শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

প্রেক্ষাগৃহ: উত্তরা, প্রাচী ও উজ্জ্বলা

 

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: উদয়

মানুষের ললাটলিপির একটা আশ্চর্যতম দিক হল ভাগ্যেরর পরিহাস। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ‘বসু পরিবার’-র সাফল্যের খতিয়ান তখনও উত্তমকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ‘বসু পরিবার’ হিট না করলেই ভালো হতো। সাফল্যে পর এক চিলতে আলোয় বাড়াবাড়িবশত হাতের পাঁচ চাকরিটাও হাতছাড়া হল। অন্য দিকে ফিল্মলাইনেও যে ডালটা ধরছে সেটাই ভেঙে যাচ্ছে। পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো বাড়িতে সংসার চালাতে একটার পর একটা জিনিস চলে যাচ্ছে। অভাবের তাড়নায় গৌরী একবাক্স বিয়ের গয়না এগিয়ে দিতে এলে বিপর্যস্ত উত্তম, শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। সময় খারাপ হলে মানুষের বিড়ম্বনা কোন মাত্রায় পৌঁছয় তার গভীরতা, একমাত্র ভুক্তভোগীই বুঝতে পারে। উত্তমের অবস্থা তখন কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া গতি নেই। ঘরে বাইরে আত্মীয়স্বজন সবাই তখন উত্তম-গৌরীর সে অবস্থার ময়নাতদন্তের ভার স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছেন। সরাসরি বাড়িতে এসে, ফোনে নানাভাবে তাদের উপদেশ দিচ্ছেন।
এমন সময় মেঘ না চাইতে জলের মতো নটশেখর নরেশ মিত্র মহাশয় উত্তমকে ডেকে পাঠালেন।
নরেশবাবু তখন যেমন নাট্যজগতের মধ্যগগনে, তেমনি চিত্রজগতেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই নরেশ মিত্র হতভাগ্য উত্তম কুমারকে ডেকেছেন এ ব্যাপারটাই উত্তমের কাছে মরা গাঙে জোয়ারের মতো। গর্বিত উত্তম ছুটে গেলেন নরেশবাবুর কাছে।

ম্রিয়মাণ উত্তমের অসহায় মুখ দেখে বড্ড মায়া হল নরেশ মিত্রের। বসতে বললেন তিনি। শান্ত সাবলীল কণ্ঠে বললেন, “আমার ছবিতে অভিনয়ের জন্যট তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। কবিগুরুর গল্প ‘বউঠাকুরাণীর হাট’। রোলটা বড় স্টিফ, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, পারবে তো?”
ভেসে যাওয়া যাত্রীর খড়কুটো হাতে পাওয়ার অভিব্যক্তিতে উত্তম বলে উঠলেন, “আপনার সুযোগ্য শিক্ষা পেলে ভালোই করব।”
নরেশ মিত্র খুব খুশি হয়ে বললেন, “ব্যাস তাহলেই হবে”।
‘বউঠাকুরাণীর হাট’ ছবির নায়ক নির্বাচিত হলেন উত্তম কুমার।
চরিত্রের নাম ‘উদয়’।
‘দৃষ্টিদান’-র পর আবার রবীন্দ্রকাহিনীতে উত্তমের অংশগ্রহণ।
ছবির বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে নরেশবাবু জানালেন, ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ নির্মাণের নেপথ্য‍ কারণ। নরেশবাবু যখন ‘গোরা’ তৈরি করেছিলেন সেসময় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন এ গল্পের চিত্ররূপ দিতে। উনি কবির সে নির্দেশ পালন করছেন মাত্র।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১১: ভাগ্যের ফেরে হাস্যকর ‘লাখ টাকা’ [১০/০৭/১৯৫৩]

মাথায় খুব খুশকি? চুলও বেশ পড়ছে? চুলের স্বাস্থ্যে জাদুর মতো কাজ করে কারি পাতা

প্রায়শই ব্যায়াম করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন? শরীরচর্চার পরে এই সব খাবার খেতে পারেন

অবশেষে ছবির কাজ শুরু হল। নরেশ মিত্র তাঁর অভিনয় শিক্ষা দিয়ে উত্তমকে এমন ভাবে সাহায্য করলেন যা, উত্তম কোনওদিন বিস্মৃত হননি। একজন বাধ্য ছাত্রের মতো উত্তম নরেশবাবুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যেখানে বুঝতে পারেননি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বারবার নরেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছেন।
উত্তমের ধৈর্য দেখে নরেশবাবু বিস্মিত হয়েছেন। খুশি হয়েছেন অভিনয়ের প্রতি উত্তমের আন্তরিক শ্রদ্ধা দেখে।
একদিনের ঘটনা উত্তমকে নরেশবাবুর অনেক প্রিয়পাত্র করে তুলেছিল।
‘বউঠাকুরাণীর হাট’-র নায়ককে ঘোড়ায় চড়তে হবে। অথচ উত্তম তখন ঘোড়ায় চড়া প্রসঙ্গে নিতান্তই অনভিজ্ঞ। নরেশবাবু ভীষণ চিন্তায় পড়লেন। উত্তমকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন “তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারবে তো?”
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস

বিশেষ দিনে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে থাক সুস্বাদু চিংড়ি পোলাও

দশভুজাঃ আমার দুর্গা

কথাটা উত্তমকে খুব ভীত করে দিল। মন বলল, যদি ঘোড়ায় চড়তে না জানার কথা জানাজানি হয় তাহলে নরেশদা ছবি থেকে হয়তো বাতিল করে দেবেন। কী উত্তর দেবে ভাবছেন…এমন সময় নরেশ মিত্র সস্নেহে বললেন, “এতে এতো ঘাবড়ানোর কী আছে, ঘোড়ায় চড়াটা একেবারে আয়ত্তে আনতে হবে না, মোটামুটি যদি একটু ওঠানামা শিখে নিতে পারা যায় তাহলেই হবে।
উত্তমের কৌতুহলী মুখ দেখে নরেশবাবু আবার বললেন, “তুমি ঘোড়ায় ওঠানামাটা আয়ত্তে আনতে পারলেই বাকিটুকু ডামি দিয়ে চালিয়ে নেব”।
কথাটা উত্তম শুনলেন বটে, তবে মন ভরল না। মাথায় ঘোড়া-চড়া শেখার প্রবল জেদ চেপে বসল।
ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে উত্তম, ভাই তরুণকে নিয়ে সকালবেলা সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে ময়দানে হর্স রাইডিং প্র্যাকটিস করতেন।
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই উত্তম ব্যাপারটা আয়ত্তে আনলেন।
ফল পাওয়া গেল হাতে-নাতে। ঘোড়ায় চড়ার দৃশ্যে র শুটিং-এ সেদিন আর ডামির প্রয়োজন হল না। পুরোপুরি উত্তমকে দিয়েই সিনগুলো টেক করা হল। নরেশবাবু অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।
সময়ের নিয়মে একদিন ছবির কাজ শেষ হল। ছবি রিলিজ করল। কিন্তু উত্তমের পাথর চাপা কপাল খুলল না।
চূড়ান্তভাবে বাণিজ্যিক ব্যর্থতা লাভ করল ‘বউঠাকুরাণীর হাট’।
এবার কিন্তু উত্তম ভেঙে পড়লেন না।
চেন-অচেনা অনেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু ছবির ভাগ্য খোলে না উত্তম থাকলে… এ জ্বালা কাকে বোঝানো যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৪: শোকবিহ্বল মা, ক্ষোভে উত্তাল ভাই — তবুও কি বনবাস?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৩: সমুদ্রশোষণ তো হল, এবার পূরণ করবে কে?

এত বছর পর ছবিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ছবিটি টেকনিক্যালি মঞ্চাভিনয়ের প্রতিরূপ হয়েছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর সেলুলয়েডি রূপান্তর খুব মর্মস্পর্শী।
তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছাড়া সে ধরণের রূপায়ণ খুব কম চোখে পড়েছে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’-র প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি।
দ্বিতীয়ত: মানুষের চরিত্রে রূপদান করার জন্য দেবতুল্য সংলাপ রচনা হয়েছিল, যেগুলো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ রিলিজের বছরে মানুষের হজম করতে সমস্যা হয়েছিল।
এ ছবিতে সংগীতকে একমাত্র ভালো অবস্থানে দেখা যায়। কিন্তু শুধু সংগীতের বৈতরণীতে ছবি পার করা যায় না… একথা ছবির নির্মাণকর্তারা বুঝতে পারেননি।
এর আগে বেশ কয়েকটা ছবিতে উত্তম যেখানে মঞ্চাভিনয়মুক্ত ফিল্মাভিনয় করেছিলেন এ ছবিতে আবার যেন সেই পুরানো রীতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলেছিল। যার ফল হয়েছিল মারাত্মক। দর্শক উত্তম কুমারকে আবার রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিল।—চলবে

ছবি: জয়দীপ ভট্টাচার্য-র সৌজন্যো
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content