রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১৬/০৭/১৯৫৪

 

প্রেক্ষাগৃহ: উত্তরা,পূরবী ও উজ্জ্বলা

আবার সুচিত্রা সেন। আবার, আবার, সবার আগে সুচিত্রা। এ যেন ‘ধন্যি মেয়ে’-তে হাড়ভাঙা-র বিরুদ্ধে বগলা-র গোল। পরের পর ফ্লোরে চলছে সুচিত্রা-উত্তমের শুটিং। হল-এর পর হল রিলিজ করছে উত্তম-সুচিত্রার রসায়ন। বলি হলটা কি!
সমস্ত পরিচালক চাইছেন তাঁদের ছবিতে উত্তম-সুচিত্রাকে কাস্ট করতে। নাহলে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনিতে ভর দিয়ে একই পরিচালক একই হলের রিলিজ চেইনে মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে দু-দুটো ছবি মুক্তির ব্যবস্থা করাতে পারেন! এ কি সামান্য কথা!
প্রেমেনবাবু চলচ্চিত্র অঙ্গনে শরত চাটুজ্জে নন। উত্তম-সুচিত্রাও সে অর্থে কেউকেটা নন। তাহলে পরিচালকরা কী ভরসায় বুক বাঁধছেন! ভরসা উত্তম কুমার নামক ওই একহারা ছেলেটার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও বড় হবার ইচ্ছা।
পরিচালক সুকুমার দাশগপ্ত বড় স্নেহ করেন উত্তমকে। তাঁর অনেক আশা আগামীর উপর। সেদিক দিয়ে সুচিত্রার সঙ্গে উত্তমের পর্দার রসায়নের তিনিই প্রথম আবিষ্কর্তা। দুজনের মুখের রেখায় রেখায় ক্যা মেরার কেরামতি দেখানো যায়।
উত্তমের তাকানোর উত্তরে সুচিত্রা যেন সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন। দু’জনের চারচোখ কোন অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা হয়ে আছে তা, ওরা নিজেরাও বোঝে না।
ফ্রেম টু ফ্রেম ক্লোজ আপ, জাম্প কাট ব্যবহার করে পরিচালক শেষ করলেন ফিল্মের কাজ। ছবি মুক্তির জন্য এখন আর অপেক্ষা করতে হয় না। পরিবেশক সংস্থাগুলো সদয় হয়ে এগিয়ে এলেন।
কিন্তু সদয় হল না ব্য‍ক্তি উত্তমের ভাগ্য। সাবিত্রীর সঙ্গে পর্দার বাইরে প্রতিনিয়ত মানস নৈকট্য, বেশিদিন সহ্য হল না।
যেসময় সবাই সুচিত্রা-উত্তমে মজতে শুরু করেছেন সেসময় কোথা থেকে যেন কারা রটালো, সাবিত্রীকে উত্তম নিজের করেছেন এবং কথাটা পৌছলো খোদ উত্তমঘরনী গৌরী দেবীর কানে। দাবানল ছড়াতে বেশিক্ষণ নিল না। যেসময় উত্তমকে ঘিরে গৌরীর স্বপ্ন সার্থকতার দ্বারে, উত্তমের সাফল্যেণ তাঁদের পঙ্গু সংসারটা অনেকখানি সুস্থ সেসময় এতো মানব বোমা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৯: দেখা-অদেখা চেনা-অচেনায় ‘মরণের পরে’

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২: অনন্তের সন্ধান আর সেই দরজার তালা ও চাবি তো তাঁর কাছেই রাখা আছে

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

ভুল বোঝাবুঝি এমন জায়গায় পৌছলো যে একদিন স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’-র শো-শেষে গৌরী দেবী স্বয়ং হাজির হয়ে সাবিত্রীর উপর চড়াও হন।
নির্বাক উত্তম, কোনওরকমে মান বাঁচিয়ে সকলের চোখ এড়িয়ে গৌরীকে নিয়েবাড়ি ফিরেছিলেন।
রাস্তায় একটাও কথা বলেনি গৌরী, বাড়িতে কিছু না খেয়ে সারারাত কাটিয়েছে। উত্তম না পারছে তাকে সহজ করতে, না পারছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে, পরের দিন আবার শুটিং সুচিত্রার সঙ্গে। মনে সবসময় ভয় এই বুঝি কে কোথাও কিছু কুতসা করল। কিন্তু যিনি শিল্পের জন্যর সর্বস্ব পণ করেছেন তাঁকে ঠেকাবে কে ? ক্যামেরা অন হলেই উত্তম ফুল মুডে। রোমান্টিক দৃশ্যে সুচিত্রাও খুব উন্নতি করেছে। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত খুব খুশি।
ছবি রিলিজ করল। প্রেস শোতে সমস্ত সাংবাদিক ঘিরে ধরলেন উত্তমকে। কি ডায়ানমিক পালস অভিনয়ের। উত্তম আস্তে আস্তে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিলেন। এর মধ্যেই একজন সাংবাদিক, চিমটি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে খোঁচা দিতেই উত্তম কঠিন চোখে তাকালেন। মেজাজ হারানোর আগেই সুকুমারবাবু হাত ধরে সতর্ক করে দিলেন। এদের সঙ্গে ঝামেলা করলেই বিপদ।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। প্রথম সারির এক বাংলা সংবাদপত্র লিখল, ”অনন্যন সাধারণ প্রণয়ের অংশ পরিবেশন”।
আজ এত বছর পর ছবির আলোচনায় সবার আগে দেখি, ছবিতে ক্যামেরার ব্যবহার। কাহিনির চাহিদা অনুযায়ী উত্তমকে কীভাবে সমস্ত ছবিতে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে ক্যামেরা যেন ঘাড় পেতে দায়িত্ব নিয়েছে তা করে দেখাবার।
প্রতিটা সিকোয়েন্স উত্তমকে প্রায়োরিটি দিয়ে। সুচিত্রা সঙ্গে থাকলে নানাভাবে অ্যাঙ্গেল চয়েস।
দ্বিতীয়ত, সহশিল্পীদের তুখোড় সঙ্গত। বিশেষত তুলসী চক্রবর্তীর অমন মনকাড়া অভিনয়। দৃশ্যেয়র পর দৃশ্য তুলসীবাবু একাই বেঁধে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১: ছুটি ও ছোটা ছুটি

তৃতীয়ত পরিচালনা। ওই যুগে নির্মেদ প্রসাদগুণ দিয়ে ছবিতে যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা যায়-এ সুকুমার দাশগুপ্ত ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিটা ফ্রেমকে সুকুমারবাবু শিল্পগুণ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে তখনও উত্তমের কণ্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সুচিত্রার কণ্ঠে সন্ধ্যাে মুখোপাধ্যায় জুটি বাঁধেননি। ফিল্ম হিট করার সহজ ফর্মুলা পরিচালকের হাতে আসেনি। সবকিছুর মিলিত ফলে ছবি হিট। ফলস্বরূপ উত্তম মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন অগ্নিপরীক্ষার কাজে।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content