সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১৭/১২/১৯৫৪

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

পরিচালক চিত্ত বসু-র ফিল্মি কেরিয়ারে ১১ নম্বর কাজ। পরবর্তীকালে উত্তম কুমারকে সঙ্গে নিয়ে আরও ছয়টি ছবি পরিচালনা করবেন।

উত্তম কুমার এবং সন্ধ্যারানি অভিনীত আরেকটি সাড়া জাগানো ছবি। পরিচালক চিত্ত বসু। যিনি আগে ১০-১০ টি ছবির পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে উত্তম কুমার নামক নতুন নায়কের সঙ্গে কাজে নামলেন তিনিও ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারেননি যে শিল্পের ভাষায় নামকরা নায়িকা না নিয়ে কিভাবে কাজ করা যায়।

তাই সে সময়ের খ্যাতনামা শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম সন্ধ্যারানিকে তিনি এ ছবির নায়িকা হিসাবে মনোনয়ন দিলেন। উত্তমবাবু, নায়কের চরিত্রে রূপদান করার আগে অনুরূপা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে তৈরি এ ছবির প্রতিটি খুঁটিনাটি বাড়িতে বসে রপ্ত করছিলেন। চলমান ত্রুটি মিটিয়ে নেবার একটা জোর কদমে প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন এই ছবির প্রস্তুতির সময়।

শোনা যায় নিজের ঘাড়ের ব্যালেন্স ঠিক করার জন্য মাথায় অনেকগুলো বই পরপর সাজিয়ে বাড়িতে সোজা হেঁটে চলে বেড়াতেন। আবার ওঁর ভাই তরুণ কুমার বলতেন ‘মন্ত্রশক্তি’ ছবিতে দাদা সংস্কৃত টোলের পণ্ডিত হিসাবে নিজেকে পরিচিত করার জন্য বাড়িতে গালের ভেতর গোটা সুপারি দিয়ে উচ্চারণ প্র্যাকটিস করতেন।
চিত্রনাট্যের প্রতিটি বাঁকেই ছিল মূহুর্মূহু চ্যালেঞ্জ। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করার সুবাদে উত্তমবাবু জানতেন কোন অস্ত্রে দর্শককে ঘায়েল করা যায়। কিন্তু সন্ধ্যারানির চেহারা, সে ধরনের ছিল না। তার মায়াময় চোখের আবেদন, দর্শককে অন্যভাবে মনোরঞ্জন করাতো। লাস্যময়ী নায়িকার ভূমিকায় তিনি কখনোই স্বচ্ছন্দ হতে পারতেন না।

উত্তম কুমার এ তত্ত্বটি বিশেষভাবে অভ্যাস করে উনি সন্ধ্যারানির সঙ্গে লাগাতার বিষয়ের গভীরে চলে যেতেন যাতে একটি অপরিচিত চরিত্রে প্রাণ দান করা যায়। এ যাবৎ উত্তমের রূপায়ণ করা চরিত্রের দিকে লক্ষ্য রাখলে বোঝা যাবে, হয় তিনি গ্রামের অভাবী কোনও ছেলের চরিত্রে অথবা কোনও প্রতিপত্তিওয়ালা যুবকের চরিত্রে— এ দু’ ধরনের ক্যাটেগোরিতে উত্তমবাবু অভিনয় করেছেন। সেখানে কোথাও বিফল কোথাও সফল হয়েছেন কিন্তু এ ছবির আবেদনই ছিল অন্যরকম।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৩: মোর সাধের বাসরে ঘটল ‘গৃহ প্রবেশ’

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?

চিরাচরিত ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে পরিচালক সে সময় যে সময়ে উত্তম-সুচিত্রা নামক মণিকাঞ্চন রোগে অভাবনীয় রোম্যান্টিক যুগের সূত্রপাত ঘটেছে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির হাত ধরে মানুষ প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধন ইত্যাদির সংজ্ঞা, নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। সে সময় মাত্র মন্ত্রের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পর্কের বাঁধন দেখাতে পরিচালককে বেশ কয়েক ধাপ বেশি চিন্তা করতে হয়েছিল বটে।
ছবিটিতে পার্শ্ব চরিত্র হিসাবে নবদ্বীপ-নৃপতি-ছবি বিশ্বাস-তুলসী চক্রবর্তী ইত্যাদিরা ছিলেন কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার সময় উত্তমবাবুকে সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়েছে তার ঝকঝকে গড়ে তোলা রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ যেন টোল না খেয়ে যায়। আবার অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ যদি না তিনি গ্রহণ করেন তাহলে রোম্যান্টিক নায়কের ভিতর সঞ্চিত থাকে যে চরিত্রের রসদ সেটা প্রকাশ করার জায়গাও থাকতো না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৫: বালক অষ্টাবক্রের বুদ্ধিবলে পিতা কহোড় পেলেন নবজীবন

উত্তম কুমারের স্বর্ণযুগের রোম্যান্টিক সিনেমা যদি আমরা কালিক মূল্যায়ন করি তাহলে সেখানে দেখতে পাবো, প্রতিবছর উত্তমবাবু এক একটা চ্যালেঞ্জিং রোল করেছেন যেগুলো গতানুগতিক সিনেমার ধারাতে পড়ে না। এর পরের বছরই যে সময় ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’-র মতো ছবি মুক্তি পাবে সে বছরই উনি অর্ধেন্দু সেনের আরেকটি কালজয়ী সিনেমাতে অভিনয় করবেন। ‘হ্রদ’ ছবিটির আবেদন সে সময়ে ছিল সম্পূর্ণ যুগের বিপরীতপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তারপরের বছর ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘চিরকুমার সভা’ এ ধরনের অপরিচিত ও নিয়মিত রোলে উত্তমবাবু নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

পরের বছরই একদম হাতে খড়ি নেওয়া পরিচালক মৃণাল সেন ‘রাতভোর’ নামক একটি ছবির জন্ম দেবেন, উত্তমবাবু সেখানেও নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। গোটা পাঁচের দশক বিভিন্ন নায়িকা এসে যেমন উত্তমবাবুকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছেন পাশাপাশি বিভিন্ন মানের পরিচালক তাদের নানা রকম ছবিতে বৈচিত্রের দাঁড়িপাল্লায় উত্তমবাবুকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন যাতে যে কোনও মানে ওঁকে দাঁড় করানো যায়।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

আমরা, ১৯৫৪ সালের যে মুক্তিপ্রাপ্ত বারোটি ছবির তালিকা পরপর দিয়ে আলোচনা করছি ‘মন্ত্রশক্তি’ ছবিটা সে বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ ছবি এবং প্রতিটি ছবিতে দেখা গেল যে নায়িকার ভূমিকায় না হলেও পরিচালকের ভূমিকা বিপরীত মেরুর। অর্থাৎ ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির সঙ্গে ‘বকুল’ ছবির কোনও মিল নেই। যেমন পরিচালক তেমন নায়িকা। তেমন কাহিনী কিন্তু একটাই মিল নায়কের নাম উত্তম কুমার।
চরিত্রের হাতছানি, ছবির বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে পরিচিত ঘরানার নায়িকার সঙ্গে অভিনয়ের আদান-প্রদান। এটা আজকে যত সহজে আলোচনার টেবিলে আলোচনা চলছে। তত সহজে সেদিন চরিত্রগুলোকে রূপদানের সুযোগ ছিল না। পরপর দশখানা ছবির ফ্লপের তকমা মাথায় নিয়ে একজন নায়ককে নানা চরিত্রের রূপদান করতে গিয়ে নানা ধরনের সহশিল্পী, নানা ধরনের নায়িকা নানা ধরনের পরিচালকের ঘরানার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া কতটা কঠিন কাজ সেটা সেই জায়গায় নিজেকে স্থাপন না করলে বোঝা যাবে না।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: সকালে জলখাবারে থাক নতুনত্ব, বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালক পনির পরোটা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২: এসেছে দৈব পিকনিকে

নায়ক উত্তম কুমারের এখানেই জয়যাত্রা। দিনে দিনে সময় যত এগিয়েছে রথে ঘোড়ার সংখ্যা তত বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের তরল উপস্থিতি থেকে বহু অশ্ব সম্মিলিত রথটি, খুব দ্রুত বেগে উত্তমবাবুকে টেনে নিয়ে চলেছে অজানা ঠিকানায়।

ছবিটি কাহিনী বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমান্তরাল বাংলা ছবি যে ধারাতে বয়ে চলেছিল এ ছবি ছিল সেই সিংহের ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা।

ছবিটির মূল আবেদন ছিল আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতীয় চিরাচরিত ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে থাকা পরিচালক খুব ভালোভাবে উত্তম কুমারকে বিষয়টা বুঝিয়ে দিতেই প্রতিটি শট প্রায় ‘ওয়ান টেক-এ ‘ওকে’ হয়ে যেত।

এ ভাবে একের পর এক সাফল্যের মিনারে উত্তমবাবু নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। ছবি রিলিজ করার সঙ্গে সঙ্গেই হলে সাড়া পড়ে গেল। ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র নায়ক কেমন টুলো পণ্ডিত সেজে অভিনয় করছেন একবার দেখে আসা যাক। এ যেন ঝা-চকচকে
কর্পোরেট জীবন থেকে নিজেকে আবার প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যেটাতে পরিচালক খুব ডিস্টিশন-সহ পাশ মার্কস পেয়েছিলেন।—চলবে

ছবি: সংগৃহীত।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content