বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ০৮/০৪/১৯৫৫

 

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

 

পরিচালনা: হরিদাস ভট্টাচার্য

 

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: অরুণ

‘রাইকমল’ মুক্তির এক মাসের মাথায় আবার রিলিজ করল আরেকটি স্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘দেবত্র’। আজকের দুনিয়ায় এটি একটি আর্ট ফিল্মের পর্যায় ভুক্ত।

কিন্তু আগেই বলেছি, ১৯৫৫ সাল উত্তমের জীবনে এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থাপন করেছিল যে বছরে উত্তমের ব্যক্তিগত জীবন এবং ফিল্মি কেরিয়ার দুটোই একটা আশাতীত সাফল্যের মুখ দেখেছিল।

এতদিন সবাই মানে প্রোডাকশন হাউস, ভিন্ন মানের পরিচালক, উত্তমকুমারকে নিয়ে কাহিনি, নায়িকা, কলাকুশলী ইত্যাদির লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও যখন শ্রীমতি পিকচারস- এর ব্যানারে ‘দেবত্র’ সিনেমার প্রস্তুতিপর্ব চলতে লাগলো, বাজারে তখন অলিখিত একটা নিদান প্রচারিত হতে লাগলো যে, উত্তমকুমার-কে বাদ দিয়ে খুব বেশিদিন বাংলা ছবি চলতে পারবে না।

ব্যাপারটা হল এই যে, এতদিন অনেক প্রোডাকশন হাউস উত্তম কুমারকে নিয়ে নানাভাবে তাদের ব্যবসায়িক ঘুঁটি সাজালেও অনেকদিন মুখ ফিরিয়েছিল কানন দেবীর নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস শ্রীমতি পিকচারস।
কিন্তু ‘দেবত্র’ ছবির যখন প্লেয়ার কাস্টিং শুরু হয়েছে পরিবারের কর্তব্যপরায়ণ এবং অন্যদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিক গঠনসম্মত একটি চরিত্রের রূপায়ণে পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য উত্তম কুমারের মুখ ছাড়া আর অন্য কোনও মুখকে মনের মধ্যে জায়গা দিতে পারেননি।
যদিও পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে এমন কিছু স্মরণীয় কালজয়ী চলচ্চিত্রের প্রস্তুতি চলছিল তার নিরিখে এ ছবির অংশগ্রহণ, উত্তম কুমারের কেরিয়ারে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হতো কিনা তার সমালোচনা হয়েছে।
কিন্তু উত্তম কুমার নিজে জানতেন যে, কানন দেবী ও প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি তাঁদের বাবা-মা প্রমূখরা হলে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন; তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ কোনও মতেই হাতছাড়া করা যায় না।

তখনও বাঙালির অন্দরমহলে কাননচর্চা অব্যাহত। তাঁর মতো নায়িকা-গায়িকা সর্বোপরি বাংলার আটপৌরে সত্তার উপস্থাপন, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব কম হয়েছে বলে বাঙালি মনে করত। সেই সারস্বত-সম্মানের অংশীদার হবার জন্য এ ছবির নায়কের চরিত্রে উত্তম এক কথায় সায় দিয়েছিলেন।

যে সময় তাঁর এবং সুচিত্রা সেনের রোম্যান্টিক যুগের সূচনা হচ্ছে সে সময় এ ধরনের একটি ব্যতিক্রমী ফিল্মে অভিনয় আগামী দিনের উত্তমকে অনেক লম্বা রেশের ঘোড়ায় পরিণত করেছিল।

পায়ের তলার মাটি শক্ত করার জন্য নায়ক হিসাবে উত্তমকে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। কিন্তু সুখের কথা হল, দেবকী বসু থেকে শুরু করে নীতিন বসু, নরেশ মিত্র থেকে শুরু করে বিভূতি লাহা; সমগ্র বঙ্গ সমাজের যাঁড়া এলিট ক্লাস পরিচালক হিসাবে তৎকালীন যুগে খ্যাতিমান ছিলেন তাঁদের সবার সঙ্গে কাজ করে উত্তম বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ছবির দিক নির্ধারক হতে গেলে তাঁকে বাছবিচার করলে চলবে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৮: সপ্তপদী: মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার মধ্যে মিলন রাখেননি তারাশঙ্কর

কেরিয়ারকে মসৃণ গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শুধু বাছাই করা ছবি দিয়ে একের পর এক ইমারত সাজালে হবে না। প্রাসাদের কারুকাজ বাড়ানোর জন্য আনুষঙ্গিক সমস্ত ধরনের ছবিতেই অংশগ্রহণ করা উচিত।

শিল্পের প্রয়োজনে প্রতিটা মুহূর্ত থেকে শিখতে উৎসাহিত করেছিল তাঁর সে-সময়ের পদক্ষেপ। ওই সময় যাঁরা সহশিল্পী হিসাবে উত্তমের পাশাপাশি অভিনয় করতেন তাঁরাও একসময় তৎকালীন বাংলা ছবির নায়কের ভূমিকা সদর্পে অভিনয় করেছেন। ছবি বিশ্বাস থেকে শুরু করে পাহাড়ি সান্যাল, রাধা মোহন ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে কমল মিত্র অনেকের সঙ্গে উত্তমের প্যারালাল অভিনয় শিক্ষার যে পরিবেশ ছিল সেখান থেকে উত্তরণের রাস্তা।

সবচেয়ে বেশি যে অংশটা না বলে নিলে এ সময়ের ফিল্মি পরিবেশ বোঝানো যাবে না তা হল, মঞ্চাভিনয় ঘেঁষা চলচ্চিত্র অভিনয়ের দিন আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। এক ঝাঁক তরুণ শিল্পীর উত্থান, বাংলা ছবির গতিবিধি পাল্টে দিয়েছিল।
এক সময়ের থিয়েটার নাটকের এগিয়ে থাকা শিল্পীদের নিয়ে উন্নত মানের চলচ্চিত্র তৈরির যে রীতি প্রচলিত ছিল তার বৃত্তের বাইরে উত্তম কুমারও ছিলেন না। তাঁর ‘শ্যামলী’ নাটকের জনপ্রিয়তাই অনেকটা ফ্লপ মাস্টার জেনারেল থেকে ফিল্মের সফল নায়কের তকমা এনে দিয়েছিল। অর্থাৎ অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ কুশীলবরা যাঁরা যৌবন দশায় চুটিয়ে মঞ্চ ও বায়োস্কপে অভিনয় করেছেন তাঁদের দাপটের যুগ অনেকটা অস্তমিত হতে শুরু করেছিল। পাশাপাশি উত্তম কুমারের মতো একজন প্রতিশ্রুতিমান ফিল্মি অভিনয়ের উত্থান পরবর্তীকালের বাংলা ছবিকে অনেক অংশে সাবালক করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে

স্বাদে-আহ্লাদে: কুলের আচারের নাম শুনলে জিভে জল আসে? রইল সহজ রেসিপি

‘দেবত্র’ ছবিতে অহীন্দ্র চৌধুরীর ভূমিকা, কানন দেবীর ভূমিকা মায় সবিতা বসুর অংশগ্রহণ, সব কিছুই উত্তম কুমারের কাছে অচেনা ছিল।
নিজের দক্ষতার প্রতি আস্থা রেখে সাহসী উত্তম একের পর এক ফ্রেমে কালজয়ী অভিনয়ের ছাপ রেখেছিলেন।

একই ফ্রেমে যখন অহীন্দ্র চৌধুরী এবং উত্তম বাবুকে দেখা যাচ্ছে দুটো মানুষের অভিনয়ের রীতিতে দুটি ঘরানার আলাদা ছাপ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। দিনে দিনে উত্তম বাচিক অপেক্ষা আঙ্গিক অভিনয়ের আধিক্য যেমন নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন, নিজের উত্তরণের সাক্ষী রেখেছিলেন, তার পরিষ্কার গোড়াপত্তন আমরা দেখি এই ছবির ফ্রেম টু ফ্রেম ট্রিটমেন্ট এ।

পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য কয়েক বছর পরে একটা ক্রাইম থ্রিলারে উত্তমকে মনোনয়ন করেন। সেখানেও উত্তম এক কথায় অনবদ্য অভিনয় দেখিয়েছিলেন। ছবির নাম ছিল ‘শেষ অঙ্ক’।

গতানুগতিক রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে পরিচালক চাবুকের মতো অভিনয় করার ক্ষমতাকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন সে ছবিতে। আমার বক্তব্য হল, ‘দেবত্র’ ছবির কাজ করতে করতেই পরিচালক, উত্তমেরর এই অভিনয় নৈপুণ্যের সাক্ষী হতে পেরেছিলেন। প্রোডাকশন হাউসের সচেতন দৃষ্টিতে এ ছবির ফ্রেম টু ফ্রেম শিল্পী নির্বাচন ছবির কাহিনিকে অনেক অংশে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিরুপমা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে চিত্রিত এ ছবির প্রতিটি ফ্রেমেই ছিল সমকালীন পরিস্থিতিকে উত্তরণের অলিখিত আবেদন।
গ্রামের সাদামাটা আটপৌরে বর্ধিষ্ণু একটি পরিবারের মানসিক জয়যাত্রার নিদান হেঁকে ছবির কাহিনিকার এবং চিত্রনাট্যকার সে সময়ের উত্তমকে অনেক অংশে চলচ্চিত্র উপযোগী করে তুলেছিলেন।

কারণ উত্তমের বা উত্তম কুমার নামক নায়কের ব্যক্তিগত জীবনটাও ছিল অনেক অংশে ‘দেবত্র’ ছবির নায়কের জীবন কাহিনির মতো।
তার উত্তরণের প্রতিটি পরত, চ্যালেঞ্জে চ্যালেঞ্জে বিদীর্ণ ছিল। ছবির প্রতিটি সংলাপ উত্তমকে প্রতিটি মুহূর্তে যেন ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাসকেই ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে দেখাতে বলা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৭: অ্যাকোয়াপোনিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎকৃষ্টমানের মাছ এবং গাছ বেড়ে উঠতে পারে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬: দুয়ারে অপচ্ছায়া

মাঝেমাঝেই পা ফুলে যায়? অবহেলা না করে সতর্ক থাকুন

আমার আরও একটা কারণে মনে হয় উত্তম কুমার খুব সচেতন ভাবে এই ছবিটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। কারণ, পরিণত উত্তমের শেষ দশ বছরের ছবির যদি বিশ্লেষণ করি সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে, প্রতিটা মুভমেন্টে উত্তমবাবু যেন চিত্রমোদিদের কাছে একটা অলিখিত নিদান হেঁকে দিচ্ছেন যে, দেখো হে ক্যামেরার সামনে সংযত অভিনয় মায় ফিল্মি অ্যাক্টিং কাকে বলে।

এ ছবিতে যেখানে পুরনো যুগের ম্যানারিজম-সর্বস্ব অভিনয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণ সেখানে উনি নিজেকে ফিল্মের অ্যাক্টর হিসাবে প্রমাণ করার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন।
অর্থাৎ একটা শেষ হতে বসা যুগের প্রতিনিধিদের সামনে নব্যযুগের একজন প্রতিনিধি দুটো আলাদা ঘরানার অভিনয়ের সীমারেখা কি হতে পারে প্রতিটা মুহূর্তে তার সাক্ষী রাখছিলেন।

ছবিটি আজকেও যদি আমরা আরেকবার বিশ্লেষণী মন নিয়ে দেখি, বোধহয় একথা অত্যুক্তি হবে না যে, একদিকে সমস্ত কুশীলবরা একটি বিশেষ ঘরানার অভিনয় দেখাতে যত্নবান ছিলেন; পাশাপাশি মঞ্চের অভিনয় মুক্ত ফিল্মি অভিনয়ের ভক্ত উত্তম কুমার একক ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

এ ধরনের দুটো শিল্পসম্মত সীমারেখা দেখার জন্যই ছবিটি একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content