সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ২৮/০১/১৯৫৫

 

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

পরিচালক সুধাংশু মুখোপাধ্যায়েরর ফিল্মি কেরিয়ারে দ্বিতীয় এবং শেষ কাজ। শুরুতেই বলে রাখা ভালো ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া ১২টি ছবির সাফল্যের এবং কিঞ্চিত ব্যর্থতার ডানায় ভর করে উত্তম কুমার নামক সাধারণ অভিনেতা, পিছিয়ে পড়া অভিনেতা তারকা হবার পথে এগিয়ে চলেছেন।

সালতামামিতে বলে রাখা ভালো, একই বছরগুলিতে সুচিত্রা সেন নামক ক্ষণজন্মা একজন নায়িকার সঙ্গে উত্তম কুমার নামক নায়কের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছবি তৈরি হবে। বছরের শুরুতেই মুক্তি পাচ্ছে ‘সাঁঝের প্রদীপ’; বছর শেষ হবে ‘সবার উপরে’ নামক অগ্রদূত পরিচালিত সেই কালজয়ী ছবির মুক্তির মাধ্যমে।

আগেই বলেছি, পঞ্চাশের দশকের প্রত্যেকটি বছরে একজন ফ্লপ মাস্টার জেনারেলকে নানা ধরনের নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করে নিজের জাত চেনাতে হয়েছিল। যদিও সমুদ্র মন্থনের পর অমৃতের কলস হাতে দেখা গিয়েছিল সুচিত্রা সেন নামক উদ্ভিন্ন যৌবনাকে।
‘সাঁঝের প্রদীপ’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের আগে ১৯৪৯ সালে মাত্র একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন: ‘হের ফের’ আর এই ছবিটি ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ ছবি। সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। উত্তম-সুচিত্রা যুগলের সঙ্গে ছবিটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন মলিনা দেবী, ছায়া দেবী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, ছবি বিশ্বাস, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তীর মতো বাঘা বাঘা অভিনেতারা।

আরও একটি যে কারণে ছবিটি সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তা হল, সুচিত্রা এবং সাবিত্রীর যুগ্ম-অংশগ্রহণ। এর আগে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে তাঁরা দুজনে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। ‘সাঁঝের প্রদীপ’-এ পরিচালক সুধাংশু মুখোপাধ্যায়, পুনরায় তাঁদের ব্যবহার করলেন এরপর অনেক উত্থান-পতনের ঘটনাকে সাক্ষী রেখে পরবর্তীকালে পরিচালক সুবোধ মিত্রের হাত ধরে ‘গৃহদাহ’ (১৯৬৭) ছবিতে এঁদের একসঙ্গে আবার অভিনয় করতে দেখা যাবে শেষবারের মতো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৪: মন তোর শক্তিই ‘মন্ত্রশক্তি’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

তোমরা কি জানো cakewalk বা icing on the cake —এই idiom গুলোর মানে কি?

প্রভাবতী দেবী সরস্বতী-র কাহিনি অবলম্বনে ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মনি বর্মা। কাহিনির বুনন ছিল দেখার মতো। স্বাতী এবং শাশ্বতী দুই বোন। বাবা মিস্টার বোস, কলকাতা শহরের অন্যতম ধনী। মেয়েদের সাধ-আল্লাদের কিছুই কমতি রাখেননি। আর দুই মেয়ে সব বিষয়ে চৌখস। নিজের গাড়িতেই একদিন হঠাৎ শাশ্বতী উপস্থিত গ্রামের মাসিমার কাছে। সেখানেই সাক্ষাৎ সুমন্তর সঙ্গে। শাশ্বতীর চোখে অভদ্র একরোখা তবুও তার সঙ্গে আলাপ। গ্রামের সরল পরিবেশে শাশ্বতী খুঁজে পেল নতুন প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু সুমন্তর মন প্রাণ জুড়ে গ্রামের এই সরল সাদাসিধে রাজলক্ষ্মী। দিন কাটছিল ভালোই। হঠাৎ সুমন্ত ভেসে গেল দেশ প্রেমের জোয়ারে। রাজলক্ষ্মী নয়, তার কাছে সবকিছু হয়ে উঠল দেশমাতা কেন্দ্রিক। বাধ্য হয়ে রাজলক্ষ্মীর বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন এক কুলীন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে। দু’ দিনেই বিধবা। সুমন্ত তখনও দেশ উদ্ধারের কর্মী। কিন্তু একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারল। ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক।

এ ধরনের একটা টানটান উত্তেজনাময় কাহিনী নিয়ে ছবির পথচলা শুরু। ছবিটিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল, সুচিত্রা উত্তমের প্রথাগত হিট ছবির নজর কাড়া অভিনয় ছাড়াও চমৎকার যুগলবন্দি। সবচেয়ে বেশি করে যেটা লক্ষ্য করা যায় ‘শাপমোচন’, “সপ্তপদী” মতো আগে থেকে ছবি হিট করার মসলা এতে না থাকলেও কাহিনির দাবি অনুযায়ী দু’ জনেই যেন উঠে পড়ে লেগে ছিলেন নিজেদের মেলে ধরতে।
ভাবখানা এরকম, ছবির চিত্রনাট্যে যাই থাক না কেন সংগীত পরিচালক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের যাই সুর সংযোজন করুক না কেন, তাঁরা দু’ জনে যখন একই ফ্রেমে উপস্থিত হবেন, তখন সকলের কাছে মনে রাখার মতো একটা বিনিময় তাঁরা করে যাবেন যা, বাংলা ছবিতে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

সবচেয়ে মনে রাখার মতো যে অংশটা না বললেন নয় তা হল, পরস্পরের সিঙ্গেল অভিনয় যখন চলছে স্বাভাবিক আচরণ করছেন। কিন্তু যখনই একই ফ্রেমে দু’ জন উপস্থিত হচ্ছেন তখন দু’ জনের মধ্যেই একটা ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। শিল্প জগতে এ ধরনের উত্তরণের ঘটনা খুবই বিরল বলে মনে হয়।

সুচিত্রা সেন কোনওদিন মঞ্চে অভিনয় করেননি। অন্যদিকে প্রত্যেকটা ফ্রিকোয়েন্সিতে তার কাছে সত্যজিৎ রায়ের মতো একাডেমিক গার্জেন ছিলেন না। কিন্তু তাদের পূর্ববর্তী ম্যানারিজম- সর্বস্ব যে বাংলা ছবির অভিনয় ছিল তা থেকে নিজেদের মুক্ত করে হলিউডের কিছু অংশকে রপ্ত করে বাংলা ছবিতে একটা নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। এখানেই ছিল দু’ জনের বোঝাপড়া।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১

ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সকালের জলখাবারে কী ধরনের খাবার খেতে পারেন? রইল ডক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে

চিত্রনাট্যের বাঁধুনি মানুষকে হল-এ সিটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল বিশেষত যখন তুলসী চক্রবর্তীর আবির্ভাব ঘটছে সে সময়। এই দশকেই দেখা যায় চারজন অভিনেতার একত্রীকরণ। ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, পাহাড়ি সান্যাল এবং তুলসী চক্রবর্তী। তুলসী চক্রবর্তী কালজয়ী অভিনয় করা সত্ত্বেও তাঁর নাম, প্রচারপত্রে থাকত সবশেষে। কিন্তু চরিত্রকে জীবন্ত করে রাখার দায় নিয়ে ওই স্বল্প সময়ে তিনি যে মুভমেন্ট দেখাতেন তাতেই ছবিটির সংযোগের সেতু নির্মিত হতো।

কাহিনীর ঘনঘটায়, এ ধরনের পার্শ্ব চরিত্রাভিনেতাদের দ্বারাই নায়ক-নায়িকাকে মিলন বা বিচ্ছেদের পথে এগিয়ে দিত। আমরা পরবর্তীকালে ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্রদের চরিত্রাভিনেতা রূপে যখন তাদেরকে প্রকাশিত হতে দেখি, তখন পরিচালককেও সবসময় সজাগ থাকতে হতো যে কাকে কিভাবে ব্যবহার করব।

ছবিটি যাঁরা এখনও দেখেননি তাঁরা যদি একটু মন দিয়ে দেখেন সেখানে আকর্ষণীয় দুটি বিষয় চিন্তার উপরে সূত্রে দেখানো যাবে। পঞ্চাশের দশকের ফিল্মে সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল গ্রামের পরিবেশের পাশাপাশি শহুরে আভিজাত্যকে দেখানো। যাতে মানুষের মনে একটা বৈচিত্র্যের অভিঘাত তৈরি করা যায়।
আমরা ‘পথের পাঁচালী’ নামক সিনেমা দেখে গ্রামীণ পরিবেশের নিটোল জীবনযাত্রায় টানাপোড়েন যেমন বুঝেছি, তেমনি এ বছরই মুক্তি পাওয়া ‘শাপমোচন’ ছবিটিতে দুটি সমান্তরাল জীবনযাত্রাকে পরিচালক তুলে ধরেছিলেন। সযত্নে প্রাণ পেয়েছিল, সম্পদে প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ শহুরে মানুষের শৌখিন জীবনযাত্রা আর অভাবী মানুষের আদর্শ সর্বস্ব হয়ে গ্রামে বাস করার মানসিকতা।

‘সাঁঝের প্রদীপ’ ছবিটাও সেখান থেকে খুব বেশি দূরের ছিল না। শহুরে নাগরিক জীবনের একটা মানচিত্রের পাশাপাশি ঘরোয়া, মেঠো, গ্রামীণ রূপরেখা এবং সেখান থেকে দেশ সেবার ব্রতী হয়ে আগামীর পথ নির্মাণ করা পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিল।

এর আগে ‘চাপাডাঙ্গার বউ’ ছবিতে সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সেই অংশটাকেই খুব ভালো করে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। ছবির নির্মাতাদের সংগীত পরিচালক মনোনয়ন যথার্থই ছিল। ছবিটিতে ক্যামেরার কাজ করেছিলেন দিব্যেন্দু ঘোষ এবং সম্পাদনা করেছিলেন সুকুমার মুখোপাধ্যায়য়ের মতো মানুষ।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

ত্বকের পরিচর্যায়: বাড়ির কাজ করতে করতে হাতের তালু খসখসে হয়ে গিয়েছে? রইল ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

এই দু’ জনের ভূমিকাও ফেলে দেবার মতো নয়, বিশেষত যেখানে সুচিত্রা সেনের ক্লোজআপ শর্ট নেওয়া হচ্ছে। বম্বেতে এসময় গুরু দত্ত ফিল্ম লাইনে সর্বপ্রথম ৩৬০ ডিগ্রি ক্লোজআপ শটের প্রবর্তন করেছেন, যা ইতিপূর্বে ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখা যেত না। কলকাতাতে ক্যামেরাম্যান দিব্যেন্দু ঘোষ বিষয়টি শুরু করলেন।

উত্তম কুমারের উপর তখনও কোনও কন্দর্পদেবের আশীর্বাদ ঠিকঠাক বর্ষিত হয়নি তার মুখের রেখার মধ্যে তখনও সংগ্রামী চিন্তা ভাবনার পরিচয় যা পরিচালক খুব ভালোভাবে দেশ সেবকের কাজে লাগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এক মেয়ের মা সুচিত্রা সেনের চোখে মুখে তখন উথলে ওটা যৌবনের রূপরেখা। তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানি যত বেশি করে ছবির মধ্যে রাখা যায় ক্যামেরাম্যান এবং পরিচালকের যোগসাজসে সে ঘটনাটাই বেশি করে ঘটেছিল।
আমার বলার উদ্দেশ্য পরিচালক, চরিত্রের মাধ্যমে কাহিনি নির্মাণের পাশাপাশি ক্যামেরাতে পাত্র-পাত্রীকে অতি উত্তম করে দেখানোর ব্যবস্থাটাও রেখেছিলেন। অর্থাৎ সেলুলয়েডের একটা প্রধান মূলধন ক্যামেরার কারসাজি সেটা পরিচালক ভোলেননি।

মাত্র একটা ছবির অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে পরিচালক সে অংশে নিজেকে সফল প্রমাণ করেছেন। যার ফলে ছবি হিট। ওদিকে তখন অনুপমা, রাইকমল, দেবত্র-র মতো ছবির কাজকর্ম শুরু হচ্ছে। উত্তম কুমার এবং অন্যদিকে সুচিত্রা সেনও অন্য ছবিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।—চলবে

ছবি: সংগৃহীত।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content