শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ০১/১০/১৯৫৪

 

প্রেক্ষাগৃহ: দর্পণা, ইন্দিরা ও প্রাচী

উত্তম কুমারের না দেখা আর একটা ছবি। এ প্রজন্মের তো বটেই, এই প্রতিবেদকও ছবিটি কখনও হলে বা দূরদর্শনে দেখেননি। হারিয়ে যাওয়া অনেক ছবির মধ্যে এই ছবিটি অন্যতম স্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ, অরুন্ধতী দেবীর সঙ্গে করা প্রথম ছবি হিসাবে এই ছবিটি সে সময় সামান্য হলেও স্বীকৃতি পেয়েছিল।

মোদ্দাকথা হল, অগ্নিপরীক্ষা মুক্তি পাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্য হয়েছিল অন্যান্য ছবিগুলোর ক্ষেত্রে। কারণ, তখনও উত্তম-সুচিত্রা বা উত্তম-সাবিত্রির অন্যান্য ছবিগুলো হল-এ রমরমিয়ে চলছিল। কিন্তু ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র ঢেউ এসে সমস্ত ছবির হিসাব ওলট পালট যায়।

এক্ষেত্রে উত্তম-সুচিত্রা জুটির এই ব্লকবাস্টার ছবিটি পরোক্ষভাবে উত্তম-সুচিত্রার নিজেদের ছবি বা উত্তম অন্যান্য নায়িকাদের সঙ্গে ছবিগুলিকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
সে সময় মুক্তি পাওয়া উত্তম সুচিত্রা-র ছবি ছাড়াও অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের যে ছবিগুলো প্রেক্ষাগৃহে চলছিল সেগুলোকেও একটা অলিখিত প্রতিযোগিতায় ফেলেছিল এই ছবিটি।

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, বাঙালি দর্শক শুধু বাংলাতে বসে বাংলা ভাষায় নির্মিত ছবি দেখতেন না, তাঁরা বলিউডের হিন্দি ছবিও যথেষ্ট পরিমাণে দেখতেন।

মাত্র এক বছর আগে মুক্তি পাওয়া অনেক বাঙালি কলাকুশলীর সম্মিলিত প্রয়াসে তৈরি বম্বের ‘নাগিন’ ছবি সারা ভারতবর্ষকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিল। ‘নাগিন’ ছবির সাংগীতিক মূর্ছনা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে একটা পাকাপাকি আসন বম্বের বুকে এনে দিয়েছিল।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ছবিতে সে অর্থে তেমন কোনও স্থান সেই সময় গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, উত্তম-সুচিত্রা ছাড়াও আরও অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে চলমান ছবিতে কালিপদ সেন, রাইচাঁদ বড়াল এবং পঙ্কজকুমার মল্লিকদের একচেটিয়া রাজত্ব চলছিল, সঙ্গে ছিলেন নবাগত রবীন চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৮: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতীয় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা আমরা ভুলবো না

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

বম্বেতে বাঙালি হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জয়যাত্রা, পরবর্তীকালে বাংলার বুকে ঘটানোর জন্য এখানকার প্রযোজক-পরিচালকরা অনেক বেশি কোমর বাঁধছিলেন ব্যাপারটা এরকম ঋতুপর্ণ ঘোষ গৌতম ঘোষরা যখন বাংলায় বসে ছবি তৈরি করছিলেন তখন বম্বের কোনও শিল্পীকে (যেমন ‘চোখের বালি’-তে ঐশ্বর্যা রাইকে, ‘যাত্রা’তে রেখাকে) মনোনয়ন করে বাংলা ছবিতে একটা অন্য মান দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সত্যজিৎবাবুও সর্বভারতীয় অভিনেতা অভিনেত্রীকে মাথায় রেখে যখন চরিত্র বিনির্মাণ করেছেন। সেখানে সারা ভারতবর্ষ থেকে শিল্পী নিয়ে এসে ছবিতে নতুন আঙ্গিক উপস্থাপন করেছিলেন। যাতে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে একটা নতুন আবেদন রাখা যায়। এ ধরনের একটা প্রকৌশলেই তাঁরা অবলম্বন করছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪০: শুধু খাল-বিল ঝিল নয়নজুলিতে মৌরালা মাছ করে প্রায় ২০ লক্ষ শিশুর অনুপুষ্টির ঘাটতি মেটানো সম্ভব

স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪: যেখানে অর্জিত ভক্তি ও বিশ্বাস আছে, সেখানেই ভগবান আছেন

‘বকুল’ ছবির আলোচনা যেটা সবচেয়ে প্রধান বিষয় সেটা হল নিউ থিয়েটার্স-র ব্যানারে ছবি তৈরি হচ্ছে। পরিচালক ভোলানাথ মিত্র। এর আগে মাত্র একটা ছবি তৈরি করেছেন সে ছবিটাও নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে। আর পরিচালক জীবনে এটাই ছিল তার শেষ ছবি অর্থাৎ মাত্র দুটি ছবির পরিচালনা করে তিনি বাংলা ছবিতে নিজের অবদান রেখেছেন। ছবিতে নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়কে তিনি নায়িকা হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় কেরিয়ার শুরু করেছেন। এহেন নায়িকার সঙ্গে উত্তম কুমার যখন অভিনয় করছেন তখন অবশ্য ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র শুটিং চলছে। বিষয়টা এমন নয় যে, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ মুক্তি পেল তা দেখে আবার নতুন নায়িকা নেওয়া হল। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ শুটিং চলাকালীন আরো অন্যান্য ছবিতে যেমন ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘অনুপমা’ প্রভৃতি ছবিতে উত্তম অভিনয় করেছেন।
ছবির কাহিনীতে যথেষ্ট নতুনত্ব ছিল। সাধারণ গড়পড়তা ছবি অপেক্ষা এ ছবিটা অনেক বেশি এগিয়েছিল। কিন্তু সেসময় উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্টিসিজম থেকে মুক্ত হয়ে উত্তম-অরুন্ধতীর এ ধরনের ছবি দেখার পালস বাংলা ছবির দর্শকদের তৈরি ছিল না। যার ফলে ভোলানাথ মিত্রকে পরিচালক হিসেবে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল এই ছবি রিলিজ করিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে নিউ থিয়েটার্স ছিল তখন অস্তাচলগামী সূর্য। সাধারণভাবে, প্রোডাকশন হাউস থেকে ছবি তৈরির রেওয়াজটা তখন একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছিল। সেখানে জায়গা নিচ্ছিল ব্যক্তি-উদ্যোগ নির্মিত চলচ্চিত্রের। ‘এমপি প্রোডাকশন’, ‘নিউ থিয়েটার্স’, ‘কালী ফিল্মস’ এই রকম যারা ছবি তৈরির জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে কাজের গতি বদলাচ্ছিল।
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

বকুল ছবি সমালোচনায় বলা যায় যে, ছবিটি যদি আজকে বসে আর একবার দেখা যায় তাহলে প্রেক্ষিত আর কাহিনীতে সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিল তা, বলাই বাহুল্য। আগেই বলা হয়েছে, উত্তমবাবুর অভিনয়ে কিন্তু অনেকটা হলিউডি ঘরানা ছিল এবং উত্তমবাবু পরিমিত মাত্রায় জীবনের প্রথম দিন সেটা শুরু করেছিলেন যা হজম করতে সে সময়ের সিস্টেম অনেক সময় নিয়েছিল। যার কারণে এফএমজি নাম নিয়ে ঘুরতে হয়েছে তাকে। কিন্তু যখন উত্তম কুমারের ধার বোঝা যেতে শুরু করলো তখন কিন্তু আমরা দেখতে পাবো আর কিছুদিনের মধ্যেই ‘হ্রদ’ নামক একটা ছবি অর্ধেন্দু সেনের তত্ত্বাবধানে তৈরি শুরু হবে যেখানে সেই সময় উত্তম বাবু জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছিলেন।
‘বকুল’ ছবিটি আজকের ভাষায় আর্ট ফিল্ম। সাধারণ একটা গতানুগতিক কাহিনীকে কীভাবে উপস্থাপন করলে মানুষের মনে সারস্বত সাক্ষী রাখা যায় সেরকম চেষ্টা পরিচালক শুরু করেছিলেন। অবশ্যই নিউ থিয়েটার্সের যে ম্যানারিজম সেখান থেকে মুক্ত ছিলেন না তার কলা কুশলীরা। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে উত্তম কুমার নিজের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির আগের বছর এবং ঋত্বিক ঘটক যখন “নাগরিক” সিনেমা তৈরি করছেন সে সময়ে এ ধরনের ছবি নির্মাণ সত্যিই সাহসের পরিচয় বলতে হবে। কারণ, সাধারণ গতানুগতিক প্রেমের উপাখ্যানকে ছবিতে রং দেওয়ার যে দায়িত্ব অগ্রদূত পালন করেছিলেন পরবর্তীতে অগ্রগামী সেই ধারা বজায় রাখার হাল ধরেছিলেন সেদিক দিয়ে ‘বকুল’ ছবির নির্মাণ চিত্র কোনও অংশে প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র থেকে কম ছিল না। একথা হলফ করে বলা যায়। কে বলতে পারে, সময়োপযোগী ট্রিটমেন্ট হলে উত্তম-অরুন্ধতী জুটিও বক্স অফিসে ঝড় তুলত না।—চলবে

ছবি: সংগৃহীত।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content