শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


প্রেক্ষাগৃহ : পূর্ণ, শ্রী, প্রাচী ও আলেয়া

নায়ক হিসাবে প্রথম ছবি। গতানুগতিক ধারায় তাল মিলিয়ে ছবি অবশ্যই উত্তমকেন্দ্রিক নয়। বাণিজ্যিক ছবির যে ধারা অনুসৃত হতো এ ছবির বেলায় তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রাক সুচিত্রা যুগের স্বপ্নসুন্দরী ছবি রায় (যাকে মনে মনে কল্পনা করে শচীন ভৌমিকের কথায় এবং রাহুল দেব বর্মণের সুরে তৈরি হয়েছিল অমর গীতি ‘মনে পড়ে রুবি রায়’) ছিলেন এর নায়িকা।

কাহিনীচিত্রের বুনন, কখনওই কালজয়ী উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিকের বিখ্যাত রচনার একটা সারস্বত নিরাপত্তা আছে। যার উপর আস্থা রেখে কানন দেবীর নিজস্ব প্রোডাকশনে সবসময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে এবং সাফল্যও পায়ে হেঁটে এসেছে।
সিচুয়েশন ভিত্তিক উপযুক্ত কথার সঙ্গে সুরের দাম্পত্যে গান তৈরিও চিত্রশিল্পের বড় চাহিদা। এখানেও রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু গীতবিতান ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রকে গানের কথা যুগিয়ে যে সমস্ত ক্ষণজন্মা গীতিকার সোনার ফসল তুলিয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাদের উপস্থিতি এ ছবিতে দেখা যায়নি।
শুধু উত্তমবাবুর নায়ক হিসাবে এ ছবিতে আবির্ভাব এবং ছবি সর্বসাকুল্যে অসফল এটা কিন্তু এরকম ‘এককথায় উত্তর দাও’… গোছের ব্যাপার নয়। পরবর্তীকালে উত্তম কুমারের আত্মজৈবনিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমাদের স্বরচিত পাণ্ডিত্যের আস্ফালন ‘উত্তমবাবুর প্রথম দশটি ছবি ডাহা ফেল’।
মূল ঘটনাটা কিন্তু একেবারে বিপরীত। নবাগত নায়ক হিসাবে উত্তম চট্টোপাধ্যায় নেহাতই আর পাচজন শিল্পীদের মধ্যে একজন। তখন অসংখ্য হিট দেওয়া উত্তমোচিত দাপট ফিল্মলাইনে আসেনি। পরিচালক নব্যেন্দু সুন্দর কোন অংশেই কালজয়ী তালিকাভুক্ত নন। আসলে পরিচালকের চেতনার উর্বরতা, ফিল্মের গুণগত মান তথা বাণিজ্যিক সাফল্যকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে।

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ আজকের দিনে আমরা উত্তম সুচিত্রার প্রথম ছবির ইতিহাস লিখতে বসে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখি। কিন্তু যখন রিলিজ করেছিল তখন আমজনতা, গড়পড়তা একটা ছবি দেখতেই গিয়েছিলেন। এবং বেশিরভাগ মুগ্ধতা তুলসী চক্রবর্তী এবং মলিনা দেবীই টেনে নিয়েছিলেন। উত্তমবাবু, আর্টিষ্টের কৌলীন্যে অন্যান্যদের মতোই ছিলেন। বিশেষ কিছু নন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১: আলোছায়ায় ‘দৃষ্টিদান’ [২৪/০৪/১৯৪৮]

ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে চললে বাড়িতেই ডেঙ্গির চিকিৎসা করা সম্ভব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২: আপনার গৃহসজ্জা প্রবীণ মানুষটির উপযুক্ত তো?

‘কামনা’ ছবিতে জাদরেল অভিনেতা বলতে এক এবং অদ্বিতীয় জহর গঙ্গোপাধ্যায়। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে। উত্তমবাবু, সুযোগ পেয়েছেন — এ বদান্যতা দেখাতেই বেশি মনোযোগ ব্যয় হয়ে গিয়েছে। সেখানে ‘ক্যামেরার সামনে অতি বাড়াবাড়ি চলে না’ — এসব সংলাপে রাখা যায় কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ খুব কষ্টকর। অপরিচিত এবং সংখ্যায় বেশি ছবিতে অভিনয় করা আর্টিষ্টদের সাথে নায়ক হিসাবে নিজের ফিল্মোচিত স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনাকে প্রয়োগ করা কষ্টকরই। আবার সেই ঘুরেফিরে এক কথা যদি না পরিচালকের চিন্তাভাবনার গতি থাকে। একটা গোটা ফিল্মের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে যদি প্রতিটা বিভাগে পরিচালক সজাগ দৃষ্টি রাখেন। যে ফর্মূলাতে ‘গুগা বা বা’-তে সত্যজিতবাবু তপেন চট্ট্যোপাধ্যায়কে অমর করেছেন।
উত্তম কুমার খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে যখন ‘ছোটি সি মূলাকাৎ’ (১৯৬৭)- এ মুখ থুবড়ে পড়ছেন তখন প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে মুম্বাই অনেক এগিয়ে। সেট নির্মাণ থেকে সংগীত নির্মাণ সবেতেই কুশলতার পরিচয় থাকলেও সেগুলির ব্যবহারিক দক্ষতার অভাব, ছবিটিকে সাফল্যের মুখ দেখতে দিল না। যে সময় উনি বাংলায় ‘নায়ক’-র মতো সিনেমায় নিজেকে প্রকাশ করছেন।

অন্যদিকে তার ১৩ বছর আগে অনেক কম প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে খোদ কলকাতাতে বসে একই কাহিনীর কাঠামোতে নির্মিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪)-য় রোগা ডিগডিগে, কম পরিণত উত্তম (ও সুচিত্রা) বাজিমাত করলেন। ছবিটি বাণিজ্যিক ছবির ইতিহাসে আজও কালোত্তীর্ণ। এর জন্য পরিচালক বিভূতি লাহাকে (অগ্রদূত গোষ্ঠীর) কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। কারণ প্রযোজকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে প্রথম এবং শেষ পছন্দ ছিল বিকাশ রায় ও অনুভা গুপ্ত।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৫: হৃদয়ে হৃদয় মিলল মিথিলা অযোধ্যার

ত্বকের পরিচর্যায়: চুল পড়ার কারণগুলো জানলেই তা রুখে দেওয়া যায়, রইল ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৪: অবশেষে দময়ন্তী ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে…

শিশুকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন? কী কী ওষুধ সঙ্গে রাখবেন? রইল পরামর্শ

এই প্রতিবেদকের উদ্দেশ্য নয় ‘কামনা’ ছবির ব্যর্থতার কারণ খুজে বের করা। কিন্তু মহানায়ক উত্তম কুমার-এর সালতামামিতে ফ্লপ ছবিগুলোর অলিখিত উপস্থিতি ওঁর শৈল্পিক দক্ষতাকে প্রশ্নচিহ্ণের মুখে দাড় করিয়ে দেয়। তাই একই কাহিনীর মূল কাঠামোতে নির্মিত দুটি ছবির নির্মাণ সংক্রান্ত ত্রুটিবিচ্যুতি, কীভাবে একজন কালজয়ী অভিনেতার সলিল সমাধি ঘটিয়েছিল। অন্যদিকে দক্ষতা, ‘ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল’-কে চরম প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। আমার স্থির বিশ্বাস, ‘ছোটি সি মূলাকাৎ’ যদি শক্তি সামন্ত বা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হাতে পড়ত উত্তম কুমার অন্য জায়গায় থাকতেন। যাইহোক ‘কামনা’ প্রসঙ্গে আসি।
হাজারো পদ্ধতিগত ত্রুটিবিচ্যুতির সঙ্গে ঘর করে কবিগুরুর দু’খানি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেও, ছবি হিট হল না। এতে পরিচালক প্রযোজকের সঙ্গে নায়ক হিসাবে উত্তম চট্টোপাধ্যায়ের আশা ভরসা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ব্যক্তিজীবনে উত্তমবাবু, অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে সবেমাত্র বিবাহ করেছেন। সেসময় উনি ফিল্মে হিরো হিসেবে সুযোগ পেয়েছেন। এ খ্যাতি কাছের লোকেরা যত বেশি ছড়িয়েছিল ততটাই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল নতুন জামাইয়ের। সবদিক দিয়ে একজন সামান্য কেরানির এহেন বিলাসী হওয়া, লোক হাসানো ছাড়া কিছু নয়।
তবে সময় প্রমাণ দিয়েছিল, আগুন ছাইচাপা থাকলেও তা একদিন প্রকাশ হবেই। —চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content