রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


 

ছবি মুক্তির তারিখ : ১৯/০১/১৯৫৪

 

প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর

 

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: বিনয়

১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া চারখানা ছবির মধ্যের তিন-তিন খানা বাণিজ্যিক দিক দিয়ে অসফল হলেও পরপর অনেকগুলো ছবিতেই উত্তম তখন নায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। নিজেকে খানিকটা ব্যস্তও করে ফেলেছেন। দু’ চারখানা ছবির কাজ পুরোদমে চলছে। বাকি ছবিগুলোর শুটিংয়ের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। হাতে এল ‘মনের ময়ূর’ ছবির কাজ।
‘রাত্রির তপস্যা’ খ্যাত রমা ছায়াচিত্র-র ব্যানারে পরিচালক সুশীল মজুমদার, উত্তমকে বলিষ্ঠ নায়ক বিনয়ের চরিত্রে নির্বাচন করলেন। সহশিল্পীদের উপস্থিতিও বর্ণাঢ্য। নায়িকার ভূমিকায় ভারতী দেবী। কাজ শুরুর উত্তম আর শেষের উত্তম দুটোর তফাত অনেকটা। টানা ছয় বছরের ব্যর্থতার গ্লানি অনেকটাই শেষের পথে। উত্তম কুমার নামক নায়কের ছবি মানুষ হজম করতে পারছেন…এরকম একটা প্রেক্ষিতে মুক্তি পেয়েছিল ‘মনের ময়ূর’।
এই প্রথম মিনার, বিজলী এবং ছবিঘর-এর চেইনে উত্তমের ছবি রিলিজ করল। ছবির কর্তৃপক্ষ দারুণ আশাবাদী ছিলেন ছবিটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। কিন্তু খুব ভালো সাফল্য পেল না ছবিটি। রেখে গেল আশা-নিরাশার অস্থায়ী নিরাপত্তা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৩: আশা-যাওয়ার পথের ধারে ‘নবীন যাত্রা’ [১১/০৯/১৯৫৩]

বিনোদন: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াতেও ফুলতে পারে পা, জেনে নিন কী করণীয়

ছবিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় সবার আগে মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের উত্তমকুমার নামক মহীরূহের গোড়াপত্তন হয়ে গিয়েছে ১৯৫৩ সালের ছবিগুলোর মাধ্যমে। ভারতী দেবীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার নায়ক হিসাবে স্ক্রিন শেয়ারের সুযোগ চাট্টিখানি কথা নয়। এ বছরই উত্তমের পরপর এগারোখানি ছবি রিলিজ করবে (যার মধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র মতো ব্লকবাস্টার থাকবে) যা, সে নিজেও কোনওদিন ভেবে ওঠেনি। তবুও এ ছবি বক্স অফিস পেল না। এর কারণ অনুসন্ধান করলে কতকগুলো পারস্পরিক তথ্যে খালিচোখে ধরা পড়বে।
প্রথম: নায়িকা নির্বাচন। এ অংশে উত্তম কুমার হয়েছিলেন অনেকটা দীনেন গুপ্ত পরিচালিত ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিতে সুচিত্রার বিপরীতে রঞ্জিত মল্লিকের মতো। কিন্তু আগামীর মহানায়ককে খুব সহজে দমানো যায়নি। একই বছরে পাশাপাশি যেখানে সুচিত্রা-সাবিত্রীদের সঙ্গে উত্তম কাজের সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে এক সময়ের দাপুটে নায়িকা ভারতী দেবীর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কাজ করেছেন। সমস্যার সূত্রপাত এখানেই। উত্তম কুমার যখন ঝকঝকে তাজা যুবক, ভারতী দেবী তখন অনেকটাই পড়তি। তাছাড়া অভিজ্ঞতা দিয়ে ক্যামেরাকে ব্যবহার করার কৌশলও খুব একটা জানা ছিল না তাঁর। গত শতকের পাঁচের দশকের ভারতীয় দর্শক, কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে বেশি বয়সী ছেলের দাম্পত্যে অভ্যস্ত ছিলেন। সে দৃষ্টিতে শুধু কাহিনীকার প্রতিভা বসুর ব্যক্তিগত পছন্দে ভারতী দেবীর নির্বাচন, ছবির কর্তৃপক্ষকে ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল বৈকি!
দ্বিতীয়ত: ছবির কাহিনী। যে সময়ে একটানা পৌরাণিক ছবির বাড়বাড়ন্ত, মানুষকে প্রশ্নহীন ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখত সে-সময়ে মানবজাতির সুখ-দুঃখের কারাগারে বিচ্ছেদকে এত মর্মঘাতী করে দেখানো (একই রচয়িতার কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে ‘পথে হল দেরী’-র বেলায়ও) মানুষকে অনেকটা বিভ্রান্ত করেছিল। দেশভাগের পর মানুষ হলে বসে দুঃখের মোড়কে সুখের আগমনকে আর নিতে পারছিলেন না। যে কারণে নির্মল আনন্দের টানে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘ছেলে কার’, ‘পাশের বাড়ি’ ছবিগুলো এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
আরও পড়ুন:

জিম-ট্রিম: জিম করে ভুঁড়িকে বাই বাই করতে চান? তাহলে এই ব্যায়ামগুলি করুন

ইংলিশ টিংলিশ: আজকে এসো দেখি Prefix আর Suffix কাকে বলে

প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/২

তৃতীয়ত: ছবির সময়োপযোগী সংলাপে ঠিকঠাক সহশিল্পীর কাস্টিং-র অভাব। কিছুদিনের মধ্যের ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র অকল্পনীয় জনপ্রিয়তার মূল কারণ, ছবির ফ্রেম টু ফ্রেম সংলাপে উপযুক্ত পাত্রপাত্রীর নির্বাচন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, উত্তম-সুচিত্রার একক ছবি নয়। শিশুশিল্পীদের দিয়েও উন্নতমানের অভিনয় করানো হয়েছিল।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য হল, সর্ব অঙ্গে উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট পেলে এ ছবি অগ্নিপরীক্ষার আগে বিগ হিট দিত।
সে সময়ে যে সমস্ত পরিচালকের ছবি মুখ থুবড়ে পড়েছিল, তাঁরা দর্শকদের পালস বুঝতে সক্ষম হননি। একটা সদ্য রিলিজ হওয়া বাংলা ছবিকে তিন ধরনের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো। সবার আগে নিজেকে সমসাময়িক একই ভাষার ছবির থেকে ছাপিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রাথমিক স্তরে রাখতে হতো। পরের ধাপে চলমান হিন্দি ছবির মনোলোভা প্যাকেজ, যে রীতি আজও বহমান। হিন্দিতে সেসময় আরকে প্রোডাকশনের একের পর এক মিউজিক্যাল হিট (বিশেষ করে ‘বরসাত’-র পর) মানুষকে রোমান্সের সংজ্ঞায় একটা ব্রেক এনে দিয়েছিল। পাশাপাশি হেমন্তকুমারের বিগ হিট ‘নাগিন’ সারা ভারতকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিল। ওদিকে গুরু দত্ত পরিচালনায় এসে ক্যামেরার ভাষা এমন ভাবে বদলে দিলেন যে তার প্রবর্তিত ১০০ ডিগ্রি ক্লোজ আপ শট আজও কেউ টপকায়নি। তারপর ছিল ব্রিটিশ কালচারে অভ্যরস্ত এলিট ক্লাস বাঙালির হলিউড মুভির প্রতি অদম্য টান। এতকিছুর কাটাকুটি খেলায় পাশ করে তবে উত্তম-ভারতী-র ‘মনের ময়ূর’ কারা দেখবে! কেন দেখবে!
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৬: ‘সত্যেরে লও সহজে’—রাজসুখ ছেড়ে কি তবে বনবাসী মন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪২: নিজেকে যিনি আড়ালে রেখেছিলেন

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

চতুর্থত: স্টার থিয়েটারে তখন শ্যামলী নাটকে উত্তম-সাবিত্রী মার মার কাট কাট হিট দিচ্ছেন। একটানা ৪০০ রজনী হিট ছিল শ্যামলী। দর্শকরা এ রোমান্সের হাতছানি উপেক্ষা করে সিনিয়র ভারতী দেবীর সঙ্গে বেমানান, দীর্ঘবিচ্ছেদভোজী মিলনে আগ্রহ দেখাননি।
ফল হাতে নাতে। ছবি ফ্লপ।—চলবে

ছবি: জয়দীপ ভট্টাচার্য-র সৌজন্যে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content