতে চাননি।

উনি যে টিম নিয়ে কাজ করতেন চেষ্টা করলে আরও একটা অগ্রদূত গোষ্ঠী তৈরি করা যেত। নিজের ক্যারিয়ারে মধ্যগগনে থেকে উনি উত্তম কুমারকে নিয়ে ছবি তৈরির যে নিষ্ঠা এবং পরিকাঠামো দেখিয়েছেন সেটা নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা স্মরণীয় ঘটনা।

এর পরবর্তী অনেক ছবিতে উনি মেনস্ট্রিম নায়িকাদের ব্যবহার না করেও উত্তম বাবুকে ভালো ছবিতে নির্বাচন বা মনোনয়ন করেছেন যেখানে, কাহিনির একটা আগাগোড়া বাঁধুনি ছিল।
সেই সুবাদে এই ছবির কাহিনিও আদ্যোপান্ত দর্শককে সিটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। উত্তমবাবু এই সুযোগটা ভালোভাবে অভিনয় কাজে লাগাতেন। যেখানেই পরিচালক একটা কাহিনির বাঁধন উপহার দিয়েছেন সেখানে মধ্যবিত্ত মানুষের মানসিক গঠনকে ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে অভিনয়ের কিছু কিছু কলা কৌশল প্রয়োগ করতেন।

আসলে স্বাধীন ভারতে দেশভাগের পরবর্তী অধ্যায় বাঙালি মনন সব সময় মানুষের মাঝারি সমস্যার সমাধানে ঘুরে বেড়াতো। তখন মধ্যবিত্ত লোকের একটা আর্থিক উত্তরণ চোখের মধ্যে স্বপ্নের আবেশ বুনে দিত বোম্বেতে রাজ কাপুর যেমন বস্তিবাসী, আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বপ্নকে সুন্দর সাংগীত মোড়কে উপস্থাপন করছেন; সেরকমই সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের সওদাগর হয়ে বাংলার বুকে উত্তম কুমার সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন।

এর সঙ্গে সঙ্গে ছিল সংগীতের মূর্ছনা। কালিপদ সেন যুগোপযোগী সাংগীতিক বিন্যাসে ছবিটির আঙ্গিক নির্মাণ যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। ফল ফলেছিল হাতে নাতে। ছবি হিট।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content