বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১২/০৮/১৯৫৫

প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর

পরিচালনা: তপন সিংহ

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: অধ্যাপক অশোক

‘হ্রদ’ ছবির অভাবনীয় সফলতার পর উত্তমকুমারের ফিল্মি কেরিয়ার এক ধাপে অনেকটা উপরে উঠে যায়। বিষয়টা এভাবে তৈরি হয় যে, রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে উত্তমের গ্রহণযোগ্যতা যখন মানুষের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে ঠিক সে সময়েই এরকম একটা চ্যালেঞ্জিং রোলে নিজেকে প্রকাশ করা উত্তমকে শিল্পী হিসাবে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিল।

কাজ করতে গিয়ে পরিচালক অর্ধেন্দু সেনের সঙ্গে অনেক অংশে মতপার্থক্য তৈরি হলেও উত্তমকুমার ফিল্মের যে নতুন একটা মান তৈরি করতে চলেছেন সেটা পরিচালকও মনের প্রচ্ছন্ন অংশে মেনে নিতেন। কাজেই যখন একের পর এক সিকোয়েন্সে উঠতে দেওয়ার জন্য উত্তমের ডাক পড়তো তখন সেখানে প্রতিটি অংশেই উত্তম নতুন কিছু করে দেখাতেন। ফলশ্রুতি হিসাবে মানুষের কাছে বিশেষত পরিচালকদের কাছে উত্তমের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমে ক্রমে বেড়ে গিয়েছিল। তখন উত্তমকুমার মানেই নতুন কিছু, নতুন কিছু মানেই উত্তমকুমার।
‘হ্রদ’ ছবি-র সবচেয়ে বড় জয় টিকা পেল উত্তমকুমার সে-বছর সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নিতে।
চারিদিকে তখন এমনকি সবার মুখেই শুধু উত্তম কুমারের প্রশংসা। খ্যাতি তখন শুধুমাত্র দর্শকমহলেই সীমাবদ্ধ রইলো না সাংবাদিক মহলেও ছড়িয়ে পড়ল। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ইতিমধ্যে বিএফজেএ (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ) নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, তামাম ভারতে ছিল সেই প্রথম।

বিএফজেএ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে। এবং সেই বছর থেকেই শুধু ভারতীয় ছবি নয় বিদেশি ছবিও সাংবাদিকদের বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান অর্জন করতে থাকে। আবার শুধুমাত্র ছবি নয়, শিল্পী এবং বিভিন্ন বিভাগীয় কলা-কুশলীদের শ্রেষ্ঠ কর্মকৃতির জন্য সাংবাদিকরা একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কারে ভূষিত করতেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

১৯৫৫ সালেই উত্তমকুমারের নায়ক জীবনকে সার্থক করে তুললেন তাঁরা, যখনই শোনা গেল সাংবাদিকদের বিচারে ১৯৫৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে তিনি পুরস্কৃত হতে চলেছেন। খুশিতে যেন উত্তমকুমার টলমল করে উঠেছিলেন। যথাসময়ে ‘হ্রদ’ ছবির জন্য তাঁরা উত্তমকুমারকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মানে ভূষিত করলেন।

এই গেল ‘হ্রদ’ ছবির মুক্তি পরবর্তী ঘটনা। প্রশ্ন হল যে ‘হ্রদ’ ছবি মুক্তি পেল, পুরস্কার পেলেন উত্তমবাবু তারপরেই কি সব চুকে গেল? না ‘হ্রদ’-র শুটিং চলাকালীন উত্তম আরও অনেক পরিচালকদের ছবিতে নাম লিখিয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তপন সিংহ মহাশয়।

আগেই বলা হয়েছে ১৯৫৫ সাল এমন একটি সাল উত্তমকুমারের ক্যারিয়ারে যে এসময়ে অনেক নতুন পরিচালক তাদের ফিল্ম লাইনে, হাতে খড়ি করার সময় উত্তমকুমারকে মনোনয়ন করেছিলেন নায়কের চরিত্রে। কারণ তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, মানুষের কাছে যখন ধরা দিয়েছে সেখান থেকে তাদের পরিচালক জীবন তৈরি করে নেওয়ার একটা মস্ত বড় সুযোগ থাকতো।
সে বছরই তপন সিংহ,মৃণাল সেন, কমল গঙ্গোপাধ্যায়, চিত্ত বসু প্রমুখ পরিচালকরা নিজেদের প্রথম পরিচালিত ছবিতে উত্তমকুমারকে খুব সহজে মনোনয়ন করতে পেরেছিলেন।

লড়াইয়ের ময়দানে উত্তমকুমার যেমন পায়ের তলার মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন অন্যদিকে এ ধরনের পরিচালকরাও নিজেদের অস্তিত্বকে সকলের কাছে প্রমাণ করার জন্য ভালো নায়কের সন্ধান করছিলেন। মনিকাঞ্চন যোগ হতে বেশিক্ষণ লাগেনি।

তপন সিংহের প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’ মুক্তির পাওয়ার সাত দিন থেকে ন’দিনের মাথায় প্রযোজক পরিচালক কোনও বাণিজ্যিক সফলতা না পাওয়ায় হাউস থেকে ছবি তুলে দিয়েছিলেন। এ ঘটনা তপনবাবু, সারাজীবন ভুলতে পারেননি। কিন্তু জিনিয়াসরা চিরকালই জিনিয়াস হয়ে থাকেন তপনবাবু আবার উঠে পড়ে লাগলেন নতুন চিত্রসত্ত্ব নিয়ে ছবি তৈরি করার। ভালো ছবি হয়েও দর্শকরা দেখতে না পাওয়ায় তপনবাবু মনে মনে অঙ্কুশের জন্য খুব আঘাত পেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি স্টুডিয়োর চত্বরই মাড়াননি।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-১: চলার পথে খানিক ভণিতা

তারপর একদিন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণা’ গল্পটির চিত্রসত্ত্ব কিনে আবার ছবি করার তোড়জোড় শুরু করলেন। ছবির নাম রাখলেন ‘উপহার’। উত্তম কুমার তখন নবাগত নায়ক হিসাবে মানুষের মনে দাগ কেটেছেন উত্তমের সঙ্গে আলাপ পরিচয় থাকলেও ওঁর ছবি সেভাবে দেখা হয়ে উঠতো না। তপনবাবুর তার রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে দর্শকরা যে মানে তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন ‘উপহার’ ছবিতে কিন্তু সে ধরনের কোন রোল ছিল না। ছিল তরুণ লেকচারারের ভূমিকায় অভিনয় করার অনেক বড় একটা সুযোগ।

উত্তমকুমারও মনে মনে বোধ হয় এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতেন যে, যদি কোন চ্যালেঞ্জিং রোল আসে বা গতানুগতিক জায়গা থেকে বেরিয়ে একটা রোল করা যায়। কারণ মানুষ রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখলেও তারা রিলিফ খুঁজে বেড়ান অন্য চরিত্রে। উত্তমের বিপরীতে এই ছবিতে নায়িকার ভূমিকা পালন করলেন মঞ্জু দে।
আসলে এই সময় উত্তম নিজেকে এমন একটা জায়গায় স্থাপন করেছেন যে নায়িকা কে হলেন, দর্শক এ বিষয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করেছেন। সুচিত্রা সেন হলে তো কথাই নেই। সুচিত্রা না থাকলেও উত্তমকুমারের মোহিনী আকর্ষণে মানুষ হলমুখী হতে শুরু করেছিলেন।

তপনবাবু নিজের আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘উপহার’ ছবি করার সময় উনি বুঝতে পেরেছিলেন উত্তমের ভবিষ্যৎ অনেক আশা ব্যাঞ্জক। ওঁর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। অভিনয়ের প্রতি মনোনিবেশ আর অভিনয়ের প্রস্তুতিকে মূলধন করে যে পরিশ্রম ‘উপহার’ ছবির সময় উত্তমবাবু করেছিলেন তপন সিংহকে অনেক অংশেই তা মুগ্ধ করেছিল। তখনই তাকে একজন ডিসিপ্লিন অ্যাক্টর হিসেবে তপনবাবুর মনে হতো। এর অনেক বছর পর যখন ‘ঝিন্দের বন্দি’ ‘জতুগৃহ’ ছবিগুলো উত্তমবাবু করেছেন তখনও মনে হয়েছে অভিনয়ের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। শিল্পটির প্রতি তাঁর অধ্যবসায়, সমসাময়িক অন্যান্য অভিনেতাদের মধ্যে দেখা যেত না।
আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, অজীর্ণ রোগে ঘরে বসেই আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে প্রতিকার সম্ভব

শরীরচর্চা: মেদ নিয়ে দুশ্চিন্তা? চিন্তা নেই, খেলাচ্ছলেই সুঠাম এবং সুগঠিত দেহের অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন

মিষ্টির এই সব গুণাগুণ জানতেন?

যাই হোক ‘উপহার’ ছবিটি মানুষের মধ্যেও খুব বেশি দাগ কাটতে পারেনি। কারণ উত্তমবাবু যে মানে আন্ডার-অ্যাক্টিং করেছিলেন সেটা নেওয়ার মতো ক্ষমতা, বাংলাদেশের দর্শকদের তৈরি হয়নি। আজও যদি কেউ ছবিটি ভিডিওতে চালিয়ে দেখেন দেখতে পাবেন ‘নায়ক’ রিলিজ করার বহু বছর আগে কি ডিসিপ্লিন অ্যাক্টিং করা যায় তার পরিচয় উত্তমবাবু এই ছবিতে দেখিয়ে গিয়েছেন।

তপন সিংহ এর অনেক বছর পর ‘ঝিন্দের বন্দী’ নামক উপন্যাসের যখন রূপ দিতে গিয়েছিলেন তখনও কিন্তু উত্তমের অধ্যবসায় তাঁকে একইভাবে মুগ্ধ করেছে। এবং তারও ৩-৪ বছর পর যখন ‘জতুগৃহ’ ছবিতে উত্তমবাবু সেই স্মরণীয় অভিনয় করেন তখনও তপনবাবুর বীক্ষণ একই জায়গায় ছিল।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এ ধরনের ছবি নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করি না। কিন্তু উত্তমকুমারের জাত চিনতে গেলে প্রতিবছরই এ ধরনের বেশ কিছু ছবি উত্তমকুমার যা করে গিয়েছেন সেগুলির প্রতি যত্ন সহকারে বিশ্লেষণ রাখলে আমরা এই উক্তির সারমর্ম বুঝতে পারব।

প্রকৃতপক্ষে উত্তমকুমার নামক একটা বটগাছ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে গড়ে উঠছে তার পরিচয় বা ইঙ্গিত অনেক পরিচালকই পেতে শুরু করেছিলেন। যার ফলে গোটা পাঁচের দশক জুড়ে উত্তমকুমার এমন কিছু পরীক্ষামূলক অভিনয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে গোটা ষাটের দর্শক জুড়ে তার অঙ্গুলি হেলনে তার চোখের ইশারায় টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিজেকে গড়ে তুলেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, তখনও ‘পথের পাঁচালী’-র মতো কালজয়ী সিনেমা মানুষ সে বছর দেখে উঠতে পারেনি। তারা ‘শাপ মোচন’, ‘সবার উপরে’ দেখতে অভ্যস্ত এবং ‘পথের পাঁচালী’ নামক একটি সিনেমা যে তৈরি হচ্ছে এ খবরও কিন্তু মেনস্ট্রিম বাংলা ছবির লোকেরা রাখতেন না। তাহলে উত্তমবাবুর প্রস্তুতি এবং লড়াইটা সেই মানের ছিল যেখানে পরিণত সত্যজিৎ রায় কাজে লাগানোর জন্য দ্বিধাবোধ করবেন না।

‘উপহার’ ছিল সে ধরনের একটি মাইলস্টোন যেখানে উত্তম আগামী দিনে পরিণত অভিনেতা হবার সব রকমের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content